
মা কালীর মূর্তিতত্ত্ব।
মায়ের প্রসারিত জিহ্বা: মুণ্ডক উপনিষদে অগ্নির সপ্ত জিহ্বার মধ্যে কালী উল্লিখিত, বৈদিকদের সাহিত্যে মা কালীর এটিই প্রথম উল্লেখ। মনে রাখতে হবে, হরপ্পা সভ্যতায় বলি গ্রহণ করতেন সপ্ত মাতৃকা, এবং কালী এঁদের প্রতিভূ হিসেবে পরবর্তী যুগে বৈদিকদের যজ্ঞের অগ্নির সমতুল্য গণ্য হয়েছেন।
মা কালী বলিপ্রিয়া, প্রসারিত জিহ্বা তাঁর বলি গ্রহণ করার কারণে। মা রুধিরপ্রিয়া, যেমন আমরা দেখি শ্রী শ্রী চণ্ডীতে। মা অসুরদের রক্তপান করেন, সেজন্যও প্রসারিত জিহ্বা।
মায়ের বাহন শব: হ্যাঁ, অন্যান্য দেব দেবীর নানা জীবজন্তু বাহন থাকলেও মা কালী শববাহনা। পালযুগে মাতৃমূর্তির পদতলে একটি শব থাকত, যা জড়তার প্রতীক, যা মাতৃকা দলিত করতেন। এই শব পরবর্তীকালে শিব আখ্যা পায়। মায়ের চরণের স্পর্শ পেয়ে শবও শিবত্বে উত্তীর্ণ।
মায়ের মুণ্ডমালা: পঞ্চাশ বর্ণের প্রতীক পঞ্চাশটি নরমুণ্ড গেঁথে মালা। বাংলা বর্ণমালা এবং তার পূর্বসূরী সিদ্ধমাতৃকা বর্ণমালা তন্ত্রাশ্রয়ী। আমাদের প্রতি বর্ণ মাতৃকাবর্ণ।
এছাড়া পালযুগে মুণ্ডমালিনী মাতৃকাদের উপাসনা খুবই জনপ্রিয়, আরও অনেক মুণ্ডমালিনী মাতৃকা পূজিত হতেন, তারার বিভিন্ন রূপভেদ, বজ্রযোগিনী, নৈরাত্মা। এই ছিন্নমুণ্ডমালা আদি তন্ত্রের খণ্ড সমাধির দ্যোতনাও বহন করে, খণ্ড সমাধি নিয়ে আগে লিখেছি, এরকম খণ্ড সমাধির প্রাচীন প্রথা থেকেই একান্ন শক্তিপীঠ এসেছে।
এছাড়া পালযুগে পাল সৈন্যদের মধ্যে উত্তর পূর্ব ভারতের কিছু পার্বত্য জাতির রেজিমেন্ট ছিল যারা মুণ্ডমালা ধারণ করত, সেখান থেকেও এই মুণ্ডমালা এসেছে বলে কিছু গবেষক মনে করেন। আমিও সহমত।
কবি গেয়েছিলেন, ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি। মা জগদকারণ, তিনি আদ্যা নিত্যা অব্যক্ত। তাঁকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, তিনি বিমূর্ত। কিন্তু আমরা তাঁর এই মুণ্ডমালিনী মূর্তি কল্পনা করেছি, ধ্যানের সুবিধার জন্য তাঁকে মা বলে ডাকি।
মায়ের খড়্গ: আমাদের যাবতীয় জাগতিক ও সঙ্কীর্ণ আবিলতা ছিন্ন করে মায়ের জ্ঞানখড়্গ। এই খড়্গ আমাদের জীবনযুদ্ধের অস্ত্রও বটে। মায়ের খড়্গ সর্বদা চক্ষু বিশিষ্ট হয়, কারণ তা সত্যদ্রষ্টা।
এছাড়া মা বলিপ্রিয়া, মা তাই খড়্গিনী। খড়্গ দিয়েই বলি হয়। পৃথিবীর অন্যত্র মাতৃধর্ম বিলুপ্ত হয়েছে। আমরা পৃথিবীর সর্বশেষ মাতৃকা উপাসক মহাজাতি। খড়্গ আমাদের গর্ব, খড়্গ আমাদের পরিচয়, খড়্গ আমাদের অবলম্বন।
মায়ের ত্রিনয়ন: মা ত্রিকালেশ্বরী, ভূত বর্তমান ভবিষ্যত এই ত্রিকালের অধিষ্ঠাত্রী, তিনি কালের কলন করেন সেজন্য কালী, তাই তাঁর তিনটি নয়ন তিন কালের দ্যোতক।
মায়ের দিগবসন: মা সমগ্র বিশ্বচরাচর জুড়ে ব্যাপ্ত তাই তাঁকে আবৃত করতে পারে এমন বসন হয় না। তাছাড়া তিনি জগন্মাতা, এবং জগদকারণ জগৎপ্রসবিনী। মা যখন প্রসব করেন তখন তিনি আবৃত থাকেন না। সর্বোপরি তিনি পরম সত্য, সেজন্য কোনও বস্ত্রের আবরণ থাকে না কারণ সত্যকে ঢাকা যায় না। তবে মায়ের কটিদেশে ছিন্ন হস্তের মেখলা থাকে, কারণ তা আমাদের কর্ম ও কর্মফলের দ্যোতনা বহন করে, যা অদ্ভুত ভবমোহ, চর্যাকারের ভাষায় বললে। এই ভবমোহ সঙ্গ ছাড়ে না।
মায়ের চার হাতে খড়্গ ও ছিন্ন মুণ্ড, অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা: মা একদিকের হাতে মুণ্ড ও খড়্গ ধারণ করেন, অন্যদিকে অভয় দেন এবং বর দেন। মা দ্বেষকদের ভয় এবং সন্তানদের অভয় প্রদান করেন। মায়ের চার হাত চতুর্বর্গ প্রদায়িনী।
মা এলোকেশী: মায়ের আলুলায়িত কেশ এই বিশ্বে তাঁর সর্বব্যাপী সর্বপ্রসারী আশ্বাসের পরিচায়ক। জগদকারণ প্রকৃতি সর্বত্র আছেন, আমাদের মধ্যে আছেন, পারিপার্শ্বিকের মধ্যে আছেন, জীব ও জড়ের মধ্যে আছেন, নারী ও পুরুষের মধ্যে আছেন।
মায়ের দক্ষিণপদ ও বামপদ, দক্ষিণাকালী ও বামাকালী: মায়ের মূর্তিতে দক্ষিণপদ আগে প্রসারিত থাকলে অথবা শবশিবের বুকের ওপরে থাকলে সে মূর্তি দক্ষিণাকালী এবং বামপদ এই ভঙ্গিতে থাকলে সেই মূর্তি বামাকালী বলে খ্যাত হয়। মায়ের দক্ষিণপদ সম্মুখে থাকলে বলা হয় দক্ষিণদিকের অধিপতি যম মায়ের ভয়ে পালিয়ে যান, অর্থাৎ মা তাঁর সন্তানদের মৃত্যুভয় নিবারণ করেন। বামদিকে পা সম্মুখে সম্প্রসারিত থাকলে মা সমস্ত বাম/বিপরীত/বিভ্রান্তি নিরসন করেন, বিপরীত দশা থেকে সন্তানদের রক্ষা করেন।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
ছবিতে হুগলির একটি কালীপ্রতিমা, মঙ্গলবার রাতে তোলা। স্থান ভাণ্ডারহাটি।
সংযোজন: এই লাইভটা দেখেন নি সম্ভবত। দেখে নিন, শুরুর দিকেই বলি নিয়ে আলোচনা আছে। https://fb.watch/gqB_onV4qB/
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, আঠাশ অক্টোবর দুহাজার বাইশ