
কৌশিকী অমাবস্যা সমাগত। শুক্রবার বেলা বারোটা বেজে এক মিনিট বত্রিশ সেকেন্ডে শুরু এই ভাদ্র মাসের অমাবস্যা তিথি, গুপ্ত প্রেস মতে, চলবে শনিবার বেলা একটা বেজে তেইশ মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ড পর্যন্ত। এই তিথি যাঁর নামে, সেই মাতৃকার নাম কৌশিকী, কারণ তিনি পার্বতীর কোষজাত, এরকম ব্যাখ্যা দেয় ষষ্ঠ শতকে রচিত শ্রীশ্রীচণ্ডী। চণ্ড মুণ্ড বধ করেছেন বলে চামুণ্ডা, এই ব্যুৎপত্তির মত কৌশিকীও সম্ভবত সংস্কৃত ব্যকরণ সিদ্ধ নয়। আসলে উত্তর ভারতে আর্যভাষীদের মধ্যে কয়েকটি মাতৃকা উপাসক ক্ল্যান ছিল, এঁদের মধ্যে ব্রাত্য আর্য প্রভাব কতটা, আরও গবেষণা ছাড়া নিশ্চিত হওয়া যায় না। কাত্যায়ন গোষ্ঠীর কুলদেবী যেমন কাত্যায়নী, তেমন কৌশিক গোষ্ঠীর কুলদেবী ছিলেন কৌশিকী, এটিই ইতিহাস সিদ্ধ, কিন্তু বহু আদিকালের সে সুপ্রাচীন তথ্য পরবর্তীতে বিস্মৃত, ফলে পৌরাণিক যুগে নতুন ব্যাখ্যা এসেছে, যে কোষজাত বলে কৌশিকী।
এই ভাদ্র অমাবস্যা তিথিতে মা তারার উপাসনার রীতি। মা তারা যদি হরপ্পা সভ্যতার সন্তানকোলে মাতৃকা হয়ে থাকেন (যে সন্তানটি পরে শিশু শিব আখ্যা পাবে), সেক্ষেত্রে এই ভাদ্র অমাবস্যায় মা তারার উপাসনার তিথি উদযাপন উপমহাদেশে অন্তত পাঁচ হাজার বছর ধরে চলছে। বিশেষ করে সন্তানকোলে মাতৃকার একটি নৌকোবাহিনী রূপ পাওয়া গেছে হরপ্পা সভ্যতায়, যা তারিণী বলে গণ্য হতে পারে।
দশ মহাবিদ্যা সেনযুগের তত্ত্ব। কিন্তু মা তারা সুপ্রাচীন। পালযুগে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়, আজ থেকে বারোশ বছর আগে সম্রাট ধর্মপাল মা তারার উপাসক ছিলেন, তাঁর পতাকায় মা তারার চিত্র অঙ্কিত থাকত, বাংলা জুড়ে অনেকগুলি তারাপীঠ ছিল পালযুগে, এখন যদিও কেবল বীরভূমের তারাপীঠই আছে। বস্তুত পালযুগের অনেক জনপ্রিয় দেবীই মা তারার রূপভেদ। মা মনসাও তারার রূপ, জাঙ্গুলীতারা।
দুই হাজার বছর আগে চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতায় একজন সন্তানকোলে মাতৃকার উপাসনা জনপ্রিয় ছিল, এবং কয়েকটি মূর্তিতে মায়ের কোলে সন্তানটির শিশু শিব রূপান্তর লক্ষণ স্পষ্ট হচ্ছে। আমার পেজে আগে লিখেছি, খুঁজলে পাবেন।
কৌশিকী অমাবস্যায় মা তারার উপাসনা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাঙালি। দুবছর কোভিডের কারণে বন্ধ থাকার পর এবার তারাপীঠে বিপুল ভক্ত সমাগম। এবারের ভাদ্র অমাবস্যা আমাদের প্রাণের শাক্তধর্ম, আমাদের আবহমান শেকড়ের মাতৃকা উপাসনাকে পুনর্জাগরিত করুক, মায়ের আলোকে পুনরায় উদ্ভাসিত হোক মায়ের সন্তানরা।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
জয় মা তারা। জয় জয় মা।
পুনশ্চঃ জগদকারণ জগন্মাতার কোনও আবির্ভাব তিথি হয় না। তিনি আদ্যা ও নিত্যা। কৌশিকী অমাবস্যা মা তারার আবির্ভাব তিথি নয়। বীরভূমের তারাপীঠে মা তারার শিলাময়ী মূর্তিরূপটির ঋষি বশিষ্ঠের সামনে আবির্ভাব ঘটেছিল আশ্বিনের শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে, এজন্য সেটি আবির্ভাব তিথি বলে উদযাপিত হয়, কিন্তু সেটি মা তারার একটি নির্দিষ্ট শিলামূর্তির আবির্ভাব তিথি। মা অব্যক্ত জগদকারণ, তিনিই উৎস এবং তিনিই বিলয়। যখন কিছু ছিল না, তখন তিনি ছিলেন, যখন কিছু থাকবে না, তখনও তিনি থাকবেন, অতএব মা তারার কোনও আবির্ভাব তিথি হয় না, তাঁর নির্দিষ্ট রূপেরই আবির্ভাব তিথি হয় মাত্র। এবং কৌশিকী অমাবস্যা মা তারার সেই শিলারূপের আবির্ভাব তিথি নয়। আমার লেখাতে এটি সংযোজন করা প্রয়োজন বোধ করলাম।
মা তারার চিত্রটি ইন্টারনেট থেকে।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, পঁচিশ আগস্ট দুহাজার বাইশ