মধ্যযুগের মাতৃকা উপাসনার ধারা – ডাঃ রক্তিম মুখার্জি (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

বাঙালির মাতৃকা উপাসনার ধারা যুগে যুগে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে নিয়ত বহমান। পাল ও সেনযুগে তন্ত্র চরম গৌরবের শিখরে উপনীত হয়েছিল। বজ্রযানের বিবর্তনে উদ্ভূত সহজযান আপামর বাঙালিকে তন্ত্রের সারতত্ত্বের সাগরে অবগাহন করিয়ে একটি সার্থক গণধর্মের জন্ম দিয়েছিল। সমাজের ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল পর্যন্ত সকলেই সিদ্ধাচার্য পরম্পরায় উপস্থিত ছিলেন। এমনকি রাজন্যবর্গও পিছিয়ে ছিলেন না। পালসম্রাট গোপালের পুত্র পদ্মবজ্র ছিলেন সিদ্ধাচার্য পরম্পরায় অনঙ্গবজ্রের গুরু এবং হেবজ্রতন্ত্রের রচয়িতা। দেবপালের পুত্র চৌরঙ্গ, সিদ্ধাচার্য বীণাপা, লীলাপা (উড্ডিয়ানরাজ ইন্দ্রভূতি), লক্ষ্মীঙ্করা, মঙ্গলসেন প্রমুখও এই বিষয়ে প্রণিধানযোগ্য দৃষ্টান্ত। ইন্দ্রভূতি ও তাঁর ভগিনী লক্ষ্মীঙ্করার উদ্যোগে সহজযানী সিদ্ধগণ ধর্মসম্মেলনে তন্ত্রের তত্ত্বসমূহ সংকলিত করেছিলেন এবং সর্বসাধারণে প্রচার করেছিলেন বলে তিব্বতি সূত্র থেকে জানা যায়। অথচ সেনযুগের পরবর্তী সময়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের উত্থানকাল পর্যন্ত এবং কিছু অংশে তারপরেও বাঙালির তন্ত্রের জগতে বিশেষত শাক্তধর্মে নানা রদবদল দেখতে পাওয়া যায়। তন্ত্রে এই সময় গুহ্যাচারের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পায়। শ্রীচৈতন্য ও নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর সাথে জগাই, মাধাই, চাপাল গোপাল প্রমুখ শাক্তদের বিরোধিতার যে চিত্র মধ্যযুগের সাহিত্যে পাওয়া যায় তা বাস্তবে গণধর্ম আর গুহ্যধর্মের সংঘাত ছাড়া কিছু নয়। বেশ বোঝা যায় সেনযুগের সহজযান থেকে সেন পরবর্তী সময়ের শাক্তধর্মের মধ্যে কোথাও একটি পট পরিবর্তন ঘটেছিল। সংক্ষেপে সেই সময়ের তন্ত্রের একটি রূপরেখা তৈরী করাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।

বাঙালির শাক্তধর্মের নির্যাস নিহিত আছে কুলাচারে। তন্ত্রে কুলের ধারণা অতি প্রাচীন। দেহতত্ত্বে এর লক্ষ্য মূলাধারস্থিতা কুলকুণ্ডলিনীর সহস্রার পর্যন্ত উত্তরণ ঘটিয়ে পরমানন্দ লাভ। বজ্রযান ও সহজযানে কুলাচার এসেছিল পঞ্চতথাগতের ধারণার সাথে। শূন্যতার সাথে মহাকরুণার সমন্বয়ে যখন জগতের উদ্ভব ঘটে; তখন সবার আগে রূপ বেদনা সংজ্ঞা সংস্কার ও বিজ্ঞান এই পঞ্চস্কন্ধের সৃষ্টি হয়। এই পঞ্চতত্ত্বই বৈরোচন, অক্ষোভ্য, অমিতাভ, রত্নসম্ভব ও অমোঘসিদ্ধি। এঁরা সাধকের বোধিচিত্তের এক একটি ভাবের প্রতিনিধিত্ব করেন।

“কাআ তরুবর পঞ্চ বিডাল।”

সাধকের ইচ্ছা অনুযায়ী মাতৃকা কোনো একটি ধ্যানীবুদ্ধের ভাবকে অবলম্বন করে যখন মূর্তি পরিগ্রহ করেন তখন সেই বুদ্ধের কুলচিহ্ন মস্তকে ধারণ করেন। এভাবেই বজ্রযানে কুলের ধারণা এসেছিল। কুলের সাধকই কুলীন। সহজযানে এই পঞ্চকুল মাতৃকার পাঁচটি রূপের নামে নামাঙ্কিত হয়েছিল। ডোম্বী রজকিনী চণ্ডালিনী ব্রাহ্মণী ও নটিনী। নীহাররঞ্জন মহাশয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পদকর্তা চণ্ডীদাস ছিলেন রজকিনীকুলের। চর্যাপদের প্রমাণ অনুযায়ী ভুসুকু চণ্ডালীকুলের এবং কাহ্নুপা ডোম্বীকুলের। তান্ত্রিক সেনসম্রাট বল্লালসেন সম্ভবত সেই কুলসাধনার ভিত্তিতেই বঙ্গের ব্রাহ্মণদের মধ্যে যাঁরা কুলাচারে অগ্রগণ্য এবং আচার বিনয় বিদ্যা প্রভৃতি নয়টি গুণের অধিকারী তাদের কৌলিন্য দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে কৌলিন্য সম্পূর্ণরূপে তন্ত্রের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের কেন্দ্র হয়ে গেল। অন্যদিকে সেন পরবর্তী যুগে কৌলাচার হয়ে গেল নাথপন্থার একাংশের দ্বারা পরিচালিত। মনে রাখতে হবে একই অবৈদিক ব্রাত্য সংস্কৃতিতে উদ্ভূত হলেও সহজযানের সাথে নাথপন্থার বেশ কিছু প্রভেদ আছে। শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় লক্ষ্য করেছিলেন: The Nath cult was born in the general air of Saivism… its main emphasis on the psychochemical aspect of yoga.

গবেষক কল্যাণী মল্লিকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী: নাথ মতে শিবশক্তির সামরস্য দ্বারা ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতে শূন্য ও করুণার মিলনের দ্বারা চিত্তের সমতালাভই উদ্দেশ্য। মৎসেন্দ্র রচিত কৌলগ্রন্থে বৌদ্ধদের নামোল্লেখ পর্যন্ত নাই। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধক দ্বৈত হইতে অদ্বৈতে উপনীত হওয়ার সাধনা করেন।

( অদঅ দিঢ় টাঙ্গি নিবাণে কোরিঅ

অদঅ বঙ্গালে ক্লেশ লুড়িঅ)

কিন্তু নাথযোগীরা বলেন: দ্বৈত বা দ্বৈতরূপং দ্বয়ং উত পরং যোগিনাং শঙ্করং বা। তত্ত্বাতীত অবস্থা দ্বৈতও নয় অদ্বৈতও নয়। বরং দ্বৈতাদ্বৈতবিলক্ষণ অবস্থা।

সহজিয়া মতে মহাসুখের জন্য মিলনের ও যুগনদ্ধ সাধনার বিশেষ গুরুত্ব আছে।

জোইনি তুম বিন খণহ ন জীবমি

তো মুখ চুম্বি কমলরস পিবমি

কিন্তু নাথযোগীরা রমণী সহযোগে সাধনার বিরোধী। এই প্রসঙ্গে সুকুমার সেন মহাশয় বলেছেন; 

নাথযোগীদের মুলত দুই পৃথক সম্প্রদায় ছিল তাঁর প্রমাণ আছে। এক সম্প্রদায়ে নামের শেষে নাথ; অপর সম্প্রদায়ে পা। মীননাথ গোর্খানাথের সম্প্রদায় ছিল একান্তভাবে নারীসঙ্গ বিবর্জিত জ্ঞানাশ্রিত যোগমার্গাবলম্বী। হাড়িপা কানপার সম্প্রদায়ও যোগমার্গী ছিল কিন্তু তাহা পুরোপুরি জ্ঞানাশ্রিত ছিল না। তাহাতে তান্ত্রিক সাধনা প্রচলিত ছিল এবং নারী সাধিকার স্থানও ছিল। প্রথমকে বলতে পারি অবধূত যোগী সম্প্রদায়। দ্বিতীয়কে কাপালিক যোগী সম্প্রদায়। মিন-চৈতন্য কাহিনিতে দুই সম্প্রদায়ের বিরধ দেখাইয়া শেষে অবধূত যোগীরই আধিপত্য স্থাপিত হইয়াছে। 

প্রসঙ্গত অবধূত সিদ্ধাচার্য কাহ্নুপা ও সরহপা ডোম্বী সাধনার একটি চর্যায় নিজেকে নিঘৃণ কাপালী বলেছেন। সুকুমার সেন দেখিয়েছেন মধ্যযুগে এই অবধূত ও কাপালিক যোগী সম্প্রদায় মিশে গিয়ে কৌল নাথপন্থার নির্মাণ করেছিল। 

এই নাথপন্থাই মধ্যযুগের কৌলাচারের মূল ধারক। কৌলমার্গীয় নাথগণ সহজযানীদের মতো নির্বাণ বা অগণিত লোকহিতের পর খসর্পণ ভূমিতে উত্তরণের চেষ্টা করতেন না। তাঁদের লক্ষ্য ছিল জীবন্মুক্তি। অর্থাৎ যোগের মাধ্যমে বিন্দুতত্ত্বের সাধনা করে দেহরসের সমতা লাভ করে শুদ্ধদেহ অর্জন। সেই শুদ্ধদেহ অজর অবিনশ্বর। গোরক্ষবিজয়ে গোরখনাথ ও মীননাথের কথোপকথনে এবং মৈনামতীর কাহিনীতে ডাকিনী সিদ্ধা ময়নামতীর পুত্র গোবিন্দচন্দ্রকে উপদেশদানকালে এই সাধনতত্ত্বের বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়। অজপা জপ করে চারি চন্দ্র ভেদ করে কায়া সাধনায় উত্তীর্ণ হওয়াই সেখানে মূল লক্ষ্য। মধ্যযুগের তন্ত্রের কৌল ধর্মে নাথপন্থার এই আদর্শটিই গৃহীত হয়েছে। এই সময় থেকে বাঙালির শাক্ততন্ত্রে সহজযান আর মূল ধারা হিসেবে থাকল না। অদ্বৈত মাতৃকার তত্ত্ব ও মহাকরুণার দার্শনিক মাধুর্যের পরিবর্তে যোগাচার ও দ্বৈতাদ্বৈতভাবের প্রতিষ্ঠা হল।

পালযুগে গোরক্ষ ও চৌরঙ্গীনাথ অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও মাতৃপূজক পালরাষ্ট্রের সাথে তাঁদের সংঘাত ঘটেছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লক্ষ্য করেছিলেন নেপাল, তিব্বত, ভুটানের সহজিয়ারা মৎসেন্দ্রকে অবলোকিতেশ্বরের অবতার জ্ঞানে পূজা করে। কিন্তু গোরক্ষ ও তাঁর পরবর্তী নাথযোগীদের পূজা হয় না। গোরক্ষবিজয় গ্রন্থে এবং কালীঘাটের সম্পর্কিত গোরখের কিংবদন্তি থেকে মাতৃকার অবমাননার একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। নাথদের গীতিতে নারী দেবতার অবমাননার অজস্র প্রমাণ আছে।

‘বাসুলী বড় সতী তোর বাসুলী বড় সতী

যার সতীপনাএ পালাইয়াছে খিতি’

এই একই ধুয়াতে দুর্গা, মনসা, চণ্ডীকে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে।

দেবপালের পুত্র চৌরঙ্গীনাথ এজন্য আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁর দুই হাত ও দুই পা কাটা হয়েছিল। যদিও এরপরে তিনি মাতৃকা উপাসনা ধর্মে প্রত্যাবর্তন করেন এবং কালীক্ষেত্র কালীঘাটের সাথে বর্তমান চৌরঙ্গীতে অবস্থিত তাঁর সাধনক্ষেত্রের একটি সুপ্রাচীন সংযোগ বর্তমান।

চুরাশি সিদ্ধদের মধ্যে চৌরঙ্গীনাথ ও ঘন্টাপার কাহিনী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেখানে নাথপন্থা ও সহজযান এই দুটি ভিন্ন ধর্মভাবনার সংঘাতের ইঙ্গিত আছে। চৌরঙ্গীনাথ ছিলেন দেবপালের পুত্র; পালরাষ্ট্রের যুবরাজ। তিনি নাথপন্থার অনুগামী হয়ে এবং সম্ভবত প্রাসাদের জটিল রাজনীতিতে বিরক্ত হয়ে সন্ন্যাস নেন। কাহিনীতে তাঁর জনৈক বিমাতার কুচক্রকে এখানে দায়ী করা হয়েছে। যদিও কাহিনীটি সম্রাট অশোকের পত্নী তিষ্যা ও সম্রাটের প্রিয় পুত্র কুণালের কাহিনীর সাথে এত নিখুঁত সাদৃশ্য বহন করে যে এর বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যুবরাজের চার হাত পা কাটা যায় রাজকোপে। চারটি অঙ্গ বাদ যাওয়ার কারণেই তাঁর নাম চৌরঙ্গ। এর মধ্যে নাথপন্থার সাথে পালরাষ্ট্রের তন্ত্রধর্মের কোনো সংঘাতের ইঙ্গিত আছে কিনা ভেবে দেখার বিষয়। কারণ চৌরঙ্গ ও গোরখের কাহিনী একসূত্রে গাঁথা; অচিন্ত্য যোগীর নির্দেশে গোরক্ষই চৌরঙ্গীকে সাধনকালে শুশ্রুষা করতেন। অন্যদিকে মীনচেতন সহ গোরক্ষের বিভিন্ন কিংবদন্তিতে মাতৃকা উপাসনার ধারার সাথে তৎকালীন নাথপন্থার একটা সংঘাতের চিত্র পাওয়া যায়। কানপা ও হাড়িপার প্রকৃতিসাধনা গোরক্ষ মানেন নি। আমরা আগেই দেখেছি তাঁর সময় থেকেই নাথপন্থার মধ্যে যুগনদ্ধ সাধনাকারী কাপালিক ও প্রকৃতিসাধনা পরিত্যাগকারী ; এই দুই ধারা পৃথক হয়ে যায়। প্রথম ধারাটিই কৌলাবধূত। জালন্ধরীপা, অবধূতীপার মতো সিদ্ধগণ এই ধারার অন্তর্গত। গোরক্ষ দ্বিতীয় অর্থাত যোগী ধারার অন্তর্গত এবং মীনচেতন(গোরক্ষবিজয়) এর মূল উপজীব্য হল প্রথম ধারাটির ওপর দ্বিতীয় ধারার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লক্ষ্য করেছিলেন নেপালে মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রকে অবলোকিতেশ্বরের অবতার রূপে পূজা করা হয়। কিন্তু গোরক্ষের পূজা হয় না। যদি এই সমস্ত সূত্রকে একত্রে বিবেচনা করা হয় তাহলে একটি সম্ভাবনার কথা মাথায় আসে। তা হল: দেবপালের সমকালে প্রকৃতিসাধনার সমর্থক ও প্রকৃতিসাধনার বিরোধী দুটি ধারা তন্ত্রের মধ্যে থেকে আত্মপ্রকাশ করেছিল; বিবাদমান সেই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দেবপাল এক পক্ষ অবলম্বন করেন এবং চৌরঙ্গ দ্বিতীয় পক্ষে যোগ দেন। তাঁর হস্ত পদ ছেদন তারই করুণ পরিণতি। তবে তাঁকে চুরাশি মহাসিদ্ধের মধ্যে ধরা হয়েছে; মূল কাহিনীতে সহজ সাধনার পথে তাঁর পঙ্গুত্ব দূর হওয়ার বিবরণ আছে। এবং কলকাতার কালীক্ষেত্রের সাথে তাঁর নাম আজও জড়িয়ে আছে। এগুলি ইঙ্গিত করে চৌরঙ্গীনাথ শেষ পর্যন্ত মাতৃকা উপাসনার ধারায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।

এই সম্ভাব্য সংঘাতের ধারণাটি আরো প্রকট হয়ে ওঠে যখন আমরা ঘন্টাপার কাহিনী পাঠ করি। কাহিনী অনুযায়ী তিনি প্রথমে অত্যন্ত তপোনিষ্ঠ ভিক্ষু ছিলেন। সংসারী জীবমাত্রকেই তিনি কলুষিত ও পাপী মনে করতেন। দেবপাল তাঁকে ধর্মোদেশনার জন্য বারংবার বিনীতভাবে আহ্বান জানালেও তিনি রূঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন। ক্ষুব্ধ সম্রাটের নির্দেশে এক নটিনীর কন্যা নিজ রূপের মোহে ভিক্ষুকে আচ্ছন্ন করেন; তিনি তাঁর সাথে যুগনদ্ধ সাধনা শুরু করেন। যখন তিনি জানতে পারেন এর পিছনে দেবপালের প্রশ্রয় আছে; তখন তিনি প্রত্যক্ষ সংঘাতে অবতীর্ণ হন। মূল কাহিনীতে এরপর একটি অলৌকিক বর্ণনা আছে। ভিক্ষু হেবজ্রের ক্রোধসমাধির মাধ্যমে রাজধানীকে জলপ্লাবিত করতে থাকেন। সকলের মৃত্যু আসন্ন দেখে অবলোকিতেশ্বর স্বয়ং প্রকট হয়ে জলধারা রুদ্ধ করে পালরাষ্ট্রের রাজধানী রক্ষা করেন। তাঁর আশীর্বাদে ভিক্ষু তাঁর সাধনসঙ্গিনী সেই নটিনীকে নিয়ে সহজসাধনায় মহাসিদ্ধ হন এবং ঘন্টাপা নামে অভিহিত হন। এখানেও প্রকৃতিবিমুখ কঠোর তপশ্চর্যার সাথে সহজমার্গের প্রকৃতিসাধনার সংঘাত এবং পরিশেষে সহজ তন্ত্রমার্গের জয় ঘটেছে। দুটি কাহিনীই যেভাবে দেবপালকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে তাতে ধারণা করা কঠিন নয় যে পালরাষ্ট্রের রাজধর্ম এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের গণধর্মের সাথে প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন থেরবাদ ও নাথপন্থার একটি ধারার তীব্র সংঘর্ষ ঘটেছিল।

এরপর সেনযুগে বল্লালের সাথে নাথপন্থীদের একাংশের বিবাদের বিবরণ পাওয়া যায় একাধিক সূত্রে। বল্লালসেন ঢাকেশ্বরী, কালীঘাট, জহুরাকালী, গৌড়েশ্বরী, কল্যাণেশ্বরী প্রমুখ প্রসিদ্ধ তন্ত্রপীঠের প্রতিষ্ঠা ও পুনরুত্থানের সাথে জড়িত। সেক্ষেত্রে নাথপন্থার একাংশের সাথে মাতৃকা উপাসনার সংঘাতের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য আছে। অথচ সেন পরবর্তী যুগে কুলাচার মূলতঃ নবনাথ সম্প্রদায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই নবনাথ অর্থাত্ নবনির্মিত নাথ পরম্পরা স্বয়ম্ভূনাথ পদ্মসম্ভব ও মৎসেন্দ্রনাথকে নিজেদের আদিগুরু বললেও বাস্তবে এঁদের অবস্থান সহজযানের সাথে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।

অথচ বাংলায় এই নবনাথ পরম্পরাই শাক্তধর্মের প্রধানতম ধারাটির নিয়ন্ত্রক। এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবে সহজযানের সাধনদর্শন তাঁদের কৌলধর্মে অনেকটাই অবহেলিত। তন্ত্র-ক্রমের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে দেখা যায় স্বয়ম্ভূনাথের তীর্থিক বিজয়ের পর থেকেই যে তীর্থিকগণ নবনাথ-ক্রমের আদেশ গ্রহণ করেন তারাই তীর্থনাথ নামে অভিহিত হন। তাই এনারা কুলক্রমী। কিন্তু শঙ্করাচার্য্যের বৈদিক অভিযানের ফলশ্রুতিতে নাথপন্থার অবৈদিক ধারাগুলি অনেকাংশে শঙ্কর-ক্রমের বৈদিক ধারার আনুগত্য স্বীকার করে।

তবে সহজযানের সাথে কৌল নাথগণের মিলও ছিল। দুটি মতই বেদাচারের বিরুদ্ধে তন্ত্রের জয়গান করেছে। সুকুমার সেন মহাশয় হাড়িপা ও কানপার কাপালিক সাধনাকে তন্ত্রের সাথে সংযুক্ত বলে দেখিয়েছেন। হাড়িপার শিষ্যা   মৈনামতীর ডাকিনী সিদ্ধা হওয়ার বিষয়টিও বজ্রযান ও সহজযানের ডাক ডাকিনী পরম্পরার সাথে সংযোগের ইঙ্গিত দেয়। জনানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয় দেখিয়েছেন মৈনামতির মহাজ্ঞান মন্ত্রের প্রভাবে ভীষণা রূপ ধারন করে অগ্নিজ্বালায় নৃত্যের যে বিবরণ আছে; তা হেবজ্রতন্ত্রে বর্ণিত নির্মাণচক্রে চৌষট্টিদল পদ্মে ডোম্বী নৈরাত্মা মাতৃকার রূপের সাথে মিলে যায়।   সহজযানের চুরাশি সিদ্ধের তালিকাতে যে গোরক্ষ ও চৌরঙ্গপার উল্লেখ আছে তাঁরাই নাথপন্থার গোরখনাথ ও চৌরঙ্গীনাথ। মীননাথের সাথে অচিন্ত্য যোগী লুইপার অভিন্নত্বের বিষয়টিও একাধিক তিব্বতি সূত্র সমর্থন করে।

দুটি সাধনার ধারাতেই দেহতত্ত্ব ও পীঠের ধারণা প্রাধান্য পেয়েছে। কৌলমতে পীঠের ধারণা তোড়লতন্ত্রে এভাবে প্রকাশিত হয়েছে:

মূলাধারে কামরূপ, হৃদয়ে জলন্ধরপীঠ, তার ঊর্ধ্বে পূর্ণগিরি ও উড্ডিয়ান। ভ্রূমধ্যে বারাণসী। নেত্রে জ্বালামুখী। মুখে মায়াবতী। এই অষ্টপীঠ দেহসাধনার পাশাপাশি তৎকালীন তন্ত্রধর্মের ভারতব্যাপী প্রসারেরও ইঙ্গিত দেয়। আজও নাথপন্থীদের কুলক্রমে সতীপীঠসমূহে একাক্ষরী নাদবীজে চক্রসাধনার রীতি আছে। চর্যাপদে পরমা মাতৃকা ডোম্বী চণ্ডালী শবরী রূপে বর্ণিত। তিনিই নাথযোগীদের মননে কুলকুণ্ডলিনী রূপে মূলাধার কামরূপ থেকে উড্ডিয়ান সহস্রার অভিমুখে গমন করেন।

রাত বধু কামরু জাউ

মণিকুল বাহি ওড়িয়ানে সমাঅ

প্রভৃতি চর্যাতে এই তত্ত্বের সাথে যথেষ্ট সাযুজ্য বর্তমান। সেনযুগের শেষভাগ ও মধ্যযুগের সূচনাকালে যে কৌল নাথপন্থীরা শক্তিপীঠসমূহে বজ্রযানী ও সহজযানী পরম্পরার উত্তরসূরি হয়ে উঠেছিলেন তার একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত বীরভূমের তারাপীঠের আচার্যদের তালিকা। তারাপীঠে যে গুরুবন্দনার রীতি আছে সেখানে দিব্যৌঘ, সিদ্ধৌঘ ও মানবৌঘ গুরুদের বন্দনা করা হয়। তারাপীঠের চারজন সিদ্ধৌঘ হলেন বশিষ্ঠ কূর্ম্মনাথ মীননাথ ও হরিনাথ। এঁদের মধ্যে মীননাথই মৎস্যেন্দ্র। কূর্ম্মনাথ ও হরিনাথ নাম দুটিও নাথ পরম্পরার দুজন সাধকের নাম বলেই মনে হয়। মধ্যযুগে কৌল পরম্পরার প্রবর্তনের পর থেকে তন্ত্রের গুরু ও আচার্যদের নামকরণের রীতিতেও একটি বদল এসেছিল। সেনযুগ পরবর্তী কুলাচারের আমূল পরিবর্তনের একটি দৃষ্টান্ত কৌল গুরুদের নামের মধ্যেই পাওয়া যায়। বজ্রযান ও সহজযানে আচার্যদের নামের শেষে বজ্র বা পা যোগ হতো। অনঙ্গবজ্র, অবধূতীপা, লুইপা, সরহপা/সরহবজ্র, ভুসুকুপা প্রভৃতি। তীর্থনাথ পরম্পরার প্রবর্তনের পর কৌল আচার্যদের নামের শেষে নাথ যুক্ত হল। এঁরা কুলাবধূত। তারাপীঠের সিদ্ধৌঘ পরম্পরাতেও এর সুস্পষ্ট প্রভাব পাওয়া যায় যখন দেখি চীনাচারসারতন্ত্র ও রুদ্রযামলে উল্লিখিত; সাবর্ণগোত্রীয় ভবদেব ভট্টের পূর্বসূরি তারাসিদ্ধ বশিষ্ঠ এই পরম্পরায় বশিষ্ঠানন্দনাথ নামে অভিহিত হচ্ছেন। অর্থাত্ এই সময় থেকে নাথ কৌলগণের পরম্পরা বাঙালির তন্ত্রের ধারাটিকে নিজের মতো করে আত্তীকৃত করেছে।

এই প্রসঙ্গে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হল নাথপন্থার কুলাবধূতগণের সাথে সহজিয়া অবধূতগণের বৈসাদৃশ্য। বাঙালির ব্রাত্যধর্মে কঠোর যোগাচারী পরিব্রাজক সাধকগণের একটি প্রাচীন ধারা অনেক আগে থেকেই ছিল। লকুলীশের পাশুপত সম্প্রদায় থেকে শুরু করে শৈবাগমের মৎসেন্দ্রনাথ পর্যন্ত সেই ধারা বিদ্যমান। এঁরা সাঙ্খ্যের দ্বারা প্রভাবিত এবং বিভিন্ন সময়ে মাতৃকার পীঠরক্ষক ও সহচররূপেও কল্পিত। কালীঘাটের পীঠরক্ষক লকুলীশ ভৈরব তারই দৃষ্টান্ত। পাল ও সেনযুগে সহজযানের প্রভাবে সেই যোগাচারী, সর্ববন্ধনত্যাগী পরিব্রাজক সাধকদের মধ্যে প্রকৃতিপরায়ণতার ধারাটি পুনরায় প্রবল আকার ধারণ করে। তাঁদের ধূতাঙ্গ সাধনার সমস্ত ভাব অক্ষুণ্ণ রেখেও তাঁরা হয়ে ওঠেন দেহতত্ত্বের উপাসক। এঁরাই পরিচিত হন অবধূত নামে। তন্ত্রের তিন নাড়ি এঁদের কাছে ললনা, রসনা, অবধূতী নামে পরিচিত। এঁদের মূল ভাবনাও প্রজ্ঞা ও করুণার আদর্শে চালিত এবং মূল লক্ষ্য অদ্বৈতা মাতৃকার সাধনা। সহজযানী অবধূতীপাদ সরহবজ্র এবং মধ্যযুগের বাঙালির বৈষ্ণব আন্দোলনের প্রধান স্তম্ভ নিত্যানন্দ অবধূতের জীবনদর্শন তার সার্থক দৃষ্টান্ত। করুণার মূর্ত বিগ্রহ রূপে নিত্যানন্দ আজও বাংলায় স্থান বিশেষে চৈতন্যদেবের থেকেও অধিক বন্দনীয় হয়ে আছেন। কিন্তু তীর্থনাথ পরম্পরার পর থেকে অবধূত সাধকগণের সাধনধারায় মাতৃকার অদ্বৈতা রূপটির পরিবর্তে শিবশক্তি দ্বৈততত্ত্ব প্রধান হয়ে উঠল। এই সময় থেকে কুলাচারের এমন একটি ধারা তৈরী হল যার সাথে পূর্ববর্তী যুগের বাঙালির মাতৃকা উপাসনার ধারার মিলের থেকে অমিল বেশি। প্রণিধানযোগ্য বিষয় হল সেনযুগে নাথপন্থীদের যে অংশটি অন্তর্ঘাত করেছিলেন তাঁরাই এই সময় বেদান্তের গোপন অনুসারী হয়ে শাক্তধর্মে রদবদল ঘটিয়েছেন। অন্যদিকে নাথগণের বৃহদাংশ মধ্যযুগেই নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর প্রচেষ্টায় বাউল ও বৈরাগী সাধনার জগতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। এই বিষয়টি বিশদে আলোচনার দাবি রাখে যা এখানে করা সম্ভব নয়। তবে সেনযুগের পরবর্তী সময়ে শাক্তধর্মে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা না থাকায় পূর্বতন মাতৃকাবিরোধী ভাবধারার অনেকগুলিই এর অভ্যন্তরে অতি সহজে প্রবেশ করতে পেরেছিল; সেটা বেশ বোঝা যায়।

বাঙ্গালির প্রাচীন তন্ত্রভাবনায় সবার উপরে স্থান দেওয়া হয় আদি নিত্যা একানংশা

জগতপ্রসবিনী আদিমাতৃকাকে। তিনি নারীও নন; পুরুষও নন আবার উভয়ই। তাঁর কোনো সঙ্গী নেই। তাঁর দ্বারা সৃষ্ট জগতে পুরুষ ও নারী উভয়রূপে তাঁর অংশ বিদ্যমান। পরমতত্ত্বে তিনি একাকিনী; সঙ্গরহিতা। গঙ্গারিডি যুগের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহে এবং  গঙ্গারিডির পতনের ঠিক পরেই রচিত চণ্ডীতে এই ভাবনাই প্রকাশিত। সেখানে মধুকৈটভবধ, মহিষমর্দন ও শুম্ভবিনাশের জন্য যে অম্বিকা মহামায়া দেবগণের প্রতি কৃপা করে আবির্ভূতা হন; তিনি “নিত্যা, জগন্মূর্ত্তি, সর্বব্যাপিনী, ঈশ্বরেরও ঈশ্বরী।” বিষ্ণুপত্নী শ্রী ও শিবপত্নী গৌরী তাঁর অংশরূপ মাত্র। দেবীসূক্ত অনুযায়ী রুদ্র, ইন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, বসু প্রভৃতি দেবগণ তাঁরই রূপ। এই জগতের যিনি পিতা; তিনিও এই মাতৃকার গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছেন। শক্তিও তিনি শক্তিমানও তিনি। পালযুগের মাতৃকাদের কুমারীরূপে উপাসনা; বজ্রযোগিনী দেবীর পুরুষ নারীর দ্বৈত মিলনাত্মক রূপকে পদদলিত করা; নৈরাত্মা ডোম্বীর চৌষট্টি পাপড়িযুক্ত পদ্মে নৃত্য সেই ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ। নয়পালের সময়ের শ্রীধরকবির চর্চিকাস্তবে দেখি প্রলয়ের পর সৃষ্টিবিধাতা চর্চিকার চরণধূলি থেকেই জগত সৃষ্টি করেন।

“কল্পান্তে নৃকপালমণ্ডনবিধি পায়াজ্জগচ্চর্চিকা”

সেনযুগের তারাস্তবেও মাতৃকার এই বিশ্বজননী রূপটিই প্রধান হয়ে উঠেছে। অথচ সেনযুগ পরবর্তী সময়ে কৌলধর্মে মাতৃকা সবসময়েই শিবের সাথে অবস্থিত। ষটচক্রে তিনি বিহার করেন শিবের ছয় রূপের সাথে। সহস্রারে তিনি মহাকাল ও সদাশিবের সাথে নিত্যলীলায় অধিষ্ঠিতা। একানংশা মাতৃকা নন; শিবশক্তির অভিন্নরূপই সেখানে সাধনার সর্বোচ্চ উপলব্ধি। যে চণ্ডিকা  তন্ত্রের আদিধারায় নিজেই পূর্ণা পরমেশ্বরী; মধ্যযুগে তিনিই হয়ে গেলেন পরব্রহ্মমহিষী। একটি মজার বিষয় হল মধ্যযুগের তন্ত্রে প্রকৃতি মানেই নারী। তাই তিনি সর্বদাই পরমপুরুষের সঙ্গিনী বা সহচরী। অথচ তন্ত্রের আদিপর্বে প্রকৃতি ছিলেন লিঙ্গের অতীত; নারী পুরুষ দুইই তাঁর রূপ। পালযুগের মহাকাল বিগ্রহ তার সার্থক দৃষ্টান্ত। বজ্রযান ও সহজযানে মহাকাল কালীরই রূপভেদ। কমলাকান্তের ভাষায়

 “কালী কেবল মেয়ে নয় কখনও কখনও পুরুষ হয়।”

অথচ সেনযুগের পরবর্তী সময়ের তন্ত্রে মহাকাল কালীর ভৈরব। একাকিনী পরাশক্তি চণ্ডিকা পরব্রহ্মের পত্নী।

তন্ত্রের এই পটপরিবর্তনের একটি প্রধান কারণ দার্শনিক তত্ত্বের বিভেদ। সেনপরবর্তী যুগে তন্ত্রের সাথে আদি শঙ্কর প্রণীত অদ্বৈতবাদের সমন্বয় ঘটেছিল। শুধু তন্ত্র নয়; সমস্ত সাধনমার্গই যে বাস্তবে আদি পরমব্রহ্মকে লাভ করার মাধ্যম মাত্র; এই ভাবনা প্রবল হতে শুরু করে। ফলে তন্ত্রের আদি সিদ্ধান্তগুলিকে বেদান্তের ধারাতে মিলিয়ে দেওয়ার প্রয়াস শুরু হয়। বাঙালির তন্ত্রধর্মের মূল নিহিত আছে কপিলের আদি সাঙ্খ্যে। সেই সাঙ্খ্য; যাকে শঙ্করাচার্য্য বেদান্তের প্রধান প্রতিপক্ষ বলেছিলেন। অথচ এই সময় থেকে তন্ত্রের মাতৃকা গণ্য হলেন পরব্রহ্মের মায়াশক্তি রূপে; যিনি ইচ্ছা ক্রিয়া ও জ্ঞানের পথে জগতের কার্য পরিচালনা করেন। মাতৃকার যে ষটত্রিংশৎ (ছত্রিশ) তত্ত্ব এখানে আলোচিত হয় তার  মধ্যেও বৈদান্তিক মায়াবাদের স্পষ্ট উপস্থিতি। ছত্রিশ তত্ত্বের মধ্যে প্রথমটিই শিবতত্ত্ব, ইচ্ছা ক্রিয়া জ্ঞানময়ী নিত্যাশক্তি দ্বিতীয় তত্ত্ব। সদাশিব তৃতীয় তত্ত্ব। চতুর্থ তত্ত্ব ঈশ্বর। পঞ্চম তত্ত্ব অহন্তা। ক্রমান্বয়ে অবিদ্যা, কলা, রাগ, কাল, নিয়তি প্রমুখ তত্ত্বসমূহ আছে। এর মধ্যে সাঙ্খ্যের আদি চতুর্বিংশতি তত্ত্বের প্রভাবও আছে। কিন্তু এই তত্ত্ববিন্যাসের মূল কাঠামোটি সাঙ্খ্যের থেকে অনেকটাই পৃথক। বেশ বোঝা যায় সর্বেশ্বর পরব্রহ্মের ধারণা ততদিনে সাধনদর্শনে অপরিহার্য হয়ে গেছে। তাই দ্বৈত মিলনাত্মক সাধনার ধারায় এই পরব্রহ্মকেই শিবরূপে ধারণা করা হল। এর মধ্যে কাশ্মীরের শৈবাগমের প্রভাব ছিল; কারণ অভিনবগুপ্ত ও অন্যান্য সাধকগণ পরমেশ্বর ব্রহ্মরূপ শিবতত্ত্ব ও তাঁর বিমর্শ মায়ারূপে মহামায়ার ধারণা অনেক পূর্বেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে শিব ও শক্তি দুই হয়েও এক। চণক(ছোলা) এর দুই বীজপত্রের মতো একে অপরের সান্নিধ্যে পরিপূর্ণ। শিব সেখানে শক্তির সাহচর্যে জগতের কার্য করেন। বাঙালির তন্ত্রেও এবার সেই ধারাটির অনুপ্রবেশ ঘটল। সেনযুগ পরবর্তী সময়ে কালীকুলের সাধনদর্শন এই রূপ: জগত সৃজনের জন্য ব্রহ্মে তাঁর স্বরূপীভূতা মায়ার আবির্ভাব ঘটে। অদ্বৈত বেদান্তমতের মতো এখানেও মায়াশক্তি আবরণ ও বিক্ষেপের মাধ্যমে বিবর্তের সৃষ্টি করেন। আবার সেই ব্রহ্মস্বরূপা মায়াশক্তিকেই মূলা প্রকৃতির সাথেও অভিন্ন বলা হয়েছে। অর্থাত কালীকুলে সাঙ্খ্যের সাথে বেদান্তের একটি সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা হয়েছে। এ এক আশ্চর্য স্ববিরোধিতা। যে কারণে আমরা দেখি একদিকে সর্বোল্লাস ও শাক্তানন্দ তরঙ্গিণীর মতো গ্রন্থের সূচনা হয়েছে প্রকৃতিকে ত্রিগুণের সাম্যরসরূপা আদি এবং নিত্যা বলে ঘোষণা করে; যেখানে শাক্তানন্দতরঙ্গিণীর রচয়িতা সাধক ব্রহ্মানন্দ নিত্যা শব্দটির অর্থ করেছেন: যে আদিমাতৃকা কালের অতীত এবং ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশেরও জননী; তিনিই নিত্যা। আবার অন্যদিকে কালীকুলেই বেদান্তের অনুরণন করে জীবন্মুক্তিকেই পরম লক্ষ্য বলা হয়েছে এবং তা সম্ভব হতে পারে শিবশক্তির সাম্যরসের অনুভূতিতে। এখানেই তন্ত্রের সেই অসঙ্গতির সূচনা; যাকে কটাক্ষ করে অনেক পরবর্তী সময়ে এন্টনি কবিয়াল গিয়েছিলেন:

যে শক্তি হইতে উৎপত্তি

সেই শক্তি তোমার পত্নী কি কারণ

কহ দেখি ভোলানাথ এর বিশেষ বিবরণ

শ্রীকুল বঙ্গদেশে অল্প প্রচলিত। এখানে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রাধান্য। এখানে শক্তি অনাদি অব্যয় অদ্বিতীয় পরমশিবের অভিন্ন নিত্যশক্তি বা স্পন্দস্বরূপা। শক্তির এই ধারণা বৈষ্ণবগণের রসরাজ কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি মহাভাবময়ী রাধারাণীর তত্ত্বের সাথে মিলে যায়।

সুতরাং কালীকুল ও শ্রীকুল উভয়ের ক্ষেত্রেই আদিশংকর ও তাঁর পরবর্তী সময়ের অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের ছাঁচে ফেলে তন্ত্রের একটি নব রূপায়ণ ঘটেছে। যদিও স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ তন্ত্রে তত্ত্ব ও সাধনা গ্রন্থে লক্ষ্য করেছেন: সাধক রামপ্রসাদ কমলাকান্ত রাজা রামকৃষ্ণ প্রমুখ অদ্বৈত বেদান্তমত কিম্বা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের পরিবর্তে শাক্তাদ্বৈতবাদী অর্থাত অদ্বৈতা মাতৃকার তত্ত্বকেই তাঁদের পদাবলীতে প্রকাশ করেছেন। কালী তাদের মননে ব্রহ্মের মায়াশক্তি নন; বরং নিজেই ব্রহ্ম। রামপ্রসাদের ভাষায়:

“কালী ব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্ম কর্ম সব ছেড়েছি”

দার্শনিক তত্ত্বে পরবর্তী সময়ের তন্ত্রের জগতে এই বিপুল পরিবর্তনের প্রভাব মূর্তিতত্ত্বেও পড়েছে। বর্তমানে দক্ষিণাকালীর যে ধ্যান আমরা পাই; কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ কালীতন্ত্র থেকে সেটি তন্ত্রসারে সংকলিত করেছিলেন। সেখানে কালী মহাকালের সাথে বিপরীতরতাতুরা। এখানেও ঐ পূর্বে আলোচিত শিবশক্তির মিলনাত্মক ভাবটিকেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অথচ কালীর প্রাচীন মূর্তিতত্ত্বের সাথে এই ধারণা একেবারেই মেলেনা। কালীর রূপকল্পের অনেকটাই যে মাতৃকার থেকে আহৃত সেই চর্চিকা ও নৈরাত্মা উভয়েই শবারূঢ়া। কখনও শবের উপর প্রত্যালীঢ় ভঙ্গিতে অবস্থিতা; কখনও শবদেহ তাঁর চরণতলে মর্দিত; কখনও শবদেহ তাঁর আসন। পালযুগের শেষদিকে চর্চিকার পদতলের শবটি কিছুটা শিবের আদিরূপ পেয়েছে। শব থেকে শবশিব আসবেন এই ধারাতেই। সেনযুগের কালীমূর্তি এবং রামকেলিতে আজও পূজিত গৌড়েশ্বরী মূর্তি দুটিই শবদেহের উপর দণ্ডায়মানা। এবং একটি লক্ষণীয় বিষয় হল মধ্যযুগের দার্শনিক ভাবনার পরিবর্তনে শাস্ত্রগত ধ্যানমন্ত্রে বদল এলেও আপামর বাঙালির উপাস্য মাতৃকার প্রতিমা এখনও ঐ আদিরূপের মতোই আছে। আজও আপামর বাঙালি মা কালীর যে মূর্তি উপাসনা করেন সেখানে মাতৃকা বিপরীতরতাতুরা নন; বরং শবশিবের উপরে দণ্ডায়মান। এই রূপটি সাঙ্খ্যের প্রকৃতির পদতলে নিষ্ক্রিয় পুরুষের আশ্চর্য রূপায়ণ; যাকে দেখে কখনও দাশরথি বলেছেন:

স্তম্ভিত পদে মহাকাল কম্পিতা ভয়ে মেদিনী

কখনও রামপ্রসাদ বলেছেন:

ঐ কামরিপু পদে এ কেমন কামিনী

কখনও কমলাকান্ত বলেছেন:

একি অসম্ভব ভব পরাভব পদতলে শবসদৃশ নিরব।

শবশিব তাঁদের সাধনদর্শনে ভবচক্রের প্রতীক। তাঁকে পরাভূত করে মাতৃকা ভবচক্রের গ্রাস থেকে সন্তানকে রক্ষা করেন। এই ভবভয়ঙ্করী রূপই পালযুগের চর্চিকা নৈরাত্মা ও মহাকালের মূল তত্ত্ব। মুণ্ডমালাতন্ত্রেও এই ভাবনার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। সেখানেও কালী “প্রত্যালীঢ়পদা ঘোরা” এবং তিনি ব্রহ্মা শম্ভু প্রমুখের শবগণের মধ্যে বিচরণ করেন (“প্রেতকোটিসমাযুক্তা”)।

মধ্যযুগের তন্ত্রভাবনার একটি প্রশংসনীয় দিক হল কালীর অগণিত সাধনক্রমের বিপুল অভ্যুত্থান। বজ্রযানে কালীর আদিরূপের আভাস থাকলেও তার বর্তমান রূপটি সহজ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সেনযুগ এবং তার পরবর্তী সময়েই পরিপূর্ণ বিকশিত হয়। দক্ষিণাকালী, বামাকালী, রক্ষাকালী, শ্মশানকালী, নির্বাণকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী প্রমুখ অগণিত রূপভেদ এই সময় সুপ্রচলিত হয়ে ওঠে। আবার সাধনমার্গ অনুযায়ী তাঁর বিদ্যারাজ্ঞী রূপের বিশদ ধারণাও এই সময়ের তন্ত্রে বিশদে বর্ণিত। আবার কাশ্মীরের তন্ত্রধারা থেকেও কালীর বেশ কয়েকটি রূপ এই সময় কালীকুলে গৃহীত হয়; যাঁদের বিশদ উল্লেখ অভিনবগুপ্তের তন্ত্রালোকে পাওয়া যায়। কালীর সাথেই দ্বিতীয় যে মাতৃকা এই সময় প্রাধান্য পান তিনি হলেন তারা। তবে তারার যে সুবিশাল সাধনক্রম পঞ্চ তথাগতের কুলেই প্রচলিত ছিল তাদের অধিকাংশই অপ্রচলিত হয়ে শুধুমাত্র অক্ষোভ্যকুলের একজটা, মহাচীনাচারতারা ও উগ্রতারা রূপ তিনটিই তন্ত্রে বিদ্যমান থাকে। এইটি মধ্যযুগের তন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। মধ্যযুগ বাঙালির জাতীয় জীবনের ক্রান্তিকাল। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহিঃশত্রুর সাথে নিয়ত সংঘর্ষরত বাঙালির কাছে এই সময় মাতৃকার ভয়ঙ্করী ভয়হারিণী রিপুদলনী রূপটিই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। যেহেতু সহজ আন্দোলনের সময়ে উড্ডিয়ানে প্রবর্তিত সাধনক্রমে আরাধিতা মাতৃকাগণের সাধারণ বৈশিষ্ট্যই এইটি; তাই অক্ষোভ্যকুলের মাতৃরূপই নানা বিবর্তনের মাধ্যমে এই সময় তন্ত্রের প্রধান অন্বিষ্ট বিষয়। এই কারণেই মধ্যযুগের তন্ত্রে কালীর মধ্যে অবলীলায় মিশে গেছেন চর্চিকা, নৈরাত্মা, পর্ণশবরী, বজ্রযোগিনী, বজ্রবর্ণিনী, বুদ্ধডাকিনী। মহাকাল কিছুটা রূপান্তরিত হয়ে আজও আছেন। কুল্লা, কুরুকুল্লা প্রমুখ কালীর পঞ্চদশ নিত্যার অন্তর্গত হয়েছেন।

এমনকি সুদূর অতীতের পক্ষীমাতৃকার স্মৃতিবাহী বলাকিনী মাতৃকাও কালীর দ্বাদশ নিত্যা রূপে পরিগণিত হয়েছেন। তাঁদের সকলেরই রূপ একান্তভাবেই উড্ডিয়ানে প্রবর্তিত সাধনক্রমের সাথে সম্পর্কিত। তাঁরা সবাই নীলবর্ণা, খড়্গধারিণী, মুণ্ডমালিনী, অট্টহাস্যরতা, দিগম্বরী। বজ্রযানের স্মৃতি হিসেবে মাতৃকার মণ্ডলে ডাকিনী, যোগিনী, যক্ষ, বটুক, বেতালদের উপাসনাও অব্যাহত থেকে যায় মধ্যযুগে।

অন্যদিকে বজ্রযোগিনীর সাধনক্রমই আবার ছিন্নমস্তা প্রচণ্ডচণ্ডিকার সাধনমার্গ নির্মাণ করেছে। দুইপাশে ডাকিনী ও বর্ণিনীকে নিয়ে মিলনরত যুগলের উপর নৃত্যরতা মাতৃকার যে রূপটি নাঢ়া নাঢ়ীর দ্বৈতরহিতা মাতৃকার তত্ত্বের মূল ভাবনার  সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল; সেই রূপটিই আজও ছিন্নমস্তার সাধকগণ ধ্যান করেন। আজও তন্ত্রের ধারায় কালী তারা ও ছিন্নমস্তা এই তিন মাতৃকাই সর্বাধিক জনপ্রিয়।

মধ্যযুগের তন্ত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল দশমহাবিদ্যার সাধনক্রমের উত্থান। দশমহাবিদ্যার ধারণা সেনযুগ থেকেই জনপ্রিয় হচ্ছিল। মধ্যযুগে তার চরম সমৃদ্ধি ঘটে। কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী ও কমলার উপাসনা আজকের তন্ত্রের সিংহভাগ অধিকার করে আছে। এর মধ্যে বগলামুখী, ছিন্নমস্তা প্রমুখের সাধনক্রম বেশ প্রাচীন। এঁদের কিছু নাম যেমন তন্ত্রের আদিরূপের ইঙ্গিত দেয় ( বগলামুখী>বকের মতো মুখ, পক্ষীমাতৃকার স্মৃতিবাহী); অন্যদিকে ব্রহ্মযামল, রুদ্রযামল প্রভৃতিতে উল্লিখিত কয়েকটি স্তব ও কবচ খুব সম্ভবত মাৎস্যন্যায়ের অরাজক অবস্থার স্মৃতি বহন করে। তবে শ্রীকুল ও কালীকুলের বিভিন্ন ধারা থেকে এই দশজন মহাবিদ্যার একত্র সমাবেশ সেনযুগ ও তার পরবর্তী সময়ের তন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য।

এই সময় মাতৃকার বর্ণাত্মিকা রূপের উত্থান এক অসাধারণ এবং সুমধুর বৈশিষ্ট্য। ললিতবিস্তার গ্রন্থে বাঙালির প্রাচীনতম লিপিকে (অনামা লিপি; বঙ্গলিপি) তন্ত্রের প্রতীক বলা হয়েছে। বাঙালির সেই সুপ্রাচীন লিপির প্রতিটি বর্ণই সম্ভবত মাতৃকার এক একটি মূর্তির চিত্ররূপ। আমরা দেখেছি আদি ব্রাহ্মী লিপির ক অক্ষরটি পাণ্ডুরাজার ঢিবির পক্ষীমাতৃকার আকৃতির সাথে চমৎকার সাযুজ্য বহন করে। পরবর্তী সময়েও এই কারণেই বর্ণকে মাতৃরূপে আরাধনা করার রীতিটি প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগে সেই ভাবনার আশ্চর্য বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। মা কালীর মূর্তির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে তন্ত্রে বলা হয়েছে : মায়ের কন্ঠের মুণ্ডমালার পঞ্চাশটি মুণ্ড পঞ্চাশটি বর্ণের প্রতীক। রামপ্রসাদের গানে:

যত শোনো কর্ণপুটে সবই মায়ের মন্ত্র বটে

কালী পঞ্চাশত বর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে

কিম্বা কমলাকান্তের গানে:

আদিভূতা সনাতনী শূন্যরূপা শশিভালী

ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি

সেই বর্ণাত্মিকা মাতৃকার তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তন্ত্রের মাতৃকান্যাসে আজও বর্ণাত্মিকা মাতৃকাকে ধ্যান করা হয়।

(পঞ্চাশল্লিপিভির্বিভক্তমুখদপন্মধ্যবক্ষস্থলাম্)

বর্ণসমূহ সেখানে নাদতত্ত্বের রূপ; যা কুণ্ডলিনী শক্তির পরা, পশ্যন্তি ও বৈখরী গতির বাহ্যরূপ। নাদরূপ বীজকেই একাক্ষরী বর্ণের আকারে ধ্যান করে পরাশক্তির কৃপালাভ করা সম্ভব। এই ভাবনা সহজযানের বীজ ও ধারণীর সাথে চমৎকার সাযুজ্য বহন করে। সুকঠিন তত্ত্বের পরিবর্তে একটিমাত্র বর্ণকে বীজরূপে জপ করার এই রীতিটি নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের নামব্রহ্মের তত্ত্বও এই ধারা থেকেই আগত। তন্ত্রে বিভিন্ন জটিল আচারকে তুচ্ছ করে এই বর্ণময়ী মাতৃকার নাম জপকেই প্রধান বলে ঘোষণা করার যে উদারতা আছে; তাকেই সগৌরবে কমলাকান্ত প্রকাশ করেছেন তাঁর পদে:

নামেরি ভরসা কেবল শ্যামা গো তোমার

কাজ কি আমার কোশাকুশি দেঁতোর হাসি লোকাচার

মধ্যযুগের তন্ত্রের এই উৎকৃষ্ট দিকগুলির পাশাপাশি যে দুর্বলতাসমূহ আছে; তাদের একটি হল বাঙালির তন্ত্রধারার নিজস্ব স্বকীয়তার পরিবর্তে কাশ্মীরী ও দাক্ষিণাত্যের ধারাগুলিকে সেখানে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তত্ত্বের দিক থেকে যেমন পাল ও সেনযুগের বাঙালির সাধনদর্শন অনেকটাই অবহেলিত; কাশ্মীরী শৈবাগম ও দক্ষিণে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের গুরুত্ব অনেক বেশি; সাধনক্রমের ক্ষেত্রেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। এর সবথেকে বড়ো দৃষ্টান্ত মধ্যযুগের তন্ত্রে দশভুজা দুর্গার সাধনক্রম। তন্ত্রে দ্বিভুজা, চতুর্ভুজা, অষ্টভুজা, ষোড়শভুজা মহিষমর্দিনী দুর্গার সাধনক্রম যতটা গুরুত্ব পেয়েছে; দশভুজার সাধনক্রম ততটা নয়। অথচ সেনযুগের মৎস্যসূক্তে দুর্গার দশভুজা রূপটিকেই বঙ্গভূমির জন্য সুপ্রশস্ত বলে শাস্ত্রীয় মান্যতা দেওয়া হয়েছিল। দুর্গার সাথে চার সন্তানের মণ্ডলটিও সেখানে উল্লিখিত। অথচ কেবল কালীবিলাসতন্ত্র ও মহাকালসংহিতা ছাড়া দুর্গার দশভুজা রূপের তন্ত্রোক্ত সাধনক্রম প্রায় অপ্রচলিত। আবার মা দুর্গার শরতকালীন উপাসনার সুপ্রাচীন ধারাটিকে এই সময়েই অর্বাচীন কাহিনীর ভিত্তিতে অকাল বোধনের তকমা দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগের দাবি রাখে। পাল ও সেনযুগে বাঙালির তন্ত্র একটি সার্থক গণধর্ম হতে পেরেছিল কারণ সেখানে বাঙালির ধর্মভাবনার নিজস্ব বিশিষ্টতা সাদরে গৃহীত হয়েছিল। মধ্যযুগের তন্ত্রের ধারা সেই বিষয়ে বড়োই উদাসীন।

মধ্যযুগের তন্ত্রের একটি দুঃখজনক বৈশিষ্ট্য হল গুহ্যাচারের প্রাবল্য। উৎকৃষ্ট সাধনদর্শন যখন মুষ্টিমেয় সাধক পরম্পরার কুক্ষিগত হয়ে যায়; তখনই গণধর্ম বিনষ্ট হয়। জাতীয় জীবন শিকড়বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আজ যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি তন্ত্রের বিষয়ে মারাত্মক অজ্ঞতা পোষণ করেন; মাতৃকার উপাসনার চিন্তায় ভক্তির থেকে ভয় বেশি পান; তার কারণ এই গুহ্যাচারের প্রাদুর্ভাব। কিছু অপ্রয়োজনীয় কঠোর নিয়মের শৃঙ্খলে সহজ ধর্মভাবনাকে আবদ্ধ করার ফলেই তন্ত্রের সাথে সমাজের বৃহত্তর অংশের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। আর দীর্ঘদিন সমাজবিচ্ছিন্নতার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম অনাচার ও কদাচারের প্রাবল্য। পালযুগের আগে মাৎস্যন্যায়ের সময়ে কামাচার অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। পালযুগে মহেন্দ্রপালের মৃত্যুর পর থেকে মহীপালের সময়ের আগে পর্যন্ত বজ্রযানে অধঃপতনের বীজ প্রবেশ করেছিল। নাঢ়া নাঢ়ীর নেতৃত্বে সিদ্ধাচার্যগণের সহজ আন্দোলন তার অবসান ঘটিয়েছিল। কিন্তু সেনযুগের পর থেকে একটিও শাক্ত গণ আন্দোলন ঘটেনি। কৌলাচারের সেই সুপ্রচলিত বাক্যটি এই প্রসঙ্গে লক্ষণীয়।

অন্তর্শাক্ত বহির্শৈব সভায়াং বৈষ্ণব মতঃ।

মধ্যযুগের তন্ত্রে সার্বজনীন বন্দনার পরিবর্তে গুরুত্ব পেয়েছে রহস্যপূজা। মাতৃকার সাধনক্রমের মধুরতার পরিবর্তে প্রতিটি সাধনক্রম কতটা ভয়ানক; সামান্যতম ত্রুটিতেও কি ভয়ঙ্কর সর্বনাশ নেমে আসতে পারে; তার ঢক্কানিনাদ এই সময়ের সমস্ত তন্ত্রশাস্ত্রের একটি ধ্রুব বৈশিষ্ট্য। এর বিষময় পরিণাম এই হয়েছে যে ভারতের প্রধানতম মাতৃকা উপাসক মহাজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আজ মাতৃপূজার রীতি ও গুরুত্ব বিষয়ে কিছুই জানেন না। আজও যে তন্ত্রের দেবীগণকে অতি সহজেই অপশক্তি বলে অপপ্রচার করে দেওয়া যায়; তন্ত্রের নামে অযোগ্য সাধকরা যথেচ্ছ কদাচার করতে পারে; তার জন্য প্রধান দোষী শাক্তধর্মের এই অপ্রয়োজনীয় গুহ্যাচার। আজও শাক্তধর্মের সুমহান ধারাটি কয়েকটি সাধক পরম্পরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। চৈতন্যযুগের সাহিত্যিক নিদর্শন থেকে তৎকালীন গুহ্যাচারের কিছু অনিষ্টকর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় এই সময়েরই কামবজ্রযানের প্রমাণ পেয়েছেন কিছু পুঁথিতে। বজ্রযান ও সহজযানের উৎকৃষ্ট তত্ত্বসমূহকে বিকৃত করে এই কামবজ্রযান উৎকট লালসাকেই পরম প্রাপ্তি বলে মনে করত। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঙালির তন্ত্রে এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: “দেহসৃষ্টি এবং বিশ্বসৃষ্টি একই পদ্ধতিক্রমে হইয়াছে, এই সাধারণ সিদ্ধান্তটা বা generalisation বৌদ্ধতান্ত্রিকগণ কামবজ্রযান নাম দিয়া একটা উপাসক সম্প্রদায় গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। যখন পাঠানগণ এদেশে প্রথম আগমন করেন, তখন বাঙ্গালায় এই সম্প্রদায়ের সাধকদিগের বেজায় প্ৰাবল্য ছিল। মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত শ্ৰীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় এই সম্প্রদায়ের প্রচলিত দুই চারিখানি তন্ত্রগ্রন্থ খুঁজিয়া পাইয়াছেন। সে সকল গ্ৰন্থ সাধারণ্যে প্ৰকাশ করিবার যোগ্য নহে, উহা এতই কুৎসিত ক্রিয়াকাণ্ডের বর্ণনায় পূর্ণ। তাঁহাদের মত এই যে, মনুষ্যদেহ যেমন কামের সাহায্যে সৃষ্ট বা উৎপন্ন, বিশ্বসৃষ্টি ও তেমনি কামের সাহায্যে সৃষ্ট বা উৎপন্ন কামে যেমন রেতঃস্খলন হয় এবং রজঃ ও রেতের সম্মেলনে জীবের সৃষ্টি হয়, তেমনি বিশ্বসৃষ্টি শক্তিসমন্বিত শিবলিঙ্গের রেতঃস্খলন হইতে উৎপন্ন। এই হেতু বিশ্বসৃষ্টিকে তন্ত্রে বিস্মৃষ্টি বা discharge বলিয়াছে। অর্থাৎ কামান্ধ বিশ্বব্যাপী আত্মা হইতে এই বিশ্বসৃষ্টি একটা স্খলন বা বিস্মৃষ্টি মাত্র। এই সম্প্রদায়ের তান্ত্রিকগণের মত এই যে, যেমন যুবক যুবতী সদা রিরাংসায় পূর্ণ থাকে, তেমনি বিশ্বব্যাপী শিব ও শক্তি সদাই নিত্য নব সৃষ্টির জন্য রিরংসায় পূর্ণ। তাঁহাদের নিত্য সম্মেলনে ক্ষণে ক্ষণে বিস্মৃষ্টি হইতেছে, ফুটিতেছে, উঠিতেছে, ডুবিতেছে, শুকাইতেছে। বিশ্বসৃষ্টির রিরংস এবং জীবদেহগত রিরংসার সামরস্য ঘটাইতে পারিলেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করা যাইতে পারে। ইহারা তাই সদাই কামসাধনা করিত। ইহাদের অত্যাচারের প্রভাবে জাতিটা একেবারেই নিবীৰ্য হইয়া পড়িয়াছিল। সাধনার দোহাই দিয়া ইহারা নির্লজ্জভাবে সমাজের সর্বাঙ্গে কামের প্রকট বিকাশ ঘটাইত। মন্দিরে, মাঠে, দেবায়তনে, সর্বত্রই রিরংসার ছবি অঙ্কিত করিয়া রাখিত। বিরূপাক্ষ নামের একজন হিন্দু তান্ত্রিক চৈতন্যদেবের সমসময়ে সাধনার প্রভাবে অনেক দেবদেবীর বিগ্ৰহ ফাটাইয়া দিয়াছিলেন। প্ৰবাদ এই ছিল যে, যে দেবদেবীর মধ্যে দৈব ভাবনা থাকিত, সে দেবদেবীকে বিরূপাক্ষ সাষ্টাঙ্গে প্ৰণাম করিলে তাহা ফাটিয়া যাইত। তাই কথা প্রচলিত ছিল যে, ‘কালাপাহাড়ের ফাট আর বিরূপাক্ষের ফাট’ অর্থাৎ কালাপাহাড়ের তলোয়ারের চোট এবং বিরূপাক্ষের বিগ্ৰহ ফাটাইবার প্রভাব, দুই দুনিবাৰ্য্য ছিল। মোট কথা, এই বিরূপাক্ষ এই কামচক্রযানীদের বাঙ্গালা হইতে সমূলে নির্মূল করিয়াছিলেন।”

এই সময়ের গুহ্যাচারীদের সাথে প্রায়শই তুর্কি পাঠান শাসকবর্গের সুদৃঢ় আঁতাতের অগণিত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। শাক্ত তান্ত্রিক জগাই মাধাই নবদ্বীপে গৌড়ের সুলতানের নগরকোটাল ছিলেন। মধ্যযুগে ইসলামিক মৌলবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ যে গণ আন্দোলন করতে সক্ষম হয়েছিলেন; তার সমতুল্য কোনো প্রতিরোধ শাক্তধর্ম যে গড়ে তুলতে পারেনি তার প্রধান কারণ এই। এই সময় শাক্তরা গুহ্যাচারে আসক্ত। ফলে গণধর্মের গুরুত্ব বিষয়ে অনভিজ্ঞ। নয়তো তাঁরা তুর্কি পাঠান শাসকের বৃত্তিভোগী। এই সত্য যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বাঙালির গণধর্ম থেকে বিচ্যুতি সর্বদাই বাঙালির শত্রুদের হাত শক্ত করেছে। এবং মধ্যযুগের শেষভাগে প্রতাপাদিত্য, চাঁদ রায়, কেদার রায় প্রমুখ যে শাক্ত রাজন্যবর্গ বাঙালির বাহুবলের পুনরুদ্ধার করেছিলেন; তাঁরা সকলেই নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর নেতৃত্বে গণধর্মের পুনরুজ্জীবনের পরবর্তী সময়ের এবং প্রমাণ করা যায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন থেকেই তাঁরা শাক্তধর্মের পুনরুজ্জীবনের শক্তি পেয়েছিলেন।

সমাজভাবনার ক্ষেত্রে মধ্যযুগের তন্ত্রের একটি আশ্চর্য চিত্র পাওয়া যায়। এখানে একই গ্রন্থে চরম উৎকৃষ্ট ও চূড়ান্ত নিকৃষ্ট চিন্তাধারা অবলীলায় সহাবস্থান করেছে। মহানির্বাণতন্ত্র এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এখানে মা কালীর কৃষ্ণবর্ণের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে সমস্ত বর্ণের সংমিশ্রণে কৃষ্ণবর্ণ পাওয়া যায়। আবার কোনো বর্ণই যেখানে নেই সেটিও কালো বলে মনে হয়। তেমনি জগতের সমস্ত কিছুর উদ্ভব ও লয় হয় আদিমাতৃকার থেকে। তাই তাঁর কালো রঙ। এই ব্যাখ্যা অত্যন্ত মধুর সন্দেহ নেই। অথচ সেই মহানির্বাণতন্ত্রেই সামাজিক বিধান প্রসঙ্গে চরম রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি ধর্ষণ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে ধর্ষিতা নারীকে নির্বাসন দণ্ডদানের বিধান পর্যন্ত আছে। মাতৃতান্ত্রিক বাঙালির সমাজভাবনার কত দূর অধঃপতন ঘটলে তন্ত্রে এমন বিধানের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এবং ধর্মের কাঠামো কতটা বিশৃঙ্খল হলে দুগ্ধ ও গোমূত্রের এমন সহাবস্থান ঘটানো যায় সেটাও বেশ বোধগম্য হয়।

তন্ত্রে বর্ণবাদের অনুপ্রবেশ মধ্যযুগের আরেকটি কলঙ্কিত সত্য। যে তন্ত্র বাঙালির আদি সমাজভাবনার ধারক; কুল ও শীলের ভিত্তিতে কর্মানুযায়ী জাতির যে ধারণা অবৈদিক ব্রাত্য পরিমণ্ডলে গড়ে উঠেছিল; তাকে মধ্যযুগের স্মৃতিশাস্ত্রকারগণ জোর করে চতুর্বর্ণের আওতায় আনতে গিয়ে বাঙালির জাতীয় জীবন বিপন্ন করেছিলেন। তন্ত্রেও এই সময় বিভিন্ন সাধনক্রমের ক্ষেত্রে বর্ণগত বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। কোথাও কোথাও আবার নীতিগত ভাবে সুবিধাবাদী ধূর্ততার অন্তরাল নেওয়া হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে চক্রসাধনার কালে বর্ণগত কোনো নিষেধ নেই; কিন্তু চক্রের বাইরে সামাজিক জীবনে বর্ণাশ্রম অবশ্যই মানতে হবে। নারীদের সাধনগত বিভিন্ন সীমাবদ্ধতাও এই সময়ে আরোপিত হয়েছে। বল্লালের সময় তান্ত্রিক স্মৃতিসমূহকে অবলম্বন করে উদার সমাজভাবনার বলিষ্ঠ প্রকাশ রূপে নির্মাণের যে চেষ্টা শুরু হয়েছিল; সেন পরবর্তী যুগে তা অনেকাংশেই বিপর্যস্ত।

শুধু সমাজভাবনার ক্ষেত্রে নয়; মধ্যযুগের তন্ত্রে বিভিন্ন স্থানে আদিপর্বের উদার ও সহজ মননের পথ পরিহার করে অকারণ জটিল পন্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে সার্বজনীন উপাসনার স্থান প্রায় নেই। যদিও দক্ষিণাকালীর উপাসনা আগমবাগীশ ও অন্যান্য শাক্ত সাধকদের প্রচেষ্টায় সকলের গৃহে অনুষ্ঠিত হওয়ার মান্যতা পেয়েছে; তবু আজও কালীপুজোর বিধি সুকঠিন সাধনক্রমের সংকলন মাত্র। যা নিজ হাতে সম্পন্ন করা অধিকাংশ বাঙালির সাধ্যের বাইরে।

এই সময়ে তন্ত্রের তত্ত্বসমূহের পৌরাণিক ব্যাখ্যাগুলিও রীতিমত চমকপ্রদ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাচীন পরম্পরার বিষয়ে নূন্যতম ধারণা না রেখে; বৈদিক ধারার তথাকথিত মহত্ত্ব প্রতিপাদনের লক্ষ্যে চরম অনৈতিহাসিক কাহিনীর উদ্ভব ঘটেছে এই সময়ের পুরাণ সাহিত্যে। আদ্যা নিত্যা জগতমাতৃকার উপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কয়েকটি ভ্রান্ত সংস্কার আরোপ করে; কখনও তাঁর লীলা সমূহের অপব্যাখ্যা করে তন্ত্রের আদি শিকড়টিকেই দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। সেনযুগের বাঙালি কবি সদুক্তিকর্ণামৃতে লিখেছিলেন : নন্দী শিবের সংসার নিয়ে বড়োই চিন্তিত। কারণ কখন ক্রুদ্ধা চর্চিকা শিবকে গ্রাস করেন তার নিশ্চয়তা নেই। এর তাৎপর্য হল আদিমাতৃকা যেহেতু স্বয়ং একাকিনী; জগতের সৃষ্টি ও লয়ের একমাত্র হেতু। তাই তাঁর উপরে সংসার ও পতিকল্পনার আবরণ দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় না। প্রাচীন যুগেও শক্তির সংসার কল্পনা আছে। কিন্তু শক্তি ও আদিমাতৃকা এক নন। মাতৃকা থেকেই পুরুষ বা শক্তিমান ও নারী বা শক্তির উদ্ভব; এবং তাঁদের যুগল রূপের বিভিন্ন মধুর লীলাকল্পনা সাধনদর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বৈষ্ণবগণের যুগল উপাসনা, বজ্রযানের যুগনদ্ধ সাধনা, শশাঙ্কের শিব ও নীলাবতীর বিবাহ তারই নিদর্শন। অথচ মধ্যযুগের তন্ত্রে আদি জননী ও তাঁর অংশরূপা শক্তির বিষয়ে পৌরাণিক চিন্তায় কোনো ভেদ নেই। সেখানে মাতৃকা নিজেই কখনও সতীনের সাথে কোন্দল করছেন; কখনও শিবের মুখে কালো রঙের নিন্দা শুনে গৌরবর্ণা হওয়ার প্রচেষ্টা করছেন। দশমহাবিদ্যাগণের উদ্ভবের কয়েকটি কাহিনী এবং কালিকাপুরাণের মহিষাসুর বধের কাহিনীও এই বিষয়ে সার্থক দৃষ্টান্ত।

মধ্যযুগের শাক্তধর্মের দিকে তাকালে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়। এর একটি ধারা অত্যন্ত জটিল; গুহ্যাচারে আচ্ছন্ন। অন্য ধারাটি সর্বসাধারণের বোধগম্য; সরল ও মধুর। শাক্ত পদকর্তাগণ এই দ্বিতীয় ধারার ধারক এবং বড়ো অক্লেশে তাঁরা অতীতের সহজ আন্দোলনের উত্তরাধিকার মধ্যযুগের ক্রান্তিকালে লাভ করেছেন। রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তের কয়েকটি পদের ভাব ও ভাষা সহজযানের চর্যাপদের সাথে আশ্চর্য সাদৃশ্য বহন করে। “এবার ভালো ভাব পেয়েছি” পদটি এই বিষয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

সাদৃশ্য আছে বৈষ্ণবগণের প্রেমধর্মের সাথেও। 

“এ শরীরে কাজ কি রে ভাই দক্ষিণা প্রেমে না গেলে” পদটি লক্ষণীয়। এখানে রহস্যপূজার আবরণ নেই। অধিকার অনধিকারের সীমা নেই। এখানে মায়ের ভক্ত মাত্রেই সগৌরবে মরণভয় তুচ্ছ করে বলতে পারেন:

দূর হয়ে যা যমের ভটা আমি ব্রহ্মময়ীর বেটা

বর্ণবাদকে হেলায় উড়িয়ে আমরা বলতে পারি:

ছুঁয়ো না শমন আমার জাত গিয়েছে

যেদিন কৃপাময়ী আমায় কৃপা করেছে

দুর্ভাগ্যবশত অত্যন্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই দ্বিতীয় ধারাটি শাক্তধর্মের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে নি আজও।

এই প্রসঙ্গে মধ্যযুগের একেবারে প্রথম দিকে আবির্ভূত সর্বানন্দ ঠাকুরের জীবনী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মহাসাধক সর্বানন্দ কি চুরাশি সিদ্ধাচার্য পরম্পরার অন্তর্গত? আপাতভাবে উত্তর হবে; না। কারণ সিদ্ধাচার্য পরম্পরা তো তখন লুপ্ত।

ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী গুপ্তোত্তরযুগ থেকে সিদ্ধাচার্য পরম্পরার সূচনা। মাৎস্যন্যায় পর্বে কাহ্নুপা ও নাগার্জুন বিদ্যমান ছিলেন। এরপর সমগ্র পাল ও সেনযুগে তাঁদের পরম্পরা সগৌরবে বিদ্যমান এবং বিশেষ করে এর চূড়ান্ত প্রাবল্য এসেছিল দশম শতকে মহীপালের সময়ে নারোপা ও নিগু ডাকিনীর আবির্ভাবের পর থেকে। সিদ্ধাচার্যগণের প্রবর্তিত সহজযান(যাকে সহজ আন্দোলন বললেই বোধহয় যথার্থ বলা হয়) এই সময়েই সমগ্র বৃহৎ বঙ্গের তন্ত্রের প্রধানতম ধারা। কিন্তু ত্রয়োদশ শতকে তুর্কি আক্রমণের সূচনাকাল থেকে অধিকাংশ সহজযানী সাধক সাধিকা হয় তিব্বতে বা নেপালে চলে যান। নয়তো সহজিয়া বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্মে সম্মিলিত হয়ে যান। সেনযুগ থেকেই সহজযান নামমাত্র বৌদ্ধ বহিরঙ্গ রেখে কার্যত তন্ত্রের আদিতম ধারাটির নবরূপ হয়ে উঠেছিল। এই সময় চর্যাপদে পরমা মাতৃকা ডোম্বী, চণ্ডালী, শবরী, শুণ্ডিনী রূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ডোম্বী, রজকিনী, চণ্ডালিনী, নটিনী ও ব্রাহ্মণী এই পঞ্চ কুলের সাধনা অত্যন্ত সমাদৃত হয়ে উঠেছে। এই সময় তারাস্তোত্রে তারা গৌরী, মঙ্গলা, মনসা ও গায়ত্রীর সাথে একাকার হয়ে বিশ্বমাতা রূপে বন্দিত হয়েছেন। আবার সহজিয়াদের আদিরসিক কবিপতি জয়দেব এই সময়েই রচনা করেছেন মধুরকোমলকান্ত পদাবলীর কাব্য গীতগোবিন্দ। এই সুমধুর পরম্পরা যে মধ্যযুগেও বাঙালির ধর্মভাবনায় ক্রিয়াশীল ছিল তার অগণিত প্রমাণ আছে। সহজযানীদের উপাস্য দেবী বাশুলিচণ্ডীর উপাসক চণ্ডীদাস রামী রজকিনীর সাথে সাধনা করতেন বলে প্রসিদ্ধি আছে। নীহাররঞ্জন মহাশয়ের মতে এই রজকিনী সাধনা বাস্তবে সহজযানের পঞ্চকুলের অন্যতম রজকিনীকুলের সাধনা। এছাড়া গৌরনিতাই এর বৈষ্ণব আন্দোলনের মধ্যে বারবার সহজযানের ধারাটিকে খুঁজে পাই আমরা। নিত্যানন্দ মহাপ্রভু স্বয়ং অবধূতশ্রেষ্ঠ ছিলেন। আর আমরা জানি অবধূতী মার্গের সাধনা কৌল নাথপন্থা ও সহজযান উভয়েরই এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য। মা কালীর রূপকল্পের মধ্যে মিশে আছেন নৈরাত্মা, চর্চিকা ও বজ্রযোগিনী। লম্বোদর শ্মশ্রুযুক্ত শিবের ধারণার পিছনে মহাকালের রূপকল্পের অবদান আছে। এরকম অগণিত উদাহরণ দেওয়া যায়।

আবার সেনযুগের সুদীর্ঘ পাঁচশো বছরেরও বেশি সময় পরবর্তী শাক্ত পদকর্তা রামপ্রসাদের পদে সহজযানের সন্ধ্যাভাষার আশ্চর্য নিদর্শন দেখতে পাই। যেমন:

যে দেশে রজনী নাই সেই দেশের এক লোক পেয়েছি

আমার কিবা সন্ধ্যা দিবা সন্ধ্যা সন্ধ্যারে বন্ধ্যা করেছি

ঘুম ভেঙেছে আর কি ঘুমাই যুগে যুগে জেগে আছি…

কিম্বা

সে নৃত্যকালী কি অস্থিরা কেমন করে তায় রাখিব

মনোবাদ্যযন্ত্র করি হৃদিপদ্মে নাচাইব

এই পদটিকে যদি তুলনা করি নিচের চর্যাপদটির সাথে:

এক সো পদুম চোষট্টি পাখুরি

তঁহি চড়ি নাচত ডোম্বী বাপুড়ী

তাহলে বেশ বোঝা যায় বাঙালির মধ্যযুগের শাক্ত ও বৈষ্ণব উভয় ধারার মধ্যেই সহজযানের একটি অন্তঃসলিলা প্রবাহ নিরন্তর বহমান ছিল। কিন্তু এ কথাও সত্য যে সহজযানে মহাসিদ্ধ যাঁদের বলা হত তাঁদের মূল পরম্পরাটি এই সময় পাওয়া যায় না। তাহলে সাধকশ্রেষ্ঠ সর্বানন্দকে সিদ্ধাচার্য পরম্পরার সাথে যুক্ত বলে ভাবব কেন?

তার কারণ তাঁর জীবনকাহিনীর সাথে চুরাশি সিদ্ধগণের কাহিনীর আশ্চর্য সাদৃশ্য বিদ্যমান।

মহাসাধক সর্বানন্দের আবির্ভাব বর্তমান বাংলাদেশের চাঁদপুরের নিকটবর্তী মেহারে। তাঁর সম্বন্ধে কাহিনীটি সংক্ষেপে এইরকম:

তিনি এই জন্মের সাত জন্ম আগে থেকে মাতৃসাধক। বিভিন্ন জন্মে কখনও নীলাচলে, কখনও কাশীর গঙ্গায় কখনও বদ্রিনাথে কখনও কামরূপে মাতৃসাধনা করতে করতে জীবন ত্যাগ করেছেন। আবার পুনর্জন্ম নিয়েছেন মাতৃসাধনার মাধুর্য আস্বাদন করতে। এই ভাবনার সাথে চমৎকার সাদৃশ্য পাই অবলোকিতেশ্বরের নির্বাণ প্রত্যাখ্যানের; শ্রীচৈতন্যদেবের মোক্ষাভিলাষের ঊর্ধ্বে অপ্রাকৃত প্রেমতত্ত্বের ঘোষণায়; এমনকি সাধক রামপ্রসাদের পদে:

নির্বাণে কি আছে ফল জলেতে মিলায় জল

চিনি হওয়া ভালো নয় মন চিনি খেতে ভালোবাসি

সাতজন্মের প্রসঙ্গটিও তান্ত্রিক তাৎপর্য বহন করে।

আবার তীর্থ থেকে তীর্থান্তরে মাতৃসাধনায় বারংবার ব্রতী হওয়ার বিষয়টি মনে করিয়ে দেয় তারাসিদ্ধ বশিষ্ঠ মুনির কথা। আমরা জানি তিনি পালযুগের বজ্রযানের সাধক ছিলেন এবং সিদ্ধাচার্য পরম্পরাতে নাম না থাকলেও সেই পরম্পরার সমকালেই বিদ্যমান ছিলেন। বশিষ্ঠ মুনি যখন তারাদেবীর চীনাচারক্রমের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছেন; সাধক অট্টহাস যখন দন্তুরা চর্চিকার সাধনা করছেন; সেই সময়েই তিলোপার শিষ্য নারোপা বজ্রযোগিনীর সাধনক্রমের মাধ্যমে সহজযানের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। তাই সিদ্ধাচার্য পরম্পরার সমতুল্য কিংবদন্তি তাঁর জীবনকাহিনীতেও পাওয়া যায়।

মেহারে সাধক সর্বানন্দের জন্ম সম্ভবত চতুর্দশ শতকের শেষদিকে। শোনা যায় তিনি যৌবন অবধি শাস্ত্রজ্ঞানহীন মূর্খ ছিলেন। তাঁর সুপণ্ডিত দাদা সেজন্য চরম তিরস্কার করলে ভৃত্য পূর্ণানন্দের সাথে মনের দুঃখে তিনি গৃহত্যাগ করেন। তারপর আচম্বিতে পূর্বস্মৃতি জাগ্রত হয়। লিখতে শেখার জন্য একটি তালগাছে উঠে হঠাৎ এক ভীষণ সর্প দেখেও ভীত না হয়ে দৃঢ়ভাবে সাপটিকে মুঠিতে ধরে তালপাতায় তার মাথা কেটে ফেলেন। পূর্বজন্মে স্বহস্তে লেখা মাতৃকার বীজ লাভ করে শবসাধনায় ব্রতী হন। শবদেহের জোগান দিতে ভৃত্য পূর্ণানন্দ নিজে আত্মত্যাগ করেন। তাঁর সাধনায় মাতৃকা প্রসন্ন হন এবং দশমহাবিদ্যার সমস্ত রূপে তাঁকে দর্শনদান করেন। পূর্ণানন্দ প্রাণ ফিরে পান। সর্বানন্দ ঠাকুরের সাধনপরম্পরা পরিচিত হয় সর্ববিদ্যার বংশ নামে। তিনি মাতৃকার কৃপায় বাকসিদ্ধি ও মহাজ্ঞানের অধিকারী হন। এ বিষয়ে কিছু তথ্য শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় উল্লেখ করেছেন ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য গ্রন্থে। কিছু তথ্য পাই তাঁর পুত্র শিবনাথের সর্বানন্দতরঙ্গিণী থেকে। এই যে প্রথমে শাস্ত্রজ্ঞানহীন জীবন এবং পরে মহাজ্ঞান লাভের আখ্যান; এটি সহজযানের সিদ্ধাচার্যগণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এই কাহিনীর মধ্যে নিহিত মূল তত্ত্বটি হল: তন্ত্রপথে জগতমাতৃকার কৃপালাভ ভিন্ন সমস্ত শাস্ত্রজ্ঞান ব্যর্থ। তুলনা করতে ইচ্ছা হয় সরহপা দোঁহার সাথে;

এস জপ হোমে মণ্ডল কম্মে

অনুদিন আচ্ছসি বাহিউ ধম্মে

তো বিন তরুণী নিরন্তর নেহে

বোহি কি লবভই প্রণ বি দেহে

কিম্বা

সিদ্ধিরত্থু মই পঢমে পঢিঅউ

মণ্ড পিঅন্তেঁ বিসরিঅ এমউ।

অর্থাত এককালে আমিও সিদ্ধিরত্থু( পালযুগের বর্ণপরিচয় বলা চলে) পড়েছি। তারপর মণ্ড পান করতে করতে কবেই সব ভুলে গিয়েছি।

তন্ত্রীপা, চমরিপা, অজোকাপা, ঠগনপা, খড়গপা প্রমুখের জীবনের সাথে সাধক সর্বানন্দের সাদৃশ্য এই। এঁরা সকলেই শাস্ত্রজ্ঞানহীন। প্রথম জীবনে অজোকাপা অতি অলস। ঠগনপা মিথ্যাচারী। খড়গপা চোর। অথচ সহজ সাধনায় মহাসিদ্ধির পর এঁরা সকলেই মহাজ্ঞানীতে পরিণত হয়েছেন। সর্বানন্দ ঠাকুরের সাথে এই বিষয়টি ছাড়াও খড়গপার কাহিনীর আরেকটি অসাধারণ সাদৃশ্য আছে। খড়গপা গুরু কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে অবলোকিতেশ্বরের মূর্তির সামনে জপ শুরু করেন। সাত রাত্রি অতিক্রান্ত হওয়ার পরে মূর্তির পাদদেশ থেকে একটি ভীষণ সর্প আত্মপ্রকাশ করে। ভীত না হয়ে তাকে ধরা মাত্রই সেটি জ্ঞানের খড়্গে পরিণত হয় এবং তার সাহায্যে অন্তরের অজ্ঞান নাশ করে তিনি সিদ্ধাচার্য হন। সর্বানন্দ ঠাকুরের ক্ষেত্রেও সিদ্ধিলাভের ঠিক আগে হুবহু এইরকমই কিংবদন্তি আছে। কেবল অবলোকিতেশ্বরের মূর্তির পরিবর্তে তালগাছের উল্লেখ আছে। তবে মনে রাখতে হবে রূপকথার গল্পের সময় থেকেই তালগাছ তন্ত্রের দেহতত্ত্বের প্রতিভূ। তিন তালগাছ উপরে রাক্ষসের মরণভোমরা খুঁজে পাওয়ার সেই বহুপ্রচলিত কাহিনীটির যে সুগভীর তান্ত্রিক তাৎপর্য আছে সে নিয়ে অনেক আগে আলোচনা করেছি।

যাই হোক। সিদ্ধিলাভের পরে সাধক সর্বানন্দ তন্ত্রের পুনরুজ্জীবনে ব্রতী হন। কৌলমার্গের সাধনক্রমসমূহ তাঁর সুবিখ্যাত সর্বোল্লাস গ্রন্থে সংকলিত হয়। এই গ্রন্থ সম্বন্ধেও একটি আশ্চর্য কিংবদন্তি আছে। সর্বোল্লাসে উল্লাস বা অধ্যায় সংখ্যা তেষট্টি। অথচ গ্রন্থের শুরুতে কোন অধ্যায়ে কি আলোচনা করা হয়েছে সেই সূচিপত্রের শেষ শ্লোকে সর্বানন্দ ঠাকুর বলছেন:

ত্রিষট্টৌ ব্রহ্মণঃ জ্ঞানম্ জীবন্মুক্তস্ততঃ পরম্

চতুঃষষ্ঠৌ সমাপ্তশ্চ গ্রন্থোল্লাসম্ যথোদিতম্।।

(তেষট্টিতম উল্লাসে আলোচিত হয়েছে ব্রহ্মজ্ঞান ও জীবন্মুক্তির পরম তত্ত্ব। চৌষট্টি উল্লাসে গ্রন্থ সমাপ্ত।)

অর্থাত্ স্বয়ং গ্রন্থকারের বক্তব্য অনুযায়ী আরো একটি অধ্যায় আছে। কিন্তু কোনো পাণ্ডুলিপিতেই সেটি নেই কেন? কিংবদন্তি অনুযায়ী ঐ উল্লাসটির তত্ত্ব অত্যন্ত গূঢ়। যে মাতৃসাধক তেষট্টি অধ্যায় পর্যন্ত তত্ত্ব যথার্থ অনুধাবনে সমর্থ হন; সর্বানন্দ ঠাকুর স্বয়ং তাঁর কাছে আবির্ভূত হয়ে তাঁকে ঐ শেষ অধ্যায়ের জ্ঞান প্রদান করেন। এই বিষয়টিও সিদ্ধাচার্য পরম্পরার সাথে আশ্চর্য সাদৃশ্য বহন করে। সিদ্ধাচার্যগণের মধ্যে যে দুইজন সবথেকে বিখ্যাত ছিলেন সেই নারোপা ও নিগু ডাকিনীর সম্বন্ধে তিব্বতি সূত্রে বলা হয়েছে যে তাঁরা লৌকিকভাবে দেহত্যাগের পরেও বহুকাল পরবর্তী সাধকদের অনেকবার পথ প্রদর্শন করেছেন। দশম শতকের নিগু ডাকিনীর জীবনকালের তিন শতাব্দী পরের তিব্বতি সিদ্ধ মিলপা নিগুমাকেই নিজের গুরু বলেছেন এবং তাঁর কাহিনী অনুযায়ী নিগুমা স্বয়ং বজ্রযোগিনী মাতৃকার সহচরীরূপে আবির্ভূত হয়ে তাঁকে প্রজ্ঞা দান করেছিলেন। নাঢ়া নাঢ়ীর সাধনস্থল সম্বন্ধে বলা হত: সেই স্থান আগে মনের মধ্যে খুঁজতে হয়। তবে বাইরে দেখা মেলে। উড্ডিয়ানের সম্বন্ধেও এই একই কিংবদন্তি আছে। এর মধ্যে সন্ধ্যাভাষার রহস্য আছে; সাধনতত্ত্বের গভীর ব্যঞ্জনা আছে; রূপকথার আশ্চর্য প্রতিধ্বনি আছে। সর্বোল্লাসের শেষ অধ্যায়টিও যেন সেই অরূপরতনের মতোই। প্রজ্ঞাদীপ্ত হৃদয়েই তাকে খুঁজে পাওয়া যায় অতীতের এক সাধকশ্রেষ্ঠের কালাতীত উপস্থিতিতে।

তাই সিদ্ধাচার্য পরম্পরার সাথে যুক্ত না হলেও সর্বানন্দ ঠাকুরের জীবনকাহিনী ও সাধনমার্গ সহজযানী চুরাশি সিদ্ধের সাথে অপূর্ব সাদৃশ্য বহন করে। তাঁর সময়কালটিও সিদ্ধগণের যথেষ্ট নিকটবর্তী। বাংলার মধ্যযুগের প্রসিদ্ধ তান্ত্রিকদের মধ্যে একমাত্র তিনিই চৈতন্যপূর্বযুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তখনও সম্ভবত পাল ও সেনযুগের প্রভাব বাঙালির মননে প্রকটভাবে বিদ্যমান ছিল। দশমহাবিদ্যার সাধনক্রমের এই মহাসাধকের জীবনকথা তারই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সেক্ষেত্রে সহজ আন্দোলনের সুদীর্ঘকাল পরেও যে শাক্ত পদকর্তাদের গানে সেই আদি চেতনার অপূর্ব প্রকাশ দেখতে পাই; সর্বানন্দ ঠাকুরের জীবনী সেখানে একটি মিসিং লিঙ্কের ভূমিকা পালন করেছে। তিনিই প্রমাণ যে সহজ তন্ত্রের উত্তরাধিকার থেকে বাঙালির মনোভূমি কখনোই পুরোপুরি বঞ্চিত হয় নি। 

উপরিউক্ত সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলোকে একত্রে পর্যবেক্ষণ করলে বাঙালির মধ্যযুগের শাক্তধর্মের যে চিত্রটি পাওয়া যায়; সেটিই শাক্তধর্মের সবথেকে বড়ো দুর্বলতার কারণ। আর সেটি হল কোনো সুনির্দিষ্ট ঋজুপথের অনুপস্থিতি। বাঙালি বৈষ্ণবগণ শ্রীচৈতন্যদেব ও নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর মাধ্যমে আপামর গণশক্তিকে গণধর্মের একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দিতে পেরেছিলেন। মধ্যযুগের শাক্তধর্মে সেই প্রয়াস সফল হয়নি। অনবরত বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী মতাদর্শ অনায়াসে এখানে প্রবেশ করেছে; এবং আজও প্রতিটিই নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে বিদ্যমান আছে। অগণিত আপাত ভিন্ন মতাদর্শও উপযুক্ত সংস্কারকের হাতে সুসংগঠিত হয়ে উঠতে পারে। বাঙালির মাতৃকা উপাসনার চিরন্তন ধারার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আগম, নিগম, যামল প্রমুখ বিভিন্ন শাস্ত্রে বর্ণিত অগণিত সাধনক্রমের সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি সুবৃহৎ ও সম্ভবত সমৃদ্ধতম গণধর্ম নির্মাণ করা সম্ভব। শাক্তধর্মে সেই কাজটি কারো হাতেই পূর্ণতা পায়নি। সহজযানীদের উড্ডিয়ানের সম্মেলন; বৈষ্ণবদের পানিহাটি ও খেতুরি মহোৎসবের মতো শাক্তধর্মের কোনো গণ সমাবেশ হয়নি। অন্তর্শাক্ত কৌলসাধকগণ চিরকাল অন্তরালেই পরস্পরবিচ্ছিন্ন হয়ে থেকে গেছেন। আজও বৈষ্ণবদের জয় নিতাই বা জয় রাধের মতো শাক্তধর্মে মাতৃকার নামে কোনো সার্বজনীন জয়ধ্বনি নেই। বিভিন্ন সম্প্রদায় নিজ নিজ গণ্ডির মধ্যে কুপমণ্ডুকত্বের আত্মরতিতে মত্ত। মধ্যযুগে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ অগণিত তন্ত্রের ধারাকে তন্ত্রসারে একত্রিত করেছিলেন। রামপ্রসাদ কমলাকান্ত প্রমুখ মহাসাধকের পদাবলীর মাধ্যমে জনচেতনা সুসংগঠিত হতে শুরু করেছিল। কালীনামের স্রোত ক্রমশঃ প্রবল হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বহু প্রত্যাশিত সেই ধর্ম আন্দোলন আসেনি যা শাক্তধর্মের একটি চূড়ান্ত ঋজুপথ নির্মাণে সক্ষম। ফলে আজও তন্ত্রের তত্ত্বসমূহ প্রায়শই বিকৃত হয়। তন্ত্রের উদারতা স্মৃতির অহংকৃত সংকীর্ণ বিধানের সীমায় বাঁধা পড়ে। গুহ্যাচার সারতত্ত্বসমূহকে আড়াল করে রাখে। বাঙালির প্রাণের আদিতম সুরটি যে মাতৃকার চরণে বাঁধা; আজও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি তাঁর সহজ উপাসনার অধিকার থেকে বঞ্চিত। মধ্যযুগের তন্ত্রের সবথেকে তিক্ত সত্য এটাই।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s