দুর্গা – শ্রীরাধাবিনোদ ঠাকুর গোস্বামী (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

“দুর্গা” শব্দটি নানার্থ বোধক | যিনি দুর্জ্ঞেয়া , অর্থাৎ যাঁকে জানা সহজ সাধ্য নয় | যিনি দূরধিগম্যা | পৌরুষের অভিমান , বল-বীর্য্য , জ্ঞান-বুদ্ধি কোনকিছুর দ্বারায় তিনি অধিগম্যা নন | তিনি যদি কৃপা করে নিজেকে জানান , তবেই তাঁকে জানা যায় | দুর্গা আদ্যা-শক্তি | তাই এখানে শক্তির সাপেক্ষহীনতা এবং স্বপ্রকাশতা ব্যক্ত হচ্ছে | শক্তি যেহেতু সর্বব্যাপিকা , সর্বত্র শক্তিরই খেলা , তাই শক্তি বাদ দিয়ে তো কিছু নেই , যা দিয়ে শক্তিকে জানা যেতে পারে | জানতে গেলে যা লাগবে , তাও তো শক্তিই | জ্ঞান-শক্তি | অতএব শক্তি দিয়েই শক্তিকে জানতে হবে , বুঝতে হবে | তাই শক্তির দ্বারাই বা কৃপাতেই শক্তিকে জানা সম্ভব | অন্য কোনও উপায় নেই | এই কারনেই তিনি দুর্জ্ঞেয়া বা দূরধিগম্যা | স্ব-প্রকাশে বা স্ব-কৃপাতে লোকমননে সুজ্ঞেয়া হন | 

     “দুর্গো দৈত্যে মহাবিঘ্নে ভববন্ধে চ কর্মণি |

      শোকে দুঃখে চ নরকে যমদন্ডে চ জন্মনি ||

      মহাভয়ে অতিরোগেচাপ্যাশব্দঃ অম্ভৃ বাচকঃ|

      এতান্ হন্ত্যেব যা দেবী সা দুর্গা পরিকীর্ত্তিতা ||”

                     (ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ,প্রকৃতিখন্ড/৫৩) |

‘দুর্গ’ শব্দে দৈত্য , মহাবিঘ্ন , ভববন্ধন , কর্ম , শোক , দুঃখ , নরক , যমদন্ড , জন্ম , মহাভয় , অতিরোগ এবং ‘আ’ শব্দে হনন —-যিনি এই সকলকে হনন অর্থাৎ ছেদন করেন , তিনিই দুর্গা নামে অভিহিতা | জীবন পথে অগ্রগতির বাধা-বিঘ্ন , সংসারে ব্যবহারিক নানাপ্রকার বন্ধন , কর্মের তিক্ততা ও শ্রম-ফল প্রাপ্তির প্রতিবন্ধকতা , প্রিয়-বিচ্ছেদ-জাত শোক , অভিলষিত অপ্রাপ্তি জনিত দুঃখ , জীবন-যন্ত্রণা ও অবসাদ রূপ নরক , কর্ম ফলের আঘাত রূপ যমদন্ড , জন্ম-কষ্ট(যে জন্ম দিচ্ছে , যে জন্মগ্রহণ করছে ও তার বলয়ের প্রিয়বর্গের মন:কষ্ট বা উদ্বেগ) , নানান ভীতির মূল মৃত্যুভয় , দূরারোগ্য ব্যাধি ইত্যাদি তো জীবনের অঙ্গ | জীবন থাকলেই এগুলো থাকবে | এই সব অতিক্রম করতে বা এই সমস্ত যন্ত্রণা রূপ বদ্ধ-দুর্গ থেকে মুক্তি পেতে যা যা লাগে , সেই সমস্তের মূলে রয়েছে মূলতঃ উদ্যম-শক্তি , বলীয়সী মানসিক-শক্তি ও অফুরন্ত প্রাণ-শক্তি | দেখুন , সবগুলোই শক্তি | যাকে ‘আ’ বাচক বলা হয়েছে | অর্থাৎ এই সমস্ত কিছু অতিক্রম করার শক্তি বা হনন করার শক্তি | এটিই দুর্গা-বিজ্ঞান | 

       শাস্ত্রবচনে রয়েছে ,

      “দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্ত্তিতঃ |

       উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মতঃ ||

       রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ |

       ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্ত্তিতঃ ||”

অর্থাৎ , ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক | ‘উ’ কার বিঘ্নবিনাশক | ‘রেফ্’ রোগনাশক | ‘গ’ কার পাপনাশক এবং ‘আ’ কার ভয়-শত্রুনাশক | দৈত্য , বিঘ্ন , রোগ , ভয় এবং পাপ রূপ শত্রুর থেকে যিনি রক্ষা করেন , তিনিই দুর্গা | ‘দ’ মানে দৈন্য-বোধিকা শক্তি | আবার ‘দ’ অর্থাৎ দম্ভ | যা দৈত্যের মতোই সর্ব্বগ্রাসী | আমাদের জীবনের নমনীয়তা , শিক্ষা , সংস্কার সব গ্রাস করে আমাদের উদ্ধত তথা উচ্ছৃঙ্খল করে  | এটা একপ্রকার মদ বা মত্ততা | কোন গুরুজ্ঞান থাকেনা | এই কারনে শাস্ত্রে অভিমানকে সুরাপানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে | “অভিমানং সুরাপানম্” | যা পক্ষান্তরে ধ্বংসের পথকেই প্রশস্ত করে | এই জন্যেই বলা হয়েছে , দম্ভ বা অহংকারের মতো বড় শত্রু নাই–‘নাহংকারাৎ পরোরিপুঃ’ | জগজ্জননী শরণাগতের প্রাণে বিদ্যার সার বিনয় জাগিয়ে এই দম্ভ-দৈত্যকে নিধন করেন | যার মূলে থাকে দৈন্য-বোধিকা শক্তির উদ্বোধন | ‘উ’ অর্থাৎ বিঘ্নবিনাশিকা শক্তি | ঊর্জ্জা | তেজস্বীতা | প্রবল মনোবল | আবার ‘উ’ মানে উদ্ভ্রান্তি | যা মন:-বিক্ষেপ থেকে আসে | যাকে অমনোযোগিতা বা অন্যমনস্কতাও বলা চলে | যা কর্মক্ষেত্রে ভ্রান্তি উৎপন্ন করে | আর ভ্রান্তি কর্ম-প্রাঙ্গণে অবাঞ্ছিত বিঘ্ন বৈকি | পরিস্থিতির অনুকূল প্রবল মনোবল জাত একাগ্রতা-শক্তি জাগিয়ে মা এই ভ্রান্তি-বিঘ্ন থেকে আমাদের উদ্ধার করেন | যার মূলে থাকে ঊর্জ্জা-শক্তির ক্রিয়া | ‘রেফ্’ রোগ-নাশিকা শক্তি | অসংযমী জীবন যাপন রোগের কারন | জীববৎসলা মা আশ্রিতের জীবনে সংযম শক্তি জাগিয়ে দেহ ও মন নির্মল করেন | ক্রমে রোগপ্রতিরোধিকা-শক্তি এবং প্রাণ-শক্তি বাড়ে | যাতে দেহ-রোগ–ব্যাধি এবং মনোরোগ–আধি নাশ প্রাপ্ত হয় | এখানে মা “সর্ব্বরোগবিনাশিনী” | ‘গ’ অঘ-নাশিকা শক্তি | অঘ মানে পাপ | লাগাম ছাড়া লোভ-লালসা থেকেই পাপ-প্রবৃত্তি জাগে | যা অন্ধকারময় | তাই একে ‘গু’ বলা হয় | আর ‘রু’ হল আলো -“গু-শব্দস্ত্বন্ধকারস্যাৎ রু-শব্দস্তন্নিরাসকঃ” | পাপান্ধকার থেকে তুলে ধরেন যিনি জ্ঞানের আলো জ্বেলে , তিনিই তো ‘গুরু’ | জীবনে আদর্শ-গুরু রূপে ধরা দিয়ে চিত্তে জমে থাকা জন্মজন্মান্তরের পাপ-প্রবৃত্তির সংহার করেন গুরুরূপা মা | ‘আ’ হল ভয়নাশিকা-শক্তি | আবার ‘আ’ মানে আবেশ বা অভিনিবেশ | শ্রুতি বলেন , “ভয়ং দ্বিতীয়াভিনিবেশতঃ” | অর্থাৎ , ভয় হয় দ্বিতীয় বস্তুতে অভিনিবেশ থেকে | দ্বিতীয় শব্দটি সাপেক্ষ শব্দ | প্রথম না হলে দ্বিতীয় হয়| তাহলে , প্রথম বস্তু কী ? প্রথম বস্তু হল আত্মা | আর দ্বিতীয় বস্তু হল দেহ | দেহে যতখানি অভিনিবেশ , ভয়ও ততোধিক | মা পরমকরুণায় জীবনে সাধন-সঞ্চার করে আবেশ বা নিবেশ দেহের থেকে আত্মাতে স্থিত করেন | তখন আপনা হতেই সব ভয় অপসারিত হয় | এখানে মা অভয়া , অভয়দা |

          আবার যিনি ‘দুর্গ’ নামক অসুরকে নাশ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে প্রকৃষ্টরূপে কীর্ত্তিতা হন –“দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্ত্তিতা |”(শব্দকল্পদ্রুম,৩/১৬৬৬) | আমাদের জীবনে আমরাই সুকর্ম অথবা দুষ্কর্মের দুর্গ রচনা করি | যার জের , সংস্কার হয়ে জন্ম-জন্মান্তর ধরে আমাদের বন্ধনের কারন হতে থাকে | নিজকৃত সেই দুর্গের ভেতরে নিজেই কখন বন্দি হয়ে পড়ি , বুঝতেও পারি না | “আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা , দোষ কারো নয়’গো মা” (শ্রী দাশরথি রায়) | এই বন্দী দুর্দশা থেকে উদ্ধার করবে কে ? তিনি একমাত্র মহাশক্তি | যিনি ত্রিলোক উদ্ধারের হেতু বা কারন | যুগে-যুগে , কল্পে-কল্পে , সময়ে-সময়ে তাঁর দ্বারায় এই উদ্ধার কার্য্য সাধিত হয়ে থাকে | আবদ্ধ ব্যক্তিকে মুক্ত করতে যে প্রবল সামর্থ্য বা শক্তির প্রয়োজন , তা তো তিনিই বা তাঁরই পরিনতি | পক্ষান্তরে একে করুণা-শক্তি বা কৃপা-শক্তিও বলা যায় |  তা সে সংসার-জটিলতার থেকে মুক্তি হোক বা ভববন্ধন থেকেই চিরমুক্তি হোক | এইজন্যেই দুর্গাপূজার নবপত্রিকা প্রবেশ-মন্ত্রে উদঘোষিত হয়—“ত্রৈলোক্যোদ্ধারহেতুস্ত্বং অবতীর্ণা যুগে যুগে |” 

     শ্রীশ্রীচন্ডীতে রয়েছে , দুর্গম নামক অসুরকে বধ করে মায়ের নাম দুর্গা | দুর্গম-অসুরের কাজ হল জীবকে দুর্গতি দেওয়া | দুর্গমকে বধ করে যিনি জীবজগৎকে অশেষ দুর্গতির হাত থেকে অব্যাহতি দেন , তিনি মা দুর্গা | তাই ভ্রষ্ট-রাজ্য যুধিষ্ঠির অসহনীয় দুর্গতি থেকে মুক্ত হবার জন্য মহাভারতের বিরাটপর্ব্বের ষষ্ঠ অধ্যায়ে দুর্গাদেবীর স্তোত্রে বলছেন , “দুর্গাৎ তারয়সে দুর্গে তৎ ত্বং দুর্গা স্মৃতা জনৈঃ |” দুর্গমাসুরের দুইটি রূপ | সংসার পথে এই অসুরের নাম স্বার্থান্ধতা এবং আধ্যাত্মিক পথে এই অসুরের নাম অবিদ্যা | দুর্গম স্বার্থান্ধতায় মজে জীব অশেষ দুর্গতি ভোগ করে | তা থেকে মা রক্ষা করেন লোক-কল্যাণ-ময়ী বুদ্ধি বৃত্তি জাগ্রত করে | দুর্গম অবিদ্যার অধীন হয়ে জীব দুঃখে জর্জরিত হয় মায়ার খাদে পড়ে | তা থেকে সন্তানকে বাঁচান মা জ্ঞান -অসি দ্বারা অবিদ্যা-বন্ধন ছেদন করে | জীবের চরম দুর্গতি হয় তখনই , যখন সে রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে হয় বিচ্যুত | মহাশক্তি মহামায়া ভগবতী দুর্গা হলেন রাষ্ট্রাধিশ্বরী | ঋগ্বেদের দেবী-সূক্তের-“অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসূনাম্ / চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্ “-এই মন্ত্রাংশটি এর সাক্ষ্য প্রদান করছে | স্থূলভাবে দেখতে গেলে এই কথাটির অর্থ হল–‘আমি রাষ্ট্রের অধিশ্বরী , আমারই অনুগ্রহে যজমান অর্থ লাভ করে থাকে |’ কিন্তু এর তাৎপর্য্য সুদূরপ্রসারী | পারত্রিক অভ্যুদয়ের মূলে রয়েছে যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান , যা অর্থ ছাড়া সম্ভবপর নয় | জাগতিক অভ্যুদয়ের মূলেও রয়েছে অর্থ | কিন্তু রাষ্ট্রচ্যুত হলে অর্থপ্রাপ্তি এবং প্রাপ্ত অর্থের রক্ষণ পদে পদে বিঘ্নিত হতে থাকে | মহিষাসুরের দ্বারা রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে ভ্রষ্ট হয়ে দেবগণের যে কী জাতীয় দুর্দ্দশা হয়েছিল তার বিবরণ আমরা মার্কন্ডেয় পুরাণান্তর্গত দেবীমাহাত্ম্যাত্মক ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ গ্রন্থে দেখতে পাই | কিন্তু পরাজিতবর্গ যদি নিজেদের তেজ ও ত্যাগের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আততায়ীর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে ফিরে দাঁড়ায় , তখন এই সম্মিলিত শক্তির কাছে আসুরী শক্তি তিষ্ঠতে পারে না | দেববৃন্দ মহিষাসুরের দ্বারা নিপীড়িত হয়ে সংঘবদ্ধভাবে তার বিরুদ্ধে ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল | এর ফলে তাঁদের তেজোরাশি থেকে এক দেবীমূর্ত্তি আবির্ভূতা হলেন , ইনিই মহিষমর্দ্দিনী | দেবগণ তাঁদের শক্তিরূপিনী এই দেবীকে স্ব স্ব ভূষণ ও আয়ুধ প্রদান করে সজ্জিত করে দিলেন | এই কাজের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে তাঁদের অসামান্য ত্যাগের নিদর্শন | এই দেবীর দ্বারা মহিষাসুর নিহত হলেন | সংক্ষেপে বলতে গেলে মহিষমর্দ্দিনীর আবির্ভাবের মূলে রয়েছে প্রবল পরাক্রান্ত আততায়ীর বিরুদ্ধে প্রপীড়িতগণের সংঘবদ্ধ অভিযান | যার মূল প্রেরণাদায়ী শক্তি মা দুর্গা | তিনিই জনগণের সংঘবদ্ধ শক্তি | বিপ্লব-শক্তি | বাস্তবের মাটিতে ব্যক্তি-জীবনে , সমষ্টি-জীবনে , জাতি তথা রাষ্ট্র-জীবনে যার ক্রমবিকাশ শিক্ষা , চেতনা , বিপ্লব এবং মুক্তির মধ্যে দিয়ে লক্ষ্য করা যায় |

     বেদভাষ্যকার সায়নাচার্য্য বলেন যে , ঋগ্বেদের দশম-মন্ডলের ১২৫ সংখ্যক সূক্তে অম্ভৃণ-কন্যা ব্রহ্মবিদুষী ‘বাক্’ নিজে পরাশক্তির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে আত্মস্বরূপ সেই পরাশক্তির স্তুতি করেছেন | তার নাম ‘দেবীসূক্ত’ | তার সপ্তম-মন্ত্রে আছে , “অহং সুবে পিতরমস্য মূর্দ্ধন্ / মম যোনিরপ্স্বন্তঃসমুদ্রে | ততো বিতিষ্ঠে ভুবনানু বিশ্বো / তামূং দ্যাং বর্ষ্মণোপস্পৃশামি ||” এর অর্থ , ‘সর্ব্বোপরি যে জগতের পিতা , তাঁকেও আমি প্রসব করেছি | পরমজ্ঞান-সমুদ্রের অভ্যন্তরে আমার যোনিস্থান | সর্ব্বভুবনে আমি অনুপ্রবিষ্ট | ভূলোকের ঊর্দ্ধে যে দ্যুলোক আছে , তাও স্থির আছে আমি স্পর্শ করে আছি বলে |’ সুতরাং মূলশক্তির থেকেই নিখিলের প্রকাশ এবং বিকাশ | তিনি বিশ্ব-প্রসবিতা | স্নেহময়ী জননী | তাঁর নয়ন থেকে সতত করুণামৃতধারা নির্ঝরিত -“মায়ের স্নেহ-চক্ষে প্রেম-বক্ষে অমিয় ঝরে |” রণে তিনি যখন ভীষণা তখনও তাঁর চিত্ত কৃপা-পূর্ণ -“চিত্তে কৃপা সমর-নিষ্ঠুরতা চ দৃষ্টা |”(শ্রীশ্রীচন্ডী,২/২২) | হৃদয়ে মুক্তিপ্রদ কৃপা আর সমরে মৃত্যপ্রদ কঠোরতা | এইজন্যেই দুর্গা-ধ্যানমন্ত্রে দেখতে পাই , যখন তিনি সমরাঙ্গনে শত্রুক্ষয় করছেন , তখনও তাঁর বদন প্রসন্ন ও তিনি সন্তানের সব কামনার ফলদানকারিনী—-

         “শত্রুক্ষয়করিং দেবীং দৈত্যদানবদর্পহাম্ |      

          প্রসন্নবদনাং দেবীং সর্ব্বকামফলপ্রদাম্ ||”

 মায়ের এই দুই ভাবের সমন্বিত চেতনার মধ্যেই সৃষ্টি ও সংহারের বীজ লুক্কায়িত | যা নিরন্তর মৌহূর্ত্তিক ভাবে সংঘটিত হয়ে চলেছে জড়ে ও চেতনে | 

     সন্তানের জন্যেই মায়ের অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ | কিন্তু তিনি যখন বিশ্ব-প্রসবিতা , তখন অসুরগণ কী বিশ্ব ছাড়া ? তিনি তো অসুরদেরও মা | তাহলে এক সন্তানকে রাখছেন , আরেক সন্তানকে মারছেন কেন ? এর উত্তর সহজ | কারো দেহের কোনও অংশে যদি পচন ধরে তাহলে অভিজ্ঞ চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করে সেই দেহ বাদ দেন | এটি চিকিৎসা-বিজ্ঞানের এক পরিস্থিতি-সাপেক্ষ অবধারিত পদ্ধতি | এর মানে , চিকিৎসক সেই রোগীর ক্ষতি করলেন না , বরঞ্চ তার অঙ্গচ্ছেদ করে তাকে নির্ধারিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষাই করলেন | নইলে সেই পচন সর্বাঙ্গে ছড়াতো ও রোগীটির মৃত্যুই ঘটতো | ঠিক তেমনি , অশুভ-বৃত্তি সম্পন্ন অসুরগণ সমাজ-শরীরের পচে যাওয়া অঙ্গ | মা অসুর-সংশোধনার্থে প্রথমে বাক্য প্রয়োগ করে সৎ-প্রেরণায় তাদেরকে প্রাণিত করতে চান | কিন্তু তার ফল হয় উল্টো | অসুরগণ তাদের স্বভাবসিদ্ধ প্রবৃত্তিতে এটি মা’র দুর্বলতা ভেবে মাকেই ভোগ করতে উদ্যত হয় | তখন গত্যন্তর না দেখে ইন্দ্রিয়-মন বিশিষ্ট অসুরদের ঐ বিকারগ্রস্ত পঞ্চভৌতিক দেহকেই মা বিনষ্ট করেন | এতে সমাজ-কলেবর রোগমুক্ত হয় ও সমাজস্থিত শিষ্টগণ শান্তি প্রাপ্ত হন | যা জগতে প্রামাণিক ভাবে শুভশক্তির প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে সহযোগী হয় | ধ্বংস হয় অসুর-দেহের | কিন্তু অবিনাশী আত্মা অভিন্ন-পরমাত্মা মহাশক্তিতে বিলীন বা সম্মিলিত হয়ে বিমুক্ত হয়ে যায় | যাঁদের রক্ষা করে পালন করতে মায়ের অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় , তাঁদেরও  আগে অসুরগণকে উদ্ধার করেন জীববৎসলা মা | এতেই তাঁর সর্বাধিক করুণার প্রকাশ | আর রণ-নিষ্ঠুরতা তো করুণা প্রকাশের প্রক্রিয়া মাত্র | অসুরেরা যে পরিমান পাপকার্য্য করে , তাতে তাদের  বিচার যদি যমরাজের বিধিমত হয় , তাহলে তাদের কোটি কোটি কল্প কাল নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় | কিন্তু জগজ্জননীর শস্ত্র স্পর্শে পূত হয়ে তারা পরমগতি লাভ করে | মা’র চিত্তে কৃপা আছে বলেই অসুরদের পক্ষে এতক্ষণ মায়েরই দেওয়া শক্তিতে মা’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব হয়ে থাকে | এ যেন মায়ের রণ-রসাস্বাদনের খেলা | 

   মায়ের দশটি বাহু | দশ (১০) সংখ্যার মধ্যে আছে এক(১) এবং শূন্য (০) | সংখ্যাতত্ত্বে প্রথমে অব্যক্ত রূপে শূন্যের (০) অস্তিত্ব | তারপর এক (১) , দুই (২) , তিন (৩) , চার (৪) , পাঁচ (৫) , ছয় (৬) , সাত (৭) , আট (৮) , নয় (৯) যুক্ত হলে তারপর দশ (১০)।দশ(১০) সংখ্যায় একের(১) পর আবার সেই শূন্য(০) | তাৎপর্য্য হল , সৃষ্টির আদিতে অব্যক্ত-শক্তি রূপে শক্তি ছিল শূন্যের (০) মতো | সেই শক্তি বিক্ষুব্ধ হলে জগত রূপেতে পরিণামিত বা ব্যক্ত হতে থাকল ঠিক এক(১) থেকে পর পর নয়ের(৯) মতো | আবার ব্যক্ত জগত লয় প্রাপ্ত হলে সেই অব্যক্ত শক্তিই অবশিষ্ট থাকে ঠিক দশ(১০) সংখ্যায় একের(১) পরে শূন্যের(০) মত | অর্থাৎ আদিতেও অব্যক্ত শক্তি , সৃষ্ট্যাদি কর্মের মধ্যেও সেই শক্তিরই ক্রিয়ান্বয়ন , আবার লয়ের পরেও শক্তিরই অস্তিত্ত্ব | আদিতেও শক্তি , মধ্যেও শক্তি এবং অন্তেও শক্তি- 

        “বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে | 

        তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতঃ অস্য জগন্ময়ে ||”

                                              (শ্রীশ্রীচন্ডী,১/৭৬) | 

এই মর্ম্মই যেন অভিব্যক্ত হচ্ছে দুর্গার দশ হাতে | দিক দশটি | পূর্ব , পশ্চিম , উত্তর , দক্ষিণ , ঈশাণ , অগ্নি , নৈঋত , বায়ু , উর্দ্ধ এবং অধ: | এই দশ দিকেই দেবীর ব্যাপ্তি | মহাশক্তি সর্ব্বব্যাপিকা | দশ দিক থেকে দশ হাতে দেবী তাঁর সন্তানবর্গকে রক্ষা করেন | দশ সংখ্যাটি অসংখ্যের দ্যোতক | আমরা প্রচলিত কথায় বলি , ‘দশ জনে কী বলবে’ বা ‘দশ জনের মাঝে বলা ভাল’ ইত্যাদি | এসব ক্ষেত্রে দশ মানে শুধুমাত্র গুনে গুনে দশ জনই নয় | অপিতু অনেক | অসংখ্য | মায়ের অসংখ্য বাহু | মায়ের বাহুতে পালনী শক্তি | যেখানে যেখানে পালনী শক্তির বিকাশ সেখানে সেখানেই মায়ের বাহুর ক্রিয়া | মা অসংখ্য বাহু দ্বারা অসংখ্য সন্তানকে প্রতিপালন করেন নিরন্তর | দশ ভুজে মা দশপ্রহরণধারিনী | দশ হাতে মায়ের দশ অস্ত্র | যথা দুর্গা-ধ্যানমন্ত্রে- ,

       “ত্রিশূলং দক্ষিণে ধ্যেয়ং খড়্গং চক্রং ক্রমাদধঃ||

        তীক্ষ্ণবাণং তথাশক্তিং দক্ষিণেষু বিচিন্তয়েৎ ||

        খেটকং পূর্ণচাপঞ্চ পাশমঙ্কুশমেব চ |

        ঘন্টাং বা পরশুং বাপি বামতঃ সন্নিবেশয়েৎ ||”

অর্থাৎ , মায়ের ডানদিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলি ওপর থেকে নীচের দিকে যথাক্রমে ত্রিশূল , খড়্গ , চক্র , তীক্ষ্ণ-বাণ ও শক্তি | বাম দিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলি একই ক্রমে খেটক(ঢাল) , ধনু , পাশ , অঙ্কুশ ও ঘন্টা বা পরশু অর্থাৎ কুঠার/ফারসা | অস্ত্রগুলি প্রত্যেকটি আধ্যাত্মিক অর্থবাহী | যেমন ‘ত্রিশূল’ | তিনটি শূল দ্বারা জীবের স্থূল , সূক্ষ্ম ও কারণ এই তিন দেহ লয় করে সিদ্ধ দেহ জাগিয়ে দেন | ত্রিশূলের তিনটি ফলা অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যতের দ্যোতক | তারমধ্যে মাঝের ফলাটি একটু বেশী উঁচু | তাৎপর্য্য , অতীতে যা হয়েছে তা তো হয়েই গিয়েছে , বর্তমানটা গুরুত্বপূর্ণ | তাই উঁচু | কিংবা , বর্তমানে উঁচু অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ কর্ম সম্পাদন করলে ভবিষ্যৎ সুখকর হবে | ত্রিশূলের তিনটি ফলা সৃষ্টি-স্থিতি এবং লয়কেও জ্ঞাপিত করে | সূচিত করে জল , স্থল ও অন্তরিক্ষ শক্তিরই ক্রীড়াঙ্গন | ‘খড়্গ’ অর্থে তত্ত্ব-জ্ঞানের অসি | যার দ্বারা অজ্ঞানতা রূপ বৃক্ষের মূলচ্ছেদ করেন | খড়্গে চোখ আঁকা থাকে | তার মানে জ্ঞান-অসি চক্ষুষ্মান | সব দেখছে | কোথায় জ্ঞান , কোথায় অজ্ঞানতা | দেখে শুনে বিচার করে অজ্ঞান-জাড্যকে ছেদন করছে এবং নিজের মতোই জ্ঞান-চক্ষু জাগিয়ে দিচ্ছে | বিষ্ণু বা কৃষ্ণের মতো মায়ের হাতেও ‘চক্র’ | চক্র কাল-চক্রের পরিচায়ক | কাল বা সময়কে স্বহস্তাঙ্গুলিতে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন মা , তার গতির সদ্ব্যবহার করে | সময়ের গতিকে উপলব্ধি করে সময়ানুকূল কার্যসাধনই জীবনকে শোভিত করে , সুন্দর করে , করে সুষমামন্ডিত | তাই চক্রের নাম সু-দর্শন | আর এটাই সুন্দর এবং উন্নত দর্শন | তাই সু-দর্শন | এই কালরূপ চক্রে আমাদের জীবনচক্রও বিঘূর্ণিত | যা জন্ম-মরণাদি ক্রমে আমাদেরকে কর্মফল ভোগ করায় | ভাল ছেলের মতো মায়ের চরণে প্রপন্ন হতে পারলেই মা করুণা করে তার থেকে নিষ্কৃতি দেবেন | সময়ই তো আমাদেরকে মারে ও রাখে | কখনও সুসময় , কখনও দুঃসময় | এটিই চক্রের আদর এবং আঘাত | যা মায়ের হাতে | মায়ের বাধ্য সন্তান হতে পারলে আর ভয় থাকেনা | ‘তীক্ষ্ণ-বাণ’ মানে ধারালো তীর | ধনুক থেকে তীর ছোঁড়া হয় নির্দিষ্ট লক্ষ্যে | তীর লক্ষ্য ভেদ করে | সেই রকম সংসার থেকেই লক্ষ্য স্থির করে আমাদেরকে মাতৃপদে আত্মনিক্ষেপ করতে হবে | ধারাল তীরের অগ্রভাগ খুবই তীক্ষ্ণ | তেমনই সুতীক্ষ্ণ বিচার চাই জীবনে | সূক্ষ্ম-বিবেচনা চাই | তবেই তো হবে প্রকৃত কল্যাণ | এইরকম প্রতিটি আয়ুধের ব্যবহারিক ও পারমার্থিক তাৎপর্য্য আছে | 

       ধ্যানমন্ত্রে বর্ণিত আছে , ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন মা দুর্গা , ঠিক শ্রীকৃষ্ণের মতো–“ত্রিভঙ্গ-স্থান-সংস্থানাং”(মার্কন্ডেয়-পুরাণ) | মায়ের বামচরণ , কটি ও গ্রীবা ঈষৎ ভঙ্গিম | দক্ষিণচরণ রেখেছেন সিংহপৃষ্ঠে সোজা ভাবে–“দেব্যাস্তু দক্ষিণং পাদং সমং সিংহোপরি স্থিতম্ |” বামচরণের অঙ্গুষ্ঠ রেখেছেন অসুরের স্কন্ধোপরি–“কিঞ্চিদূর্ধ্বং তথা বামমঙ্গুষ্ঠং মহিষোপরি |” শ্রীশ্রীগীতা-মুখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ “যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত…..” মন্ত্রে যা বলতে চেয়েছেন , শ্রীশ্রীচন্ডীতে দেববৃন্দ সমক্ষে ভগবতী দুর্গা “যদা যদা বাধা দানবোথ্যা ভবিষ্যতি…” মন্ত্রে ঠিক একই কথা বলেছেন | কথার মর্ম্ম হল , যখনই যখনই ধর্ম বিঘ্নিত হয় ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয় , তখনই তখনই শিষ্টের পালন , দুষ্টের দমনে তাঁর আবির্ভাব হয়ে থাকে | এই শক্তিকে লক্ষ্য করেই বৈষ্ণবাচার্য্য শ্রীজীব গোস্বামিপাদ “শ্রীভগবৎ-সন্দর্ভ”-এ ‘গৌতমীয়-কল্প’-এর বচন উদ্ধৃত করেছেন , “যঃ কৃষ্ণ সৈব দুর্গা স্যাৎ / যা দুর্গা কৃষ্ণ এব সঃ |”

(প্রবন্ধের শুরুতে চিত্রটি খড়দহে শ্রীপাদ নিত্যানন্দ প্রভুর স্বহস্তে সূচিত ও অদ্যাবধি চলে আসা কাত্যায়নী দুর্গাপুজো)

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s