
বাংলা পুঁথি ও পাটাচিত্রর সন্ধানে
তন্ত্রাশ্রয়ী বাংলায় আদি-মধ্য যুগের (পাল – সেন যুগ) অবদানের একটি ছিল “কুল ও শীল”। অর্থাৎ, বাংলার মানুষ তাঁদের জীবিকা ও কাজ অনুযায়ী এক বিশেষ শ্রেনীর মর্যাদা পেতেন। তেমনই এক বিশেষ শক্তিশালী শিল্পগোষ্ঠী ছিলেন “সূত্রধর” সম্প্রদায়। এঁরাই কাঠ ও পাথরের ভাষ্কর্য থেকে শুরু করে পাটাচিত্র পর্যন্ত অঙ্কন করতেন। এই সম্প্রদায়েরই কয়েকজন আবার তাদের শিল্পকর্মের মর্যাদা হিসাবে “ভাস্কর” উপাধিও পেতেন। এখনকার দিনে যেমন বই, বইএর লেখক একজন হন, সেই বই হাজারটা কপি ছাপা হয়ে বেরোয়। সেযুগে তো তেমন ছাপাখানা ছিল না। সুতরাং, সেযুগে বই (পুঁথি) রচিত হত লেখকের দ্বারা, কিন্তু সেই বই কপি করতে হত হাতে লিখে ও হাতেই এঁকে। সেই পুঁথি লেখা ও পাটাচিত্র অঙ্কনের কাজটাই করত এই বিশেষ সূত্রধর সম্প্রদায়ের শিল্পীরা৷
এই সূত্রধর সম্প্রদায় ছাড়াও সেযুগে শিল্পকর্মে জড়িত ছিল আরো অনেক সম্প্রদায়। যেমন, তন্তুবায়, কংসাকার, কর্মকার, স্বর্ণকার ইত্যাদি। এনারা সামাজিক অবস্থানে নীচের দিকে হলেও সম্মান পেতেন। কারণ তখনও বৈদিক বর্ণবাদ খুব প্রকট ভাবে প্রভাব বিস্তার করেনি। ফলে, এইসব শিল্পকর্ম শুধু রাজা-জমিদার বা বড় ব্যাবসাকেন্দ্রীক বিনোদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সব শ্রেণীর মানুষই এই শিল্পকর্ম উপভোগ করতেন। যেমন, মঙ্গলকাব্য – জীবনী – আখ্যান কাব্য – পদাবলী কীর্তন – লোকসংগীত ইত্যাদি৷
অর্থাৎ, মধ্যযুগের এই বাংলার শিল্পকলা ছিল জন-উৎসের। পাল-সেন যুগের পর থেকে সেইসব “মার্গ” (ক্ল্যাসিক্যাল), শিল্পকলার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। অর্থাৎ, তেরো শতকের পর থেকে বাংলায় সেইসব “মার্গ” শিল্পকলা আর দেখাই যায় না প্রায়৷
ভাস্কর-সূত্রধর সম্প্রদায় যেমন পটচিত্র এঁকেছেন বহুযুগ ধরে, জাতপটুয়ারাও তেমন দিঘল পট এঁকে আসছেন। এই দুই গোষ্ঠীরই পরম্পরাগত শিক্ষা ছিল। জাতপটুয়াদের কাজ অনেকটা লোকায়েত উৎসের আর ভাস্কর-সূত্রধর বা কুম্ভকারদের পটে নকশা, সূক্ষ্ম কারুকাজের প্রাধান্য ছিল। বাংলার প্রাচীন টোরাকোটা মন্দিরগুলোতে এইসব পাটাচিত্র ও পটেরই ভাস্কর্যরূপ দেখা যায়৷
চিত্রকলায় পারদর্শী সূত্রধর শিল্পীদের সম্পর্কে কবিকঙ্কণচণ্ডীতে মুকুন্দরামের উল্লেখ –
“ছুতারপুরের মাঝে চিঁড়া কুটে মুড়ি ভাজে কেউ চিত্র করায় নির্মাণ।
হুদ্দারার চৌকাঠে সূত্রধর চিত্র গঠে সবপু সমান কপাট।”
অতএব বোঝাই যাচ্ছে, চিত্রকররা আদৃত ছিলেন সেযুগে। উপেক্ষিত হলে মঙ্গলকাব্য, জীবনীকাব্যগুলোতে তাঁদের উল্লেখ পাওয়া যেত না৷
পাল-সেন যুগের পরে ষোড়শ শতকের দিকে বাংলায় চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব আন্দোলনে বাংলায় ভক্তিবাদ প্রবল হয়েছিল। জাতিভেদ (বৈদিক বর্ণবাদ) ও অস্পৃশ্যতা বিরোধী এই আন্দোলন সেই সময়ে সব শ্রেণির মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। এই ভাবপ্রাবল্য, সেই সময়টায় বঙ্গীয় শিল্পীসমাজ বৈষ্ণব ভাবধারার প্রাবল্য হেতু চৈতন্যকেন্দ্রিক ও কৃষ্ণকেন্দ্রিক শিল্পকলায় প্রাণীত হয়েছিলেন। এরই ফল হল, ষোড়শ শতকের দিকে রচিত পুঁথির লেখা সহ পাটায় চৈতন্যদেব ও কৃষ্ণচিত্রের আধিক্য। এরই প্রভাবে বাংলায় গড়ে উঠেছিল বহু টোরাকাটা মন্দির ও ওইসব মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির ভাস্কর্য। টোরাকাটা মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্য গুলো সহ সেই সময়কার পুঁথিগুলোর পাটায় দশাবতার কৃষ্ণের বিবিধ লীলা, পৌরাণিক কাহিনি, চৈতন্যলীলা, রামায়ণ মহাভারতের সংখ্যাধিক্য দেখা যায়। বাংলার শিল্পকলায় এই বৈষ্ণব ভাবপ্রাবল্য ষোড়শ শতক থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল৷
পনেরো শতকের দিকে বাংলায় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল মা মনসা। বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-নৃত্যে মা মনসার কাহিনির এক বিশিষ্ট স্থান আছে, তার প্রমাণ হল প্রায় শতাধিক মনসামঙ্গলের রচয়িতার পরিচয় আবিস্কৃত হওয়ায়। এ পর্যন্ত যত দিঘল পট বা লাটাই পট পাওয়া গেছে, তার এক পঞ্চমাংশই হল মা মনসার পট৷
বাংলায় পনের শতকের আগে কোনো লিখিত মনসামঙ্গলের সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে, পনেরো শতকের পরের দিকে অনেকগুলো মনসামঙ্গলের সন্ধান পাওয়া গেলে সেটা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, মনসামঙ্গল বাংলায় কতটা জনপ্রিয় ছিল। আজও বিবিধ আঙ্গিকে মনসাপূজার প্রচলন আছে। পটুয়ারা এখনো মনসাপট আঁকেন৷
বাংলার সংস্কৃতিতে মনসার এই জনপ্রিয়তার কারণ হল, সেযুগে মা মনসার পুজোর প্রচলনটা ব্যাপক ভাবেই ছিল। সমসাময়িক সময়ে জনপ্রিয়তায় প্রথম সারিতে ছিলেন আর এক মাতৃকা, চন্ডী। এই চন্ডীর জনপ্রিয়তা দিয়ে মা মনসাকে ঢাকা দেবার একটা প্রয়াস এযুগে (সেযুগে নয় কিন্তু) হয়েছে। বলা বাহুল্য, চন্ডি আর মনসা উভয়েই তন্ত্রাশ্রয়ী বাঙালির নিজস্ব মাতৃকা।
বর্তমানে যা দেখা যায়, মা মনসার বিভিন্ন থানে উপাসনায় যোগ দেন মূলত নিম্নবর্গীয় ও আদিবাসী বাঙালীরা। এসব দেখিয়ে মা মনসার উপরে একটা বর্ণবাদী তকমা জুটিয়ে দিয়ে মনসাকে আরো পিছনে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই মনসামঙ্গল প্রমাণ করে নিম্নবর্গ-উচ্চবর্গ নির্বিশেষে সমস্ত শ্রেণির মধ্যেই মা মনসার পূজার প্রচলন ছিল সেযুগে। যেটা তন্ত্রের বর্ণবাদ পরিহার করার দর্শনের অনুসারী।
উনিশ শতকের দিকেই বাংলায় চিত্রিত পুঁথির যুগ শেষ হয়। এরপর থেকেই ছাপাখানার যুগ চলে আসে। ১৮১৬ সালের দিকে সচিত্র অন্নদামঙ্গল ছাপা হয়৷
খুব দুঃখের বিষয়, বাংলার মধ্যযুগের পুঁথি ও চিত্রকলার বৃতান্ত নিয়ে কাজও হয়েছে খুব সামান্য। সংরক্ষণের অভাবে সেযুগের পুঁথি সহ চিত্রকলার নিদর্শন প্রায় বিনষ্ট হয়ে গেছে। রক্ষা পেয়েছে শুধু কয়েকটি পুঁথি আর পাটাচিত্র। তবে নিঃসন্দেহে একথাটা বলা যায় যে, মধ্যযুগের সর্বস্তরের মানুষ এখনকার চেয়েও অনেক বেশি করে সাহিত্যরস ও চিত্রালোকে উপভোগ করতেন৷
বাংলার পুঁথি নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের কিছু অভিজ্ঞতা শুনুন –
পুঁথি সংগ্রহের কাজটি মুখে বলা যত সহজ, বাস্তবে তেমনি দুরূহ। আমাদের দেশের পুঁথি-মালিকরা (যাঁরা পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পুঁথির অধিকারী) অধিকাংশক্ষেত্রেই সাধারণ গৃহস্থ মাত্র। অনেকেরই আর্থিক অবস্থা আগের মত সচ্ছল নয়। খুব কম ক্ষেত্রেই শিক্ষিত-মার্জিত পুঁথি-মালিকের সন্ধান মেলে। সকলেই পূর্বপুরুষের সযত্নলালিত প্রাচীন পুঁথির রাশিকে আশ্রয় দিয়েছেন গোয়ালঘরের মাচা, জ্বালানী বা ঘুঁটের মাচা, কোঠাবাড়ির তেতলায় ভাঙ্গা তোরঙ্গে কাগজপত্র বা ভাঙা আসবাবপত্রের সঙ্গে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে পুঁথিকে ভক্তিভরে পূজো করা হলেও বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি আবর্জনার সামিল। চরম অবজ্ঞার শিকার৷
অবহেলা অনাদরে পড়ে থাকা এইসব পুঁথি ভিক্ষা চাইতে গেলেই নানা আপত্তি। ধারণা, এসব পুঁথি বিক্রি করে বা গোপনে বিদেশে পাচার করে সংগ্রাহক প্রচুর অর্থ উপার্জন করে থাকেন!
সংস্কৃত সাহিত্যের এক প্রবীণ অধ্যাপকের বাড়ির ঘুঁটের মাচায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা অর্ধশতাধিক বাংলা-সংস্কৃত-তুলট ও তালপাতার পুঁথি তার কনিষ্ঠ ভ্রাতার উদারতায় হস্তগত করেও পরে এই অধ্যাপকের ‘অভিশাপ‘ আর ‘রক্তচক্ষুর‘ তাড়নায় নিরূপায় হয়ে আবার তা ফেরৎ দিয়ে আসতে হয়। ১৯৭৮ এর বন্যায় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কোন এক গ্রামে সেই অধ্যাপক মহোদয়ের পুরোনো মাটির বাড়িটি ভেঙে যায়, বিনষ্ট হয় সেই সব অমূল্য পুঁথি। এই জেলারই ঘাটাল মহকুমার এক একদা জমিদার বাড়ির ঠাকুরঘরের কুলুঙ্গীতে রক্ষিত বিশাল পুঁথির স্তুপ একবার দেখতে চেয়েও পাওয়া যায়নি। সেগুলি বন্যায় বিনষ্ট হয়৷
এ ধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে বহুস্থানে (আবার বাড়ি এসেও কেউ কেউ পুঁথি দিয়ে গেছেন।) নিজেদের বিষয়সম্পত্তি বা গুপ্তধনের খোঁজ বাইরের লোক জেনে ফেলবে, এজন্যও পুঁথি বা দলিলদস্তাবেজ কাউকে দেখানো হয় না৷
বর্ধমান জেলার উখড়ার কোন এক স্থানে নাগরী লিপির অজস্র পুঁথি আর পুরোনো দলিল দস্তাবেজ নেড়ে চেড়ে দেখার সময় কর্তৃপক্ষ কড়ানজর রাখেন, কোন “নোট” নেওয়া হচ্ছে কীনা তা দেখতে৷
পুঁথিকে নিয়ে এদেশের মানুষের নানা লোকবিশ্বাসের অস্ত নেই। বহু পুঁথি তাই নদীতে, পুকুরে বা জ্বলন্ত আগুনে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। উৎকট ভক্তিবশতঃ নিয়মিত ফুল জল দিয়ে পুজো করে বহু পুঁথিকে নষ্ট করা হয়েছে৷
১৯৭৮ এর বন্যায় মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলী জেলার নানা স্থানের হাজার হাজার পুঁথি ভেসে গেছে। সময়মত এসব পুঁথি সংগ্রহশালায় দান করলে বা আগ্রহী গবেষকের হাতে তুলে দিলে সেগুলি রক্ষা পেতো। অবশ্য কিছু উদার হৃদয় মানুষের করুণায় যযৎসামান্য কিছু পুঁথিই সময়মত রক্ষা পেয়েছে৷
পুরোনো ছাপা বই, হাতে লেখা যে কোন পুরোনো কাগজ সবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা পুঁথির গবেষকের কাছে সংস্কৃত পুঁথি ‘অতি প্রয়োজনীয়‘ না হলেও অবশ্যই সংগ্রহ ও সংরক্ষণযোগ্য। পুঁথির সন্ধান পাওয়া গেলেই তা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা জাতীয় কর্তব্য – যদি তা অনাদৃত অবস্থায় থাকে। মূল্য দিয়ে, উপহার দিয়ে, ছাপা বই দিয়ে পুঁথি পাওয়া যাবে। অনেক সময় ছলনার আশ্রয় নিয়েও পুঁথিকে রক্ষা করতে হবে৷
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাংলা পুঁথি সংগ্রহের পথপ্রদর্শক। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিংশবার্ষিক অধিবেশনে তিনি (৩১ শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩২১) সভাপতির ভাষণে বলেন –
“ভট্টাচার্য মহাশয় পুঁথি পড়িয়া পণ্ডিত হইয়াছিলেন, পৈতৃক পুঁথিগুলিকে প্রাণাপেক্ষাও প্রিয় দেখিতেন, সর্বদা সেগুলিকে ঝাড়াঝুড়া করিতেন, পুরু কাপড়ে শক্ত করিয়া বাঁধিয়া রাখিতেন। তাহার ছেলে ইংরাজী স্কুলে পড়িতে গেল, ক্রমে চাকরি করিতে গেল, বাবার বড়ো আদরের জিনিষ, পুঁথিগুলিকে রক্ষা করিল, ফেলিয়া দিল না। ভট্টাচার্য মহাশয়ের পৌত্র অল্প ইংরাজী লেখাপড়া শিখিল, তার পরে চাকরি করিতে গেল, পুঁথি-পাজির কোনো ধারও ধারিল না। পৌত্রবধূ বাড়ি আসিয়া দেখিলেন এক জায়গায় কত আবর্জনা রহিয়াছে। ছেঁড়া ময়লা কালো ন্যাকড়ায় জড়ানো কতকগুলা কাগজ রহিয়াছে, তিনি সেইগুলিকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিলেন। হয়তো রাঁধিবার সময় কাঁচা কাঠে ফুঁ দিতে দিতে সেই ধোঁয়ায় চোখ জ্বলিতে লাগিল, তখন পুঁথি অথবা তাহার পাটার (কাঠের কভার / যেগুলোকে আমরা বর্তমানে ‘হার্ড কভার‘ বলে জানি) কথা মনে পড়িল। সুবিধা পাইলেন তো একখানা পুঁথি উনানে দিয়া ফেলিলেন অথবা পুথির পাতাগুলি ফেলিয়া দিয়া বহুকালের শুষ্ক কাঠের পাটা দুখানি উনানে দিয়া সেদিনকার রান্না সারিয়া লইলেন৷
১৯০৪ সালে একবার নবদ্বীপ গিয়াছিলাম, দেখিলাম একজনের বাড়ির পিছনে রাস্তার ধারে রাশীকৃত পুঁথির পাতা পচিতেছে। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম যে, ওই পুঁথিটির পাটাগুলি পোড়ানো হইয়াছে। বাড়ির গিন্নিমা সরস্বতীকে পোড়াতে চান না, তাই পুঁথির পৃষ্ঠাগুলি বাড়ির বাহিরে ফেলিয়া দিয়াছেন। যে বাড়ির গিন্নির মা সরস্বতীর উপর এতটুকু কৃপা নাই, তাহারা পুঁথির পাতা লইয়া কী করেন, অনায়াসে বুঝা যায়।” (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১ম সংখ্যা, ১৩২১)৷
একটি বেদনাময় অনুভূতি এখানে উল্লেখ না করে পারলাম না। এদেশের পুঁথি প্রেমীদের বোধহয় যন্ত্রণা দিয়ে চলে এই কারণেঃ –
এদেশের লক্ষ লক্ষ পুঁথি তো দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে গেছে। চীনা পরিব্রাজকদের সময় থেকে শুরু করে আজও ভারতীয় পুঁথির বিদেশযাত্রা অব্যাহত আছে। প্রাচীন কালের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। মধ্যযুগও তাই। আধুনিককালে সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি হয়ে এসে (১৭৮৩ খ্রীঃ) এদেশে প্রচুর পুঁথি সংগ্রহকরেন স্যর উইলিয়াম জোন্স (ইনিই বিশ্ববিখ্যাত সারস্বত প্রতিষ্ঠান, এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেন)। সব না হলেও কিছুই কি তিনি নিজের দেশে নিয়ে যান নি? মার্ক অরেল স্টাইন, কর্নেল বাওয়ার, মাক্সমূলার, এদেশের হাজার হাজার পুঁথি সংগ্রহ করেছেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। সেইসব পুঁথি ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়ার সংগ্রহশালায় আছে৷
মহারাষ্ট্র সরকারে চাকরী করতে এসে ব্যুলার (১৮৬৩ খ্রীঃ) এদেশের হাজার হাজার পুঁথি সংগ্রহ করে নিয়ে গেছেন। এইসব বিদেশগত লক্ষাধিক পুঁথির মধ্যে বাংলা পুঁথি কি আদৌ ছিল না? ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীর বাংলা পুঁথিগুলিতো এদেশ থেকেই নিয়ে যাওয়া!
এভাবেই যে কত গুরুত্বপূর্ণ পুঁথি এদেশে কারোর ব্যাক্তিগত সংগ্রহে থেকেও হারিয়ে গিয়েছে, তার ইয়াত্বা নেই। তেমনই কিছু হারিয়ে যাওয়া পুঁথির নমুনা শোনা যাক এখানে –
১. চুঁচুড়া গীতগোবিন্দ-
চুচুঁড়ার এক প্রাচীন জমিদার পরিবার, জে সি মন্ডলের ব্যাক্তিগত সংগ্রহে গীতগোবিন্দের একটা পুঁথি ছিল। যতটুকু জানা যায়, পুঁথিটির ৩৭ টি পাতা ছিল। প্রতিটি পাতার সাইজ ৩৫ সেন্টিমিটার বাই ২৮ সেন্টিমিটার। আয়তাকার প্রতিটি পাতার চারিদিকে ঘিরে চারটি বা ছয়টি কাংড়া শৈলীতে রাধাকৃষ্ণ বা কৃষ্ণ লীলার ছবি অঙ্কিত। প্রতিটি অঙ্কিত পাতার মধ্যাংশে বাংলা অক্ষরে গীতগোবিন্দের কয়েকটি করে শ্লোক, পংক্তি লেখা ছিল। বঙ্গাক্ষরে লেখা শ্লোকগুলা আর ছবির কিছু অংশ ‘হাইলাইট’ করার জন্য সোনার জল ব্যবহার করা হয়েছিল। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য ওই গীতগোবিন্দের পুঁথিটির নামই হয়ে ছিল “চুঁচুড়া গীতগোবিন্দ”৷

পুঁথিটির বর্তমানে আর কোনো হদিস নেই..!! ১৯৩৪ সালের দিকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় “জার্নাল অব ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট” নামে বইতে সম্পাদনা করতেন ডঃ স্টেলা ক্রামারিশ। এই ডঃ স্টেলা ক্রামারিশ ওই চুঁচুড়া গীতগোবিন্দের অঙ্কনশৈলী নিয়ে কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ছবি সহ। এটাই একমাত্র সম্বল ওই চুঁচুড়া গীতগোবিন্দের সম্পর্কে জানার জন্য। তবে, জার্নাল অব ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট এর বইগুলো ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে হয়ত একসময় এই চুঁচুড়া গীতগোবিন্দের আর কোনো প্রমাণই থাকবে না। ডঃ ক্রামারিশ চুঁচুড়া গীতগোবিন্দের অঙ্কনশৈলী থেকে অনুমান করেছিলেন পুঁথিটি উনিশ শতকে লিখিত৷
২. ত্রিপুরার একটি অখ্যাত গ্রাম থেকে বাংলা অক্ষরে লিখিত এক প্রাচীন ভগবত পুরাণের পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। পুঁথিটির বিবরণ সম্পর্কে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বলেন, “পুঁথিটির পাটায় চিত্রিত আছে একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমান (বোধহয় চিত্রকর কোনো নবাব বা বাদশাহের আদর্শ লইয়া ছবি আঁকিয়াছেন) গালিচার উপরে সুখোপবিষ্ট। সন্মুখে গড়গড়া। গড়গড়াটা একটা বিচিত্র রকমের। চিত্রিত মানুষটি তাকিয়া ঠেসান দিয়া এক হাতে গড়গড়ার নলটি ধরিয়া তামাক খাইতেছে। অপর হাতখানা তাকিয়ার উপরে রক্ষিত ছোরা ধরিয়া অবস্থিত। পাটাখানির ভিতরের দিকে নয়টি মাতৃ মূর্তি। পিছনের পাটায় দশাবতার অঙ্কিত।”৷
বর্তমানে এই পুঁথিটিরও কোনো হদিস নেই৷
৩. রজতানন্দ দাশগুপ্তর লেখা থেকে জানা গিয়েছিল, পনের শতকের চিত্রিত বঙ্গলিপতে হরিবংশের একটি চিত্রিত পুঁথি এশিয়াটিক সোসাইটিতে দেখেছিলেন রাই কৃষ্ণদাস। বিস্তারিত বিবরণ খুব বেশি নেই, তবে এই পুঁথিটিও হারিয়ে গেছে৷
৪. ডঃ ত্রিপুরা বসু ব্যাক্তিগত উদ্যোগে দুর্গাপুরের অদূরে সাগরভাঙা গ্রামের সাধন গুঁইয়ের পারিবারিক সংগ্রহ থেকে একটা পুঁথি উদ্ধার করে এনেছিলেন। পুঁথিটির পাটাচিত্রটি এরকম ছিল – “দু-দল বৈষ্ণব কোমর বেঁধে ঘুষি বাগিয়ে পরস্পরের উদ্দেশে মারমুখী ভঙ্গিতে। একদল বৈষ্ণবের মাঝে কোনো বিশিষ্ট বৈষ্ণব দন্ডায়মান।”
এরকম অনাবিষ্কৃত, অনালোচিত পুঁথির পাটাচিত্রের সন্ধান আজ গ্রাম বাংলায় অনেক পাওয়া গেলেও, গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের সাথে সহজিয়া বৈষ্ণবদের এমন মারামারির দৃশ্য নিয়ে আর কোনো পুঁথির পাটাচিত্র অঙ্কিত হয়েছে কিনা জানা নেই। তবে, বর্তমানে ওই পুঁথি সহ তার পাটাচিত্র হারিয়ে গিয়েছে৷
৫. আর এক হারিয়ে যাওয়া পুঁথি হল, শ্রীধর দাসের সদুক্তিকর্ণামৃত। এই সদুক্তিকর্ণামৃতর কোনো পান্ডুলিপি আর অবশিষ্ট নেই। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্স সদুক্তিকর্ণামৃতর যে পাঠোদ্ধার করিয়েছিলেন, ওটাই একমাত্র সম্বল।
“সদুক্তিকর্ণামৃত” হল, লক্ষ্মণ সেনের সময়ের জনপ্রিয় কয়েকজন কবি, জয়দেব, শরণ, উমাপতিধর, ধোয়ী, গোবর্ধন আচার্য ছাড়াও ধ্রুপদী যুগের লেখক যেমন, কালিদাস, ভবভূতি, অমরু, প্রবরসেন, রাজশেখর, বরাহমিহির, বিশাখদত্ত প্রভৃতি বাঙালি কবির লেখা কিছু বিখ্যাত ও জনপ্রিয় শ্লোক সংগ্রহ করে লেখা এক সংকলন। এর মধ্যে বল্লালসেন, লক্ষ্মণ সেন, কেশবসেন প্রমুখ রাজকবির শ্লোকও স্থান পায়। এরকম প্রায় ৪৭৫ টিরও অধিক কবির রচিত প্রায় ২৩৭০ টি শ্লোক / পংক্তি (যার মধ্যে আবার অনেকগুলো শ্লোকের রচয়িতার নাম জানতেন না শ্রীধর দাস। সেযুগে বিখ্যাত শ্লোক হিসাবে শ্লোক গুলো নথিবদ্ধ করেছেন শ্রীধর দাস) উদ্ধৃত করার মাধ্যমে শ্রীধর দাস সংকলিত কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিল “সদুক্তিকর্ণামৃত” নামে৷
লক্ষ্মণ সেনের পঞ্চরত্নের একজন, উমাপতিধর। এর কোনো মুখ্য রচনা আজও পাওয়া যায়নি। একমাত্র লক্ষ্মণ সেনের পিতামহ বিজয়সেনের দেওপাড়া শিলালেখটি উমাপতিধর রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। আর জয়দেবের গীতগোবিন্দতে উমাপতিধরের একটু প্রশংসা শোনা যায় শুধু। কিন্তু, শ্রীধর দাসের সদুক্তিকর্ণামৃততে উমাপতিধরের বিখ্যাত ৯২ টি শ্লোক স্থান পেয়েছে৷
অতএব, বোঝা যাচ্ছে সদুক্তিকর্ণামৃতর গুরুত্ব। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এর পান্ডুলিপি আর একটাও নেই। হারিয়ে গিয়েছে৷
এরকমই হারিয়ে যাওয়া পুঁথির নমুনা দেখাতে গেলে অকারণে হতাশা ছাড়া আর কিছুই জুটবে না। আমাদের এইসব পুঁথি যে এক মুল্যবান সম্পদ, আশা করি যথেষ্ট বোঝাতে পারলাম। পুঁথিগুলোর দুরবস্থা সম্পর্কে এতক্ষন অনেক কিছুই লিখলাম। এবার গৌড়-বঙ্গে রচিত সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য, গীতগোবিন্দকে নিয়ে কিছু তথ্য ও তার দার্শনিক গুরুত্ব আলোচনা করে লেখাটা সমাপ্ত করি। বলা বাহুল্য, বাঙালির গীতগোবিন্দ নিয়েও যা টানাহেঁচড়া চলছে বোধহয় এই মূল্যবান সম্পদটিও খুব দ্রুত হারিয়ে যাবে বাঙালির ইতিহাস থেকে।
জয়দেব ও তার রচিত গীতগোবিন্দ বাঙালি জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, জয়দেবের গীতগোবিন্দই আমাদের প্রথম বুঝতে শিখিয়েছিল “রাধা ব্যাতিত কৃষ্ণ সম্ভব নয়”৷
চর্চার অভাবে, গুরুত্বের অভাবে, ঔদাসিন্যে বাঙালির এই অমুল্য সম্পদটিও চুরি হয়ে গেছে। কারা চুরি করেছে?? পাশের রাজ্য, উড়িষ্যা…!!! বলা বাহুল্য, আর এক অমূল্য সম্পদ, “সদুক্তিকর্ণামৃত” র পান্ডুলিপিও হারিয়ে গেছে ওই ঔদাসিন্যে।
সরকারি মদতে এমন চুরি নজিরবিহীন…!! ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। চুরির নমুনা দেখুন –
১. ইন্টারনেট ঘাঁটলে ১২ শতকের (12 th Common Era, মানে ১১০০ থেকে ১২০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত। এটাই লক্ষ্মণ সেনের সময়কাল।) লেখা গীতগোবিন্দের পান্ডুলিপির আসল তথ্য সহ ছবি কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। সব জায়গায় দেখা যাবে উড়িয়া লিপিতে তালপাতার পান্ডুলিপি গীতগোবিন্দ। উড়েদের দাবী, গীতগোবিন্দ উড়িয়া(?? নাকি সংস্কৃত?) ভাষায় উড়িয়া লিপিতে লিখেছিল জয়দেব!
অথচ ইতিহাস বলছে, জয়দেবের গীতগোবিন্দর একটি পান্ডুলিপি আবিষ্কার করেছিলেন স্যার উইলিয়াম জোন্স। যিনি ওই গীতগোবিন্দের ইংরেজি অনুবাদ করে ইউরোপে ভারতীয় সংস্কৃতির মাধুর্য সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। এবং ওই থেকেই বিশ্ববিখ্যাত সারস্বত প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সদুক্তিকর্ণামৃতের পান্ডুলিপিরও পাঠোদ্ধার করিয়েছিলেন স্যার উইলিয়াম জোন্স। তবে উভয় পান্ডুলিপি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয় (এর মধ্যে সদুক্তিকর্ণামৃতর পান্ডুলিপি তো হারিয়েই গেছে। অন্যটিরও হারিয়ে যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়)। তার বদলে “সমসাময়িক” (যদিও অনেক পরে রচিত) সময়ে রচিত পরিস্কার বাংলা লিপিতে লেখা বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভগবত’ পান্ডুলিপি এশিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরিতে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে৷
বাংলা লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা গীতগোবিন্দের পান্ডুলিপি কিছু আছে। তবে, সেগুলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সংগ্রহশালায় গীতগোবিন্দের একটা পান্ডুলিপি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত আছে, যেটা বাংলা লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা। তবে ওটা দ্বাদশ শতকের লেখা পান্ডুলিপি নয়। ওটা সপ্তদশ শতকে (অর্থাৎ ১৬০০ থেকে ১৭০০ খ্রীস্টাব্দে) লেখা গীতগোবিন্দের পান্ডুলিপি৷

২. উড়িষ্যার সরকারি মদতে একটা চক্র ক্রমাগত ইতিহাসবিকৃত করে জয়দেবকে উড়িয়া বলে, পুরীর অদূরে কেন্দুলি শ্মশান নামক গ্রামে জয়দেবের জন্মস্থান হিসাবে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে৷
অথচ জয়দেবের আসল জন্মস্থান হল বীরভূমের সিউড়ির অদূরে অজয় নদীর তীরে কেন্দুলি গ্রামে। সেই মধ্যযুগ থেকে আজও পৌষ মাসে বিখ্যাত জয়দেব মেলা হয় কেন্দুলিতে। সেই মেলায় যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা পরিস্কার দেখেছেন ওখানে জয়দেব ও পদ্মাবতীর নাম মুখে মুখে ফেরে এবং ওদের মন্দিরও আছে ওখানে। বাউল ও কীর্তনীয়াদের বিপুল সমাগমের এমন বিখ্যাত মেলা হয় একমাত্র বীরভূমের কেন্দুলির জয়দেব মেলায়, জয়দেবের স্মরণে৷
৩. উড়েদের দাবী, জয়দেব কস্মিনকালেও লক্ষ্মনসেনের রাজসভায় যাননি। গীতগোবিন্দ রচিত হয়েছে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সামনে বসে! এই মর্মে ওরা কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়ে একটা স্ট্যাম্পও প্রকাশ করিয়েছে। এমনকি ২০১১ সালে প্রজাতন্ত্র দিবসে উড়িষ্যার ট্যাবলয়েডে দেখা গিয়েছিল জয়দেব গীতগোবিন্দ রচনা করছে, জয়দেবের ঠিক পিছনেই পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির৷
কিন্তু গুজরাট থেকে প্রাপ্ত একটা মিনিয়েচার পেইন্টিং ইঙ্গিত করছে লক্ষ্মনসেনের সভার পঞ্চরত্নের ছবিতে জয়দেবের উপস্থিতি!

৪. কৌন বনেগা ক্রোড়পতি নামে অমিতাভ বচ্চনের একটা টেলিভিশন অনুষ্ঠানে জয়দেবকে লক্ষ্মণসেনের সভাকবি বলার অপরাধে উড়িষ্যা থেকে মামলা করা হয়েছিল!
উড়িষ্যা সরকারের এই বিপুল উদ্যোগ আর মদতে আজও ইন্টারনেটে সমস্ত রিসোর্সে দেখা যাবে জয়দেব উড়িয়া কবি!
এরকম চুরি নতুন নয়৷ এর আগেও বাঙালির চর্যাপদ চুরি করেছে উড়ে রা। এর ফল হল, উড়িয়া ভাষার ধ্রুপদী মর্যাদা জুটে গেল। বাংলা ভাষা আর বাঙালির কপালে ফাঁকা হাড়ি জুটল (যার আওয়াজটাও আবার জোরালো নয়)৷
এবার বোঝা যাচ্ছে, জয়দেব ও তার রচিত গীতগোবিন্দর গুরুত্ব??!! এত চুরি সত্বেও “দর্শন” টা তো আর চুরি করা যায় না। গীতগোবিন্দের মধ্যে নিহিত বাঙালির নিজিস্ব দর্শন সম্পর্কে গবেষণাতেও বাঙালি গবেষকদের অনীহা চোখে পড়ার মত। মাত্র দুজন, প্রশান্ত দাশগুপ্ত এবং হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় জয়দেব ও গীতগোবিন্দ নিয়ে কাজ করেছেন। বর্তমানে এই দু’জনে প্রায়ত। এবং এখন একমাত্র তমাল দাশগুপ্ত নিজস্ব উদ্যোগে গীতগোবিন্দের দার্শনিক গুরুত্ব বাঙালির সামনে আনার চেষ্টা করেছেন ও যুক্তি দিয়ে এইসব উড়িয়া দাবী খন্ডন করেছেন মাত্র, তাও বহু হুমকি, বহু বাধা বিপত্তির ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে৷
এবার একটু গীতগোবিন্দের দার্শনিক গুরুত্বটা অনুধাবন করা যাক। তবেই তো বোঝা যাবে গীতগোবিন্দ আসলে কি জিনিস!
১. লক্ষ্মনসেনের পঞ্চরত্নের একজন জয়দেবের রচিত গীতগোবিন্দ। গীতগোবিন্দ সম্পর্কে ইতিহাসবিদ নিহাররঞ্জন রায় বলেছেন –
“রাধাকৃষ্ণর প্রেমলীলার উপর শ্রুতিমধুর, শৃঙ্গার ভাবনাময়, রসাবেশময় গানের রচয়িতা হিসাবে জয়দেবের পক্ষে রসিক বৈষ্ণব সমাজে এবং জনগনের মধ্যে প্রতিষ্ঠালাভ সহজেই সম্ভব হয়েছিল। পরে একবার যখন গীতগোবিন্দ চৈতন্যোত্তর গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অন্যতম মূল প্রেরণা বলে স্বীকৃত হইল, তখন গীতগোবিন্দ হয়ে উঠিল ধর্মগ্রন্থ এবং জয়দেব হইলেন দিব্যোন্মাদ সাধক”৷
কি বোঝা গেল? গীতগোবিন্দ একসময় “ধর্মগ্রন্থ” মর্যাদা পেয়েছিল। এই মর্যাদার বলে গীতগোবিন্দ দেশের সর্বত্র বিভিন্ন লিপিতে কপি সংস্করণ বেরিয়েছিল। (সেযুগে তো আর ছাপাখানা ছিল না, যা হত সবই এই হাতে লেখা তালপাতার পুঁথি। বই এর মত বিক্রিও হত কপি করে লেখা। অবশ্য সংস্কৃত ভাষায়। মনে রাখতে হবে, সংস্কৃত কেবলমাত্র ভাষা, এর নিজস্ব কোনো লিপি নেই। সংস্কৃত ভাষা আঞ্চলিক লিপি দিয়েই প্রকাশ হত সারা দেশের অঞ্চলভেদে।)৷
২. বর্তমানে যেমন “বন্দেমাতরম” একটা স্লোগান বা জয়ধ্বনী। ঠিক সেইরকমই একটা স্লোগান বা জয়ধ্বনী মধ্যযুগের প্রথম দিকে সম্রাট লক্ষ্মনসেনের সময়ে ছিল “রাধামাধবয়োর্জয়ন্তী”। এটা কোথা থেকে গৃহীত বলুন তো? এই জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে গৃহীত৷

৩. এই গীতগোবিন্দের আর এক অমর পংক্তি “দেহি পদপল্লবমুদারম” এটাই হল বাঙালির নিজস্ব দর্শনের প্রমাণ। দেহি পদপল্লবমুদারম অর্থাৎ শ্রীরাধার পা ধরে সাধনারত কৃষ্ণ। যেটা বাঙালির আবহমানকালের নিজস্ব দর্শন। ঠিক যেমনটা মা কালীর পায়ের নীচে শুয়ে থাকা শিব, অর্থাৎ “শক্তির পায়ের তলায় শুয়ে থাকা শিব”৷
কি বোঝা গেল? বাংলার অবৈদিক ঐতিহ্য, “প্রকৃতি” কে খুঁজে পাওয়া গেল গীতগোবিন্দতে? প্রকৃতি, যাকে ইংরেজিতে বলে Feminine Principle. যেটা দার্শনিক দৃষ্টিতে বৈষ্ণবের রাধা আর শাক্তের কালী বা দুর্গা। এই প্রকৃতির উপাসনা বাঙালির নিজস্ব উত্তরাধিকার। এই দর্শন বাঙালির নিজস্ব উদ্ভাবন৷


৪. দর্শন বিষয়ে প্রচলিত “সাপ্লিমেন্ট” নামে একটা শব্দের মর্ম বুঝতে হবে। সাপ্লিমেন্ট এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে “সম্পূরক”। দর্শনে কিছু সাপ্লিমেন্ট মূল টেক্সট বা কনসেপ্টকে ছাপিয়ে যেতে পারে। যেমন, মৌখিক ভাষার সাপ্লিমেন্ট হিসাবে মানুষ একসময় উদ্ভাবন করেছিল লিপি। লিপি শুরুতে ভাষার ‘সম্পুরক’ বা ‘সাপ্লিমেন্ট’ হিসাবে কাজ করে, কিন্তু গুরুত্বের বিচারে লিপি, ভাষাকেও ছাপিয়ে যায়৷
ঠিক তেমনই দার্শনিক দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে, জয়দেবের গীতগোবিন্দতে অসামান্য মধুর রাধা ভাবনা হল বৃন্দাবনে কৃষ্ণের গোপীপরিবৃত প্রেমলীলার সাপ্লিমেন্ট। এবং স্বাভাবিকভাবেই এই সাপ্লিমেন্ট গুলো তাদের অরিজিনালকে ছাপিয়ে গেছে। এবং এটাই কৃষ্ণচরিত্রকে সুমহান করে তুলেছে। কাজেই, শ্রীরাধাকে বাদ দিয়ে আজ আর কোনো কৃষ্ণ সম্ভব নয়, ঠিক যেমনটা বর্ণমালাকে বাদ দিলে ভাষা আর দাঁড়াতে পারে না৷
এই হল গীতগোবিন্দের “দর্শন”। যা “মাতৃকা উপাসক” বাঙালির আবহমানকালের নিজস্ব দর্শন। যেটা উড়ে দের মধ্যে নেই৷
বোঝা গেল এবার, কেন “রাধা ব্যাতিত কৃষ্ণ সম্ভব নয়” এবং বাংলার পুঁথি ও তার পাটাচিত্র কেন খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালির দুর্ভাগ্য, ধীরে ধীরে এইসব অমূল্য সম্পদ হারিয়ে যাচ্ছে৷
তথ্যসূত্রঃ-
১. “The Radha Idea at the Crossroads of History, Culture and Politics: Gitagovinda and the Boishnob Movement in Bengal”. By Tamal Dasgupta, Journal of Bengali Studies, Vol. 3, No. 1, 14 May 2014, Buddhapurnima, 30 Boishakh 1421, Summer Issue.
২. বাঙালির সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ইতিহাস ১৫ সেনযুগ – সঙ্ঘর্ষ, সমন্বয়, সৃষ্টি, সপ্তডিঙা কালীপুজো সংখ্যা ১৪২৫, Shoptodina Vol 4 No 4 2018, ISSN 2395 6054, – ডঃ তমাল দাশগুপ্ত।
৩. গীতগোবিন্দ ও ভারত-সংস্কৃতি। The Asiatic Society publication, November 2019.
৪. বাংলার চিত্রকলা মধ্যযুগ থেকে কালীঘাট – অঞ্জন সেন৷
৫. বাংলা পান্ডুলিপি পাঠ পরিক্রমা – ত্রিপুরা বসু৷
৬. সরসীকুমার সরস্বতী – পাল যুগের চিত্রকলা৷
৭. বাংলার চিত্রকলা – অশোক ভট্টাচার্য।