
কালী কালো/কৃষ্ণবর্ণা না শ্যামা/নীলবর্ণা?
শাস্ত্র ও পুরাণ অনুযায়ী দুটিই যথার্থ। বাংলা জুড়ে আমি যত জনপ্রিয় সার্বজনীন কালী পুজো দেখেছি তাতে কালো কালীরই প্রাধান্য লক্ষণীয়, কিন্তু নীল বর্ণের কালীও আছেন এবং এই পোস্টে আমরা খুব সংক্ষেপে জানব যে কালীর এই দুই রঙ কেন।
এই দুই রঙের প্রধান কারণ হল এই: যদিও কালী আদিতে অবশ্যই কালো, কিন্তু আজকের শ্যামা কালীর মধ্যে একজন পৌরাণিক নীলা দেবীর স্মৃতি আছে। এই নীলবর্ণের নীলাবতী দেবীর সঙ্গেই শিবের বিবাহ উৎসব ঘটেছিল, এবং বাংলা বর্ষশেষের উৎসব সেই থেকে শুরু, বঙ্গাব্দের সূচনা প্রসঙ্গে আগে লিখেছি।
নীল কালীর মধ্যে পার্বতী কালী আছেন বেশিরভাগ পৌরাণিক মতে যাঁর নীলপদ্মের মত বর্ণ (পার্বতী আগে কালী, পরে গৌরী। পৌরাণিক কাহিনীটি অনেকে জানেন। যাঁরা জানেন না, আরেকদিন বলব)। পৌরাণিক পার্বতী কালীর বর্ণ হিসেবে কালো দুয়েক জায়গায় দেওয়া হলেও বহুল প্রচলিতভাবে তাঁর বর্ণ নীল।
এই নীল কালীর মধ্যে ভদ্রকালীও আছেন, যিনি আগুনের সু-উচ্চ শিখার মত নীল। নীল কালীর মধ্যে নীলাবতী/নীলচণ্ডী আছেন, শশাঙ্কযুগে যাঁর সঙ্গে শিবের বিবাহ উৎসব থেকে বঙ্গাব্দের উৎসবের সূচনা হয়। নীল কালীর মধ্যে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের নীল তারা আছেন, নীল সরস্বতীও আছেন।
কিন্তু কৃষ্ণবর্ণের কালী পৌরাণিক যুগের অনেক আগে থেকে। ইনি হরপ্পা সভ্যতায় পূজিত রাত্রি বা নিশা। বৈদিক আর্যের ইনিই নক্ৎ কৃষ্ণী, ঋগ্বেদে রাত্রি সূক্তে এঁরই স্তব করা হয়েছে। কৃষ্ণী: আক্ষরিক অর্থ: কালো মেয়ে। এঁর উল্লেখ ভারতের ইতিহাসে গত সাড়ে চার হাজার বছর ধরে নথিবদ্ধ। এমনকি পৌরাণিক যুগেও ইনি সমানভাবে আছেন: সতী অগ্নিতে আত্মবিসর্জন করে পুড়ে কালো হয়ে পরজন্মে হিমালয় দুহিতা পার্বতী কালী হয়ে জন্মাচ্ছেন, এ বরাহ পুরাণে আছে।
এই কালো কালীই সূচনা থেকে আমাদের আদ্যা নিত্যা অব্যক্ত পরমা জগদকারণ প্রকৃতি। কিন্তু নীল বর্ণ সেই আদ্যা শক্তিরই একটি নির্দিষ্ট প্রকাশ, একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুগ থেকেই ধারাবাহিকভাবে নীলবর্ণা মাতৃকা আছেন।
বস্তুত রাত্রির রঙ যেমন কালো, তেমনই নীল। এ দুই বর্ণেই মায়ের মূর্তি নির্মাণ ও পুজো শাস্ত্রসিদ্ধ। আমার ঘরে দুই রকম রঙের মাতৃমূর্তিই বিরাজমান। যদিও আমার ব্যক্তিগতভাবে কালো কালীই অধিক প্রিয়: কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন। এছাড়া কালো ও লাল রঙ ঊষার প্রতীক, আদিমাতৃকার চিহ্ন, হরপ্পা থেকে পাণ্ডু রাজার ঢিবি সর্বত্র লাল-কালো রঙ আমাদের পূর্বসূরীদের প্রিয় ছিল, আমরা জানি। এজন্যই সম্ভবত বাঙালির মাতৃধর্মের কেন্দ্রে থাকা আদ্যা নিত্যা মা কালীর লাল জিহ্বা ও কালো রং আমাদের এত প্রিয়, এবং বাংলায় বেশিরভাগ মাতৃমন্দির ও বারোয়ারি পুজোয় এই রঙের কালী দেখি।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
জয় মা কালী। জয় জয় মা।
সংযোজন ১. পদতলে একটি শব, মা কালী শববাহিনী। শবটিই শিবত্ব প্রাপ্ত হয়েছে, মায়ের পায়ের তলায় থাকার সুবাদে।
লম্বা অবস্থায় কালী মূর্তির সঙ্গে দেখা গেলে সেটা উমামহেশ্বর মূর্তি বা অর্ধনারীশ্বর মূর্তির অনুকরণে তৈরি, সেটার সঙ্গে কালীতত্ত্বের সম্পর্ক নেই। কালী জগদকারণ, কালী নিজেই স্বয়ং পুরুষ প্রকৃতি।
২. ঠিক ডিপ শেডও বলা যায় না। কারণ গাঢ় নীল নয়। নীল পদ্ম অথবা নীল আগুনের মত নীল। কিন্তু শ্যামবর্ণ কালো নয়, কোনোমতেই কালো নয়। শ্যামা কালী বললে কালো বোঝাবে না।
শ্যাম বললে হাল্কা নীল যথার্থ, এছাড়া হাল্কা সবুজ হতে পারে, যেমন নবদূর্বাদল শ্যাম। তবে সেরকম সবুজ কালী সাধারণত বিরল। তাই শ্যামা কালী বললে নীলা কালীই বোঝায়।
৩. শৈব ও বৈষ্ণব ধর্ম আদ্যোপান্ত আদিমাতৃকার তন্ত্র থেকে নেওয়া, এ দুই ধর্মের পৃথক কোনও দর্শন নেই, সর্বৈব শাক্ত অনুসারী, শুধু মাঝখানে মায়ের বদলে বা মায়ের আদলে নিজের নিজের পছন্দের একটা পুরুষ দেবতা বসিয়ে দিয়েছেন। সুফি তন্ত্র যেমন: ও যেন আম্বানি আদানির বিপুল ব্যবসায় ব্যাংকের লোন, তার সবটুকুই পরস্মৈপদী ধারের ওপর, মাঝে নিরাকার আল্লাটি কেবল নিজের সম্পত্তি। ভালো থেকো। মন স্থির করে রেখো, পল্লবগ্রাহী হলে সিদ্ধি হয় না।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, চার নভেম্বর দুহাজার বাইশ