

আশ্বিন সংক্রান্তির ব্রত: একটি বিশ্লেষণ।
দীর্ঘ অনেক সহস্র বছরের বিজাতীয় আগ্রাসন (আর্যাবর্ত বৈদিক পৌরাণিক বর্ণবাদ, ইসলামিক হানাদারি, পশ্চিমী বিশ্বমানবতা) সহ্য করে, সমস্ত উত্থান পতন সত্ত্বেও টিঁকে আছে ব্রতধর্ম, আমাদের তন্ত্রাশ্রয়ী ব্রাত্য সভ্যতা। আশ্বিন সংক্রান্তির ব্রত সেই সাক্ষ্যই দেয়।
আশ্বিন উৎসবের মাস। আশ্বিন অন্তে এই সময় বাঙালি কৃষকের খাটনি আর নেই। সে এখন শস্যের অপেক্ষায়। অতএব সমস্ত ব্রতের মধ্যে এই আশ্বিন সংক্রান্তি বিশেষ স্থান অধিকার করে।
১. আশ্বিনের সংক্রান্তি দিনে রাঢ় জুড়ে নল সংক্রান্তি বা নল পুজো হয়। ধান এই সময় গর্ভিনী হয়েছে,ধানের থোড় এই সময় স্ফীত হয়। তাই ধানের সাধ দেওয়া হয়। নলখাগড়ার শাখায় নানা মশলা দ্রব্য বেঁধে দিয়ে ধানের মাঠে বা শস্য ক্ষেতে পুঁতে দেওয়া হয়, এই মশলাগুলির মধ্যে থাকে কাঁচা হলুদ,কাঁচা নিম পাতা, তিক্ত পাটপাতা ও পাটবিচি, রাই সর্ষে, খড়ের গুঁড়ো, বুনো ওল, আতপ চালের গুঁড়ো প্রভৃতি। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রাকৃতিক কীটনাশকের কাজ করে সন্দেহ নেই।
২. এই তিথিটি ডাক সংক্রান্তি রূপেও পালিত হয়। ডাক ছিল সম্মানের উপাধি, জ্ঞানীদের এই উপাধি দেওয়া হত পালযুগে। বিশেষত বাংলার কৃষিবিজ্ঞানী কোনও ডাকের স্মৃতি আজও এই আশ্বিন সংক্রান্তি তিথিতে উদযাপিত হয়। মনে রাখতে হবে ডাকের ও খনার বচন আমাদের পূর্বমানুষদের আবহমান প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে।
ডাক্তার রক্তিম মুখার্জি এই আশ্বিনের অন্তিম দিবসে ডাক সংক্রান্তি নিয়ে একটি চমৎকার লেখা লিখেছেন আগের বছর, লিংক কমেন্টে।
৩. আশ্বিন সংক্রান্তি গার্সি পুজোর ব্রত রূপেও পালিত হয়। শস্যলক্ষ্মীর উপাসনা মূলত। গাস্বী বা গারু/গারো/গাড়ুই বা গাড়সে পুজোও বলা হয়। শব্দটি গ্রাস বা গরাস থেকে এসেছে ভাবা যেতে পারে, যিনি গ্রাস বা আহার যোগান, সেই শস্যলক্ষ্মীর উপাসনা।
অনেক জায়গাতেই এইদিন উৎসবের নামাঙ্কিত একপ্রকার সবজি মিশ্রিত ডাল (গার্সি ডাল বা গারোই ডাল) রান্না করে খাওয়া হয়। প্রসঙ্গত একজন বিখ্যাত বাঙালি ইতিহাসবিদ এরকম দাবি করেছিলেন যে বাঙালি আদিযুগে ডাল খেত না, কিন্তু সে কথা ঠিক নয়। হরপ্পা সভ্যতায় ডাল খাওয়া হত, সেই প্রত্ন প্রমাণ পাওয়া গেছে। মৌর্যযুগে পূর্ব ভারতের সুখাদ্যগুলির মধ্যে ঘুগনি প্ৰচলিত থাকার কথা জানা গেছে। ডাল উপমহাদেশের প্রাচীন খাদ্য এবং বাঙালি নিঃসন্দেহে প্রোটিনের উৎস রূপে ডাল গ্রহণ করে আসছে প্রাচীন কাল থেকেই।
জানা যাচ্ছে, সিলেট অঞ্চলে এই আশ্বিন সংক্রান্তি উৎসবকে গর্ভসংক্রান্তি বলা হয়, কাজেই গার্সি শব্দটি গর্ভসংক্রান্তি থেকেও আসতে পারে।
এছাড়া জানা যাচ্ছে যে রাঢ়ভূমির বিভিন্ন স্থানে এইদিন তাল আঁটির শাঁস বা “গজড়” খাওয়া হয়। গজড় থেকে গাড়ুই, এবং গজড়সংক্রান্তি থেকেও গার্সি আসতে পারে।
৪. এদিন সন্ধ্যায় আগুন জ্বালানো হয়। পাটকাঠির মশাল জ্বলে ওঠে, অথবা পরিত্যক্ত কৃষিদ্রব্য একজায়গায় জড়ো করে সেই পিণ্ডে আগুন দেওয়া হয়। এই আগুনের দ্বারা আসন্ন কালীপুজোর আঁচ পোহায় বাঙালি। এমনকি আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর প্রথাও আছে কোথাও কোথাও, ভূতচতুর্দশী রাতের মত।
৫. এই সময় আবহাওয়া শুকনো হতে শুরু করে। এমন অনেক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় গার্সি পুজোয় যা প্রাকৃতিক moisturiser, যেমন পোড়া তেঁতুলের ক্বাথ ঠোঁটে লাগানো হয় এই ব্রত পালনের সময়।
আশ্বিন সংক্রান্তি ব্রতের পেছনে যে পূর্বসূরীদের আবহমান প্রজ্ঞা আছে, তা যেন বিস্মৃত না হই। যেন না ভুলি, এই ব্রত আমাদের মায়ের অসীম আশীর্বাদ হয়ে আমাদের মস্তক স্পর্শ করে।
জয় জয় মা।
চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গাল সভ্যতার দুটি শস্যলক্ষ্মী মূর্তি রইল। ন্যূনতম দুই সহস্র বছর পুরোনো এ মূর্তি দুটিই বিদেশের মিউজিয়ামে আছে বর্তমানে।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, আঠেরো অক্টোবর দুহাজার বাইশ