ভাগলপুরের বাঙালিটোলার স্মৃতি – জয়ন্ত মুখার্জি (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

স্মৃতি কথা কয়।

বর্ষায় ভেজা দুটো মাসের পর আসে শরত , আর শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে আসে মায়ের আগমনী বার্তা। আমাদের ভাগলপুরের আকাশ টা এবারের বর্ষায় ছিল কঠিন ইস্পাতের মত ধূসর নীল। শ্রাবণ মাসের  আকাশে কালো মেঘ থাকার কথা। আগুনের মতো রোদ বৃষ্টির বদলে ঠাণ্ডা  জলের বড় বড় ফোঁটা ঝড়ে পড়ার কথা। কোথায় কি ! সরকার থেকে শুনেছি রাজ্যে খরা ঘোষণা করেছে। করুক। অনেক শ্রাবণ পার করে এসেছি আমি। আছে অনেক স্মৃতি বৃষ্টি ঝরে পড়ার , যা আমাকে এখনো ভেজায়, শীতল করে। শান্তি দেয়।

                   যখন ছোট ছিলাম, ভাগলপুরে কালী বাড়ির মাঠে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলে যে আনন্দ পেয়েছি, আজকালকার বাচ্চারা স্মার্ট ফোনে পাব্জি খেলে পায় কি? জল কাদায় চিৎপাত হওয়ার যে আনন্দ, আহা, এখনকার ছেলে মেয়েরা তার খবরও রাখে না। সে আনন্দ তো অনেক টাকা দিয়েও কেনা যায় না। সত্তরের দশকে যখন আমাদের বেড়ে ওঠা, পুরো বাঙালি টোলাটাই ছিল এক পরিবারের মত। শুধু বাঙালিটোলা কেন ? আশপাশের পাড়া গুলো , – মশাকচক, খরমনচক, যোগসর, খঞ্জরপুর, ভিখনপুর ,সব জায়গায় ছিল প্রচুর বাঙালি। শুনেছি আজকের মুসলিম বহুল এলাকা তাতারপুরেও অনেক বাঙালির বসবাস ছিল এক সময়।

আর সব পাড়ার কথা থাক। নিজেদের পাড়া বাঙালিটোলার কথাই বলি বরং। ঐ যে বললাম এক পরিবারের মতো ; এটা শুধু কথার কথা নয়। ছোট বেলায় দেখেছি পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে কেল্লা জয় খেলছে পুরো পাড়া জুড়ে । কার বাড়ির পাঁচিল , কার বাড়ির ছাদ, কার বাড়ির উঠোন , সব একাকার হয়ে যেত। সারা পাড়া জুড়ে হতো দৌড়াদৌড়ি হুটোপাটি। আর পাড়ার কালী বাড়ির মাঠে হতো ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল। ক্রিকেট আর ভলিবল হত শীতকালে। ফুটবল বর্ষাকালে। একবার ঠিক হোল ফুটবল টুর্নামেন্ট হবে। টিম তৈরি হোল। কি সব জমকাল নাম ! প্যারামাউন্ট, চ্যালেঞ্জার্স, সেভেন ফ্রেন্ডস। ম্যাচের দিন গুলো একটা কাগজে লিখে কালী বাড়ির গায়ে থামের ওপর সেঁটে দেওয়া হত। বেশ কিছুদিন ধরে চলতো সেই টুর্নামেন্ট। পাড়ার লোকেরা তো বটেই, অন্যান্য় পাড়া থেকেও প্রচুর মানুষ আসতো ফুটবল ম্যাচ দেখতে।  উৎসবের চেহারা নিতো পুরো পাড়াটা। সে সব দিন গেছে একটা ! আমরা ছোটরা গুল্লি খেলতাম, মার্বেল। লাহিড়ীদের পুকুর পাড়ে জন্মান গাছের ডাল কেটে গুলী ডাণ্ডা বানাতাম। ক্রিকেট খেলার জন্য উইকেট ও বানিয়েছি। এ ছাড়াও ছিল কাবাডি। এমনি কাবাডি আর রাজা কাবাডি।  আরও অনেক খেলা ছিল যার নাম আর মনে নেই ; সবার হাতে কঞ্চির মতো সরু লাঠি থাকতো আর সেটা দিয়ে লাল ইট ছুঁতে হত, তারপর কোন একটা গাছের পাতার নাম বললে একজন সেই পাতা আনতে ছুটত। কি নাম, কি ভাবে খেলে সব ভুলে গেছি ! আর মনে রেখেই বা কি হবে ? এখন তো বাচ্ছাদের হাতেই নানা রকমের গেম। ও সব পুরনো খেলা ওদের কাছে হাস্যকর আর obsolete.। কিম্বা হয়তো না। ওরা তো জানলোই না। আমরাই জানালাম না। এই সব খেলা জানলে হয়তো ফোনের এডিক্সান থেকে বাচ্চারা একটু বাঁচত। কিছুদিন আগে ঝুলন পূর্ণিমা গেল। মনে আছে পাড়ার প্রায় প্রত্যেকটা বাড়ীতে ছোটরা ঝুলন করতো। আমরাও করেছি। কি উত্তেজনা !  কি তোড়জোড় ! বড় দুর্গাচরন স্কুলের রাস্তা থেকে বড় বড় পাথরের টুকরো কুড়িয়ে আনা। মাটি সমেত ঘাসের চাপড়া। এই সব দিয়ে ঝুলনের পাহাড়, মাঠ তৈরি হবে। রং করা কাঠের গুড়ো দিয়ে রাস্তা ঘাট। ফোয়ারা তৈরি হত, আর তাতে নাচত পিংপং বল। দোলনায় ঝুলত রাধা কৃষ্ণের মূর্তি। আর থাকত মাটির তৈরি নানা রকমের পুতুল।মাথা নাড়ানো বুড়ো, একজোড়া সেপাই আরও কত কি, সে গুলো আমরা কিনতাম বেহুলা পুজোর মেলায়। আমাদের বাড়ীতে ছোট একটা ঝুড়ি তে সেই সব পুতুলগুলো তোলা থাকতো। মনে আছে সেই ঝুড়িতে একটা মাথা নাড়ানো বুড়ো ছিল।বসে আছে, তার লম্বা সাদা দাড়ি। মাথাটা একটা স্প্রিং দিয়ে ঘাড়ের সঙ্গে আটকান। টোকা মারলেই টুক টুক করে মাথাটা নড়ত।  গায়ের নীল রঙের ওপর পিঠের দিকে আঁচড় কেটে লেখাছিল  ‘ চাঁদু ‘। বোধহয় দাদা নিজেই লিখেছিল।চন্দ্রনাথ মুখার্জি, আমার দাদা আজ পাঁচ বছর হোল আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। সেই ঝুড়ি ভর্তি পুতুলগুলোর হদীসও আর নেই।

 প্রচলিত খেলা ছাড়াও বাঙালিটোলার কিছু নিজস্ব খেলা ছিল। একটা, কেল্লা জয়। দাদাদের মুখে শুনেছি, খেলিনি কখনো। আর একটা খেলায় গাছের শক্ত শক্ত ফল, স্থানিয় ভাষায় ‘ গুল্লার ‘ ছুঁড়ে দুই দলে মারামারি। এটাই খেলা ! বিশ্বাসদের বাড়ির পেছনে সিয়েমেস(C.M.S) স্কুলের মাঠ আর বাঙালিটোলার মাঝে একটা নালা ছিল। নালার দু পাড়ে দুই দলে ভাগ হয়ে এই বিচিত্র খেলাটি চলতো। খেলার কথাই যদি উঠলো তবে গঙ্গায় মাছ ধরার কথা না বললে অন্যায় হবে। মাছ ধরাও তো একটা স্পোর্ট। আমাদের পাড়ায় মাছ ধরার জন্য দুটো জায়গা ছিল। এক গঙ্গা, দুই চুনচুন কাকাদের পুকুর। বাংলায় যেমন পুকুরের ছড়াছড়ি বিহারে কিন্তু পুকুর সহজ লভ্য নয়। আমাদের বাঙালিটোলা ছিল ব্যাতিক্রম। বোধ হয় দেশের স্মৃতি জাগিয়ে রাখতেই লাহিড়ীদের কোন এক পূর্বপুরুষ একটি পুকুর কাটিয়ে ছিলেন বাড়ির লাগোয়া জায়গায়। একবার মনে আছে আমি আর আমার বন্ধু লোটন পুকুরে ছিপ ফেলে বসেছি। আর কেও নেই। আমাদের টার্গেট পুকুরের পুঁটি মাছ। হটাত পেছন থেকে আওয়াজ- কাকে বলে বসেছ এখানে? একটু খোনা খোনা আওয়াজ। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি চুন চুন কাকার দাদা বংশী কাকা! – বলবো বাবাকে ? এই রে ! আমি চুপ। কিন্তু লোটন খুব স্মার্টলি উত্তর দিল – ধুত, এখানে তো মাছ ই নেই। কতক্ষণ বসে আছি। তারপর আমার হাত ধরে টেনে বলল – চল আমরা নালার ধারে বসি। তারপর কি হয়েছিল  এতদিন বাদে আর মনে নেই।

বাঙালিটোলার আর একটা আকর্ষণ ছিল যাত্রা আর নাটক। যে কোন ছোটখাটো অনুষ্ঠানে নাটক নেবে যেত কয়েক দিনের মহড়ায়। প্রতি বছর দুর্গা পুজোয় দুটো দিন নির্দিষ্ট থাকতো যাত্রার জন্য। প্রথম দিকে ছিল অষ্টমী আর নবমি , পরে হোল একাদশি দ্বাদশী।  আকর্ষণ বলে আকর্ষণ ! আমাদের অর্থাৎ ছোটদের প্রধান ইন্টারেস্ট ছিল যাত্রার রিহার্সালে। আসলের চেয়ে যেমন সুদে বেশী মজা , তেমনি যাত্রার চেয়ে যাত্রার রিহার্সালে। কোনোরকমে পড়া শেষ করে ছুটতাম যাত্রার রিহার্সাল দেখতে। নানান জায়গায় হোতো সেটা। কখনো অশোক চ্যাটার্জীদের বাইরের ঘরে , কখনো হাওয়া অফিসের বাড়ীতে , মেঘা বাবুদের (আচার্যি ) বাইরের ঘরে। সে এক আশ্চর্য পরিবেশ। এক জায়গায় হয়তো যাত্রার কোন দৃশ্যের মহড়া চলছে। একজন প্রম্ট করছে। ডাইরেক্টর সুবোধদা নয়তো অশোকদা। ঘরের আর এক দিকে অরেকটা জটলা। সেখানে পূর্ণেন্দুদা সন্তোষদারা বসে যাত্রার গানের সুর তৈরি করছে।সন্তোষদা আবার যাত্রায় বিবেক সাজতেন। এদিকে চা এসে গেছে বড় কেটলি তে। আমরাও  ভাগ পেতাম। সে বড় মধুর স্মৃতি।

  কয়েকদিন আগে লালটু দার সঙ্গে দেখা। বাকি ভাইয়েরা গত হয়েছেন ,অবিবাহিত লালটুদা একাই ভাগাল্পুরে আছে। সত্তরের ওপর বয়সে এখনো খাড়াই শরীর। কথাটা বলতেই একগাল হাঁসি। পাড়ায় পুরনো লোক বলতে আমরাই কয়েকটি পরিবার । লালটুদার সঙ্গে দেখা হলে পুরানো কথাই হয়। কেমন করে তিন চার জনে মিলে  বাঙালিটোলার ঘাট থেকে বর্ষার ভরা গঙ্গা পার হয়ে ওপারের একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় জিরিয়ে নিয়ে ফের বাঙালিটোলার ঘাটে ফিরে আসতো, সেটা শুনে বাঙালি হিসাবে বেশ গর্ব হচ্ছিল। তবে, এখন কি এই ধরনের নির্ভীক দামাল ছেলে বাঙালিদের মধ্যে পাওয়া যায় ?

বর্ষাকালে বাঙালিটোলার ঘাট ছিল খুব মজার জায়গা। দিনের বেলায় ছিপ দিয়ে মাছ ধরা আর একটু বেলায় স্নানে নেবে জলের মধ্যে হুট পাটি । তবে বিকেল বেলার মজাটা একটু অন্য রকম । আমাদের বাঙালিটোলার ঘাটে সার সার ছই ওয়ালা বড় নৌকা এসে ভিড়ত। ঘাটে জমা হতো প্রচুর লোক। বড় বড় মাটির জালার মতো হাড়ি নিয়ে সবাই খুব ব্যস্ত। বর্ষার সেই সময়টায় আসলে মাছের চারা কেনা-বেচা হোতো। শুনেছি বাংলা থেকেও নৌকা করে লোক আসতো। ছোট ছোট আলুমুনিয়ামের বাটিতে করে মাছের চারা মেপে বিক্রি হোতো। যারা কিনতো তারা চারাগুলো বড় বড় হাড়িতে ঢেলে দিত। হাড়িতে ভরা গঙ্গার ঘোলা জলে ছোট ছোট পোকার মতো মাছের চারা গুলো মিশে যেত। একটা লোক সেই হাড়ি ধরে ক্রমাগত নাড়িয়ে যেত। নাহলে স্থির জলে মাছ মরে যাবে।  এখনো যেন শুনতে পাই সেই হাড়ি নাড়ানোর শব্দ।

ছলাত, ছলাত। ছলাত ছলাত।

 পায়ের তলায় গঙ্গার ভিজে কাদা মাটিও যেন অনুভব করি। নাকে  পাই  বর্ষা কালের ভরা গঙ্গার ঘোলা জল থেকে ভেসে আসা সোঁদা সোঁদা আঁশটে গন্ধ।

                             বাঙালিটোলা বদলে গেছে। কালী বাড়ির সামনে বিশ্বাসদের যে মাঠে আমরা খেলাধুলো করতাম তার অর্ধেকটায় বাড়ি উঠেছে  । বাঁকি অর্ধেকটার অত্যন্ত শ্রীহীন অবস্থা। বিশ্বাস বাড়ির গায়ে অযত্নের ছাপ। সবুজ ঘাসে ছাওয়া এই মাঠে কত ফুটবল ক্রিকেট খেলা হয়েছে। ভলিবল। সন্ধ্যাবেলায় এখানেই দাদাকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দেখেছি ; বাড়ীতে বসে সেই আড্ডার শোরগোল বাড়ি থেকে শোনা যেত, যেমন শোনা যেত কালীবাড়ির আরতিতে বাজা ঘন্টার মধুর আওয়াজ। আরতির সময় হলে আড্ডা থেকে উঠে কেও গিয়ে বাজিয়ে আসত ঘণ্টাটা। এই কালী বাড়ির মাঠটাই আবার নিস্থব্ধ দুপুরে অন্য রকম হয়ে যেত। মাঠের উত্তরে দুটি পরিবারের পাশাপাশি বাস ছিল। তাদের একজনের ছিল কাঁসার বাসন পত্রের ব্যবসা। কাঁসার বাসনে ঠুকে ঠুকে নকশা কাটতেন উনি। ঠং ঠং ঠং ঠং । তখন পাড়ায় এতো ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হয়নি। আওয়াজটা বাড়ি থেকেই শোনা যেত। কেন জানিনা শব্দটা দুপুরের নিস্থব্ধতাটা আরও বাড়িয়ে দিত।

আজ দু হাজার বাইশে দাঁড়িয়ে যখন আমার ছোট বেলাটা দেখি , মনের মধ্যে kaleidoscope এর মতো  নানান বর্ণের ক্ষন ভঙ্গুর ছবি ভেসে ওঠে । মাঝে মাঝে নিজেরই সন্দেহ হয়, ঘটনাগুলো ঠিক এই ভাবেই ঘটেছিল তো ! সময় বদলায় । তার সাথে পারিপার্শ্বিক। বাঙালিটোলায় একসময় ভরা বাঙালি ছিল। যে দু একটা অবাঙালি পরিবার বাস করতো, তারাও দিব্বি বাংলা বুঝতে পারতো, কেও কেও দিব্বি বলতে পারতো। বাড়ির কাজের লোকেরা বাংলা শিখে যেত বাড়ির মা বৌদের সাথে কথা বলতে বলতে। আজ ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা। হাতে গোনা কয়েকটা বাঙালি পরিবারের ছোট ছেলে মেয়েরা হিন্দিতে যতটা স্বছন্দ বাংলায় ততোটা না। ওদের বলা হিন্দিতে কোন বাংলা টান নেই , যেটা আমাদের আছে।  অবশ্য এসব নিয়ে প্রবাসী বাঙালিদের বিশেষ চিন্তা করে লাভ নেই , খোদ বাংলার অবস্থাই এ বাবদে ভালো না।

এতো পরিবর্তনের মধ্যেও কিছু কিছু জিনিষ একই রয়ে যায়। বাঙালিটোলার গঙ্গাঘাটে এখনো সূর্যাস্তের রং একই ভাবে গঙ্গার জলে খেলা করে। বর্ষার ভরা জলে এখনো শুশুক ভুস করে ভেসে ওঠে। ভাগলপুরে শরতের নীল আকাশে চিলের ওড়া আর সাদা মেঘের আনাগোনাও তো একইরকম! বাড়ির নারকোল গাছের গায়  কাঠবেরালির পরিবার শীতকালের রোদ পোয়ায় একই ভাবে। শীতের হিমেল হাওয়া আর গরম কালের লূ একই ভাবে বয়। আমাদের পুরনো বাড়িটাও একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে এখনো পূর্ব পুরুষদের স্মৃতি বকে নিয়ে।  এসবের মাঝে দাঁড়িয়ে তাই শুনতে পাই সেই ছোট বেলার ঠং ঠং শব্দ। বুকের মধ্যে আনুভব করি – ছলাত !

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s