
বহুরূপে সম্মুখে তোমার।
মা দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী রূপটিই মুখ্য। সেটি হরপ্পা সভ্যতার মাতৃধর্মের মহিষমেধ থেকেই বিবর্তিত। স্মরণীয় মহাভারতের দুর্গাস্তবে মহিষসৃকপ্রিয়ে সম্বোধন। অর্থাৎ মহিষবলির রক্ত যাঁর প্রিয়। আদিতে সবই মহিষমর্দিনী মূর্তি দেখি, অনেক পরে মহিষটি অসুরে বিবর্তিত, ফলে মহিষাসুরমর্দিনী।
কিন্তু এ ব্যতীত মা দুর্গার সিংহবাহিনী রূপটিও প্রাচীন। বস্তুত পৃথিবীর মাতৃধর্মে এই সিংহবাহিনী রূপ প্রস্তর যুগেই এসে গেছে। এই প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য আনাতোলিয়ার সিংহবাহিনী মাতৃমূর্তি, তিনি সিংহাসনে উপবিষ্ট, দুদিকে দুটি সিংহ। এছাড়া সুমের সভ্যতার ইনান্না, তিনিও সিংহবাহিনী। কুষাণ যুগে এসে দেখি এই সিংহবাহিনী ভারতে নিয়মিত পূজিত হতে থাকেন। হরপ্পা সভ্যতায় একজন ব্যাঘ্রধারিণী মাতৃকা পূজিত হতেন, দুই হাতে দুটি ব্যাঘ্রকে টুঁটি চেপে ধরে শমিত করছেন, যা তন্ত্রের সুষম ভারসাম্যের প্রতীক, ইড়া পিঙ্গলার মধ্যবর্তী সুষুম্না। অনেক পরে দুই সহচর সহ মূর্তি (মা কালীর দুপাশে ডাকিনী যোগিনী, যা বজ্রযোগিনী/ছিন্নমস্তা মণ্ডল থেকে প্রাপ্ত) এই ইড়া পিঙ্গলার মধ্যবর্তী সুষুম্নার প্রতীক।
আমরা সন্তানকোলে মাতৃকা দেখি হরপ্পা সভ্যতায়। ইনি জগদকারণ জগন্মাতার প্রতীক। আজকের গণেশজননী দুর্গা।
এবং সানুচর বা স-সন্তান মাতৃকা দেখি, যাঁর চতুর্দিকে চার সন্তান আছেন। চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গাল সভ্যতায় চার সন্তানসহ মায়ের পুজো হত, সে পুজোয় ঠিক আজকের মত ছাগ বলি হত এবং ঢাক বাজত, প্রত্ন ফলক পাওয়া গেছে। চন্দ্রকেতুগড় থেকে পাওয়া মাতৃকা অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন, তাঁর নানা মূর্তি উত্তরে বাণগড় থেকে দক্ষিণে তাম্রলিপ্ত অবধি পাওয়া গেছে।
এঁর মাথার পেছনে বেশিরভাগ সময়ই দশটি ক্ষুদ্র চুলের কাঁটা থাকত আয়ুধ আকৃতির। এঁকে সেজন্য দশায়ুধা বলি। অনেক পরে এখান থেকেই দশপ্রহরণধারিণী এসেছেন। আয়ুধ বা ভুজের সংখ্যা ভিন্ন হতে পারে, এই সঙ্গের মূর্তিতে যেমন দেখছেন।
কিন্তু এই সব ভিন্ন ভিন্ন ধারা মিশেই আজকের দুর্গা প্রতিমা। ভিন্ন ভিন্ন ধারাগুলির স্বকীয়তা আছে, তা বিস্মৃত হলে এই আসন্ন শারদীয়া উৎসবের পূর্ণ মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হব।
পালযুগের গৌড়বঙ্গে একাদশ শতকের একটি ভিন্ন রকমের দুর্গা সিংহবাহিনী প্রতিমা। বর্তমান অবস্থান হায়দারাবাদ সালার জং মিউজিয়াম।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
জয় জয় মা, তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে। ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী!
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, দুই সেপ্টেম্বর দুহাজার বাইশ