
মা কালীর মুণ্ডমালার তাৎপর্য।
১. মা কালীর মূর্তিতে তিনি পঞ্চাশ মুণ্ডশোভিত মালা ধারণ করেন প্রাচীন কাল থেকেই। কালীর গলায় নরকপালমালা আভরণরূপে শোভা পায়, এই মর্মে লিখিত নথি কালিদাসের কাব্যে আছে, আর পাথুরে মূর্তির প্রমাণ পালযুগ থেকে পাই।
এই মুণ্ডমালা প্রথমত ও প্রধানত কৈবল্যের প্রতীক, সমস্ত জাগতিক মোহজাল ছিন্ন করে মাতৃকার খড়্গ, যার ফল এই মুণ্ডমালা।
২. এছাড়া এই মুণ্ডগুলি পঞ্চাশ বর্ণ। আদিতে নাদ ব্রহ্ম ছিল, বলা হয়। এই শব্দ এই অক্ষর থেকে একটি জাতি উৎপন্ন হয়েছিল, যার ভাষার অধিষ্ঠাত্রী কালী, এবং এই অক্ষরগুলি দিয়ে তন্ত্রের সভ্যতার সূচনা হয়েছিল।
এই পঞ্চাশ মুণ্ড পঞ্চাশ বর্ণের সমতুল্য। কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী, আগে লিখেছি।
৩. আর একটি তাৎপর্য হল এই মুণ্ডগুলি তন্ত্রের খণ্ড সমাধির স্মৃতি বহন করে। হরপ্পা থেকে পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে খণ্ড সমাধি প্ৰচলিত ছিল। পঞ্চমুণ্ডি আসন আজও সেই স্মৃতি বহন করে। প্রতিটি ছিন্ন মুণ্ড শক্তিসাধনার একটি প্রতীক, এই নরমুণ্ডমালা তন্ত্রসাধনার দ্যোতক।
৪. এটাও বলার যে আক্ষরিকভাবে নরবলি তন্ত্রের অংশ ছিল এই সেদিনও, যদিও আজ আর হয় না। কলকাতায় চিৎপুরে মায়ের মন্দিরে ইংরেজ আমল শুরু হওয়ার অনেক পরেও নরবলি ঘটেছে, নথিবদ্ধ প্রমাণ আছে। তাই মুণ্ডমালা তন্ত্রের বলির প্রতীক। দেবী বলিপ্রিয়া।
মাতৃধর্ম পৃথিবীর সর্বত্র বিলুপ্ত। আমাদের মধ্যে টিঁকে গেছে তার এক ক্ষুদ্র কারণ এটাও। আমরা শাক্তরা বলি দিই।
৫. মুণ্ডমালা যুদ্ধেরও প্রতীক। মা কালী এই আক্রান্ত মাতৃকা উপাসক জাতির যুদ্ধং দেহি মনোভাবের প্রতীক তাই মুণ্ডমালা ধারণ করেন। পালযুগ থেকেই মুণ্ডমালা শোভিত মূর্তি তন্ত্রের এক স্থায়ী বৈশিষ্ট্য যা শাক্ত তন্ত্রাশ্রয়ী সভ্যতার প্রতিরোধের প্রতীক।
মা কালী অসুরদলনী, মুণ্ডমালা তাঁর বিজয়ের প্রতীক।
৬. পালযুগে খস প্রভৃতি উত্তর পূর্ব ভারতের পার্বত্য জাতি বাঙালির সাম্রাজ্যে রেজিমেন্ট রূপে বিরাজ করত, পালযুগের নথি থেকে জানা যায়। এঁদের কিছু ট্রাইবের মধ্যে মধ্যে মুণ্ডমালা পরার প্রথা এই আধুনিক যুগেও প্ৰচলিত থাকার কথা জানা যায়, সেখান থেকেও একটি প্রভাব আসতে পারে, বিশেষ করে মূর্তিতত্ত্বের বিবর্তনে মুণ্ডমালা শোভিত মূর্তি পালযুগের অবদান, তার পাথুরে প্রমাণ আছে।
৭. বাঙালির পূর্বসূরীরা আদিকাল থেকেই বিজয়া দশমীর দিন যুদ্ধযাত্রা করে কার্তিকী অমাবস্যা তিথিতে মুণ্ডমালা দিয়ে মা কালীর পূজা করত, এটি প্রাচীন প্রথা হওয়ার সম্ভাবনা।
ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি, শাক্ত কবিতায় এই অনুযোগ, সাহিত্যের ছাত্র মাত্রেই বুঝবেন, বিশ্ব সাহিত্যের উচ্চতম স্তরের উইট-এর মধ্যে গণ্য হবে। কালী আদ্যা নিত্যা অব্যক্ত জগদকারণ। তাঁর থেকে বিশ্ব সৃষ্ট। আদিতে কিছুই ছিল না, জগদকারণ কালী তবে মুণ্ডমালা কোথায় পেলেন? এই লেখাটির মাধ্যমে সামান্য হলেও তারই ব্যাখ্যা করতে প্রয়াস পেলাম।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
জয় মা কালী। জয় জয় মা।
চিত্রটি চার্লস এলিক এঁকেছেন। কলা ক্ষেত্রম সাইট থেকে নেওয়া।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, বারো সেপ্টেম্বর দুহাজার বাইশ