
‘মহালয়া’ শব্দটা কানে আসার সাথে সাথে নাকে এসে লাগে এক মিশ্র ঘ্রাণ। সে বড় পুরাতন ঘ্রাণ অথচ প্রতিবারই নতুনের আমেজ। ধূপ,ঘৃত প্রদীপ, ফুল-বেলপাতা,ফল,দুধ,মধু,চাল,সাবুদানা,ছোলা-মটর,নতুন কাপড় ইত্যাদি ইত্যাদির মিশ্রণে মিশ্রিত এক অপার্থিব ঘ্রাণ। চোখে ভাসে দশভুজা দেবীমূর্তি, লোকসমাগম, কানে বাজে ঢাকের বাদ্য। এইতো পুজা শুরু হয়ে গেলো।
অপরাপর ধর্মগুলো যখনও বঙ্গে আসে নি,বাঙালি যখনও বিভিন্ন ধর্মে ভাগ হয় নি,সেই সুপ্রাচীন কালের বাঙালির শরৎ কালের তথা সারাবছরের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গোৎসব। এখনো বলা হয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সব থেকে বড় উৎসব। যেহেতু বাঙালি ভাগ হয়েছে বিভিন্ন ধর্মে, ফলে বাংলাদেশে দুর্গোৎসব এখন হয়ে গেছে শুধু হিন্দুদের। কিন্তু গ্রাম বাংলা বা শহরেও এখনো অন্য ধর্মের অনেকেই স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহন করেন, আনন্দের অংশীদার হোন।
এবছর মহালয়ার দিন বাংলাদেশে এক ট্র্যাজেডি ঘটে গেলো! বিকাল নাগাদ ভালোই ছিলো সব। মহালয়ার গোধূলিতে উত্তর বঙ্গের পঞ্চগড়ে করতোয়া নদী পাড় হচ্ছিলেন পুণ্যার্থীরা। মহালয়া উপলক্ষেই নদীর ওপাড়ে বোধেশ্বরী দেবী মন্দিরে অর্চনা শেষে নদী পাড় হবার সময় মাঝি নৌকার ধারণ ক্ষমতার থেকে কয়েকগুণ বেশি যাত্রী তুলে ফেলে। মাঝ নদীতে এসেই ঘটলো নৌকাডুবি! আমি যখন লিখছি ইতোমধ্যে ৫০ জন মানুষ মারা গেছেন! নিখোঁজ আছেন আরও ৪০ জন প্রায়! কী ভয়াবহ! এতো বড় ট্র্যাজেডি ঘটে গেলো! মহালয়ার দিন থেকেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে আছে। তারউপর পূজা আসলে অশনিসংকেত তো একটা ভিতরে কাজ করেই। পূজা মানেই আনন্দ, হৈচৈ, রৈরৈ, ঢাকের বাদ্য,দেবীদর্শন,প্রসাদ খাওয়া,নতুন কাপড় এসবই হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা শুধু এসবের মধ্যেই থাকতে পারি না। বিষাদ,চাপাভয় কাজ করে। ইতোমধ্যে নির্মাণাধীন প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে সাতক্ষীরা,বরিশাল সহ বেশ কিছু জায়গায়। গতবছর অর্থাৎ ২০২১ সালে নোয়াখালী, চাঁদপুর,কুমিল্লাসহ কী ভয়াবহ অবস্থা ছিলো পূজায় দেশ বিদেশের মিডিয়া সে সবের কিছুটা তুলে ধরেছে। এ অবস্থা নতুন না,কিন্তু একবিংশ শতকেও এসব ঘটেই চলছে এটা দেশ ও জাতির জন্য দুঃখজনক এবং একই সাথে অসম্মানেরও। তবে সেসব ঘটনার বিচারও হচ্ছে বা প্রক্রিয়াধীন। এবছর আবার কোথায় কী হবে এই একটা আশংকা,চাপা ভয় এসব নিয়েই পূজোর উচ্ছ্বাস।
আজকাল ওপার বাংলায় বিশেষত কোলকাতায় যে থিম পূজোর ছড়াছড়ি, প্রায় শত বছর আগে পূর্ববঙ্গে ব্রিটিশদের কাঁপিয়ে দিয়েছিলো,ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো এমন একটি থিম পূজো। সে খবর আমরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ‘অর্ধেক জীবন’ এ পাই। তিনি লিখেছেন… ‘পঞ্চমীর দিন প্রতিমার আবরণ উন্মোচন করা হল। সকলেই হতবাক। অন্যান্য বছর ছিন্নমুণ্ড মহিষের দেহ ভেদ করে উত্থিত অর্ধেকটা দেখা যায় অসুরকে। এবারে মহিষাসুর সম্পূর্ণ দণ্ডায়মান, পুরোপুরি মিলিটারির পোশাক,বুট জুতো সমেত এবং তার মুখ অবিকল সাহেবদের মতন। অর্থাৎ ইংরেজ অসুর। আর দুর্গার ছোট ছেলে কার্তিক হচ্ছেন সুভাষ বসু, তিনিও সামরিক বেশে সজ্জিত,তীর-ধনুকের বদলে হাতে রাইফেল,সেটা অসুরের বুকে তাক করা। ‘
মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছিলো সে খবর,হাজারো মানুষ দেখতে এসেছিলো কিছুক্ষণের মধ্যে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ শাসকেরা সেই পূজো হতে দেয় নি। প্রতিমা লুকিয়ে ফেলতে হয়েছিলো রাজদ্রোহের ভয়ে। ঘট পূজা হয়েছিলো সেবার ওখানে।
স্বদেশে অন্য কেউ রাজত্ব করছে এটা বাঙালি কখনোই সহ্য করে নি। আন্দোলন সংগ্রামে হটিয়ে দিয়েছে তাদের। এমনকি বাঙালি হিন্দুরা নিজেদের দেবতার রূপ,সাজ পোশাক পাল্টে দিয়েও এক অনন্য প্রতিবাদের নজির সৃষ্টি করেছিলো সেবার,শাস্ত্র সম্মত না এটা জেনেও করেছে! মানে ধর্মেরর উর্ধ্বে স্বদেশপ্রীতি! অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে,বাঙালির নিজ ভাষা,নিজ দেশে একদল কেবল সংখ্যায় অল্প বলে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে ক্রমাগত হামলার শিকার হতে হয়! কী দুর্ভাগ্য!
১৯৭১ এর ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই পীড়িত,মূর্ছিত, অর্ধঅনাহারে যখন বাংলাদেশের বাঙালিরা জীবন মরণ লড়ছে,তখন পশ্চিম বাংলার অনেক পূজামণ্ডপ থেকে,পূজা কমিটি থেকে অনেক অনুদান যুদ্ধ বিপর্যস্ত বাংঙালিদের ফান্ডে দিয়ে দিয়েছে। বাঙালিত্বের এক অকৃত্রিম টান থেকেই এমন হওয়া স্বাভাবিক।
এতোকিছুর মাঝেও পূজো এক মহা মিনল মেলার নাম। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায় নাগাদ পূজো এক ধর্মের মানুষকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে আত্মিক মেল ঘটায়। তখন আসলে আমরা ভুলে যেতে বাধ্য হই হানাহানি, হিংসাগুলো। বাঙালি ভ্রাতৃত্ব ই জেগে থাকে শেষে। পূজোয় নারিকেল, তিল এর নাড়ু, ক্ষীরের সন্দেশ আমাদের মা কাকী জ্যেঠিরা এখনো বেশি করেই তৈরি করে। এর কারণ আছে। তাদের ছেলেটা বা মেয়েটা কোথাও পড়ে মানে হলো তারা তাদের বন্ধুদের জন্য পূজোর পর সেই নাড়ু সন্দেশ অবশ্যই নিয়ে যাবে। অনেক বন্ধুদের আবদারও থাকে। আবার পূজোর মাঝেই অনেকে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে বাড়িতে আসতেছে যাদের সাথে ধর্মের মিল নেই,আত্মিক টানেই এই আসা। পূজোর প্রসাদেই হচ্ছে অতিথি আপ্যায়ন।একই বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে থাকে কিংবা পরিচিত সেই সুবাদে একজন অন্যজনের কেনাকাটার অঙ্গী হচ্ছে অনায়াসে,এই দম না ফলতে পাড়া ব্যস্ততার মাঝেও। সিনিয়র পড়ুয়া জুনিয়র পড়ুয়াকে,বন্ধু বন্ধুকে পূজো উপলক্ষে নতুন জামাকাপড় উপহার দিচ্ছে। ছেলে-মেয়ের টিউটর, যিনি ধর্মে হিন্দু নন, তাকে কিন্তু পূজোয় বোনাস দেওয়া হচ্ছে বা নতুন পোশাক উপহার দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষক ছাত্রদের, ছাত্ররা শিক্ষককে নতুন জামাকাপড় উপহার দিচ্ছে। এগুলো জীবন্ত সত্য।
আসলে বিশ্বজোড়ে কীসের মোহে কীসের টানে,কে বা কার জোড়ে উগ্রতা বাড়ে সেসব সাধারণ মানুষ অনেক পরে টের পায়। কিন্তু ততোদিনে অনেক ভাঙন,অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। অনেক সৌন্দর্য, কালের ইতিহাস নিমেষে উগ্রতার বলি হয়ে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। মানুষেরই সৃষ্টিকে গুড়িয়ে দেয় আরেকদল মানুষ! তবুও মানুষকে দিনশেষে মানুষের কাছেই আসতে হয়। আনন্দ, দুঃখে মানুষের পাশে দাঁড়ায় মানুষ।
এবছরের দুর্গোৎসবে মহামিলন ঘটুক হৃদয়ে হৃদয়ে, প্রাণে প্রাণে,মনে মনে। মহামারি,যুদ্ধ এসবকে ছাপিয়ে মানুষের জয় হোক, দেবী যেনো সেই কৃপা করেন আমাদের। অভয়া অভয় দান করুন, জয় দুর্গা।
শুভেচ্ছা সবাইকে।