রাত্রি এখন তিন প্রহর। নিজ গৃহ প্রাঙ্গণে উৎসুক হয়ে বসে আছেন ত্রিবিক্রম। রত্নগোমীনের আসতে এত দেরী হচ্ছে কেন?
ত্রিবিক্রম দাশ সরস্বতী গঙ্গানগরের প্রসিদ্ধ বৈদ্য। তাঁর পাণ্ডিত্য ও চিকিৎসাদক্ষতার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে গঙ্গাল রাজ্য অতিক্রম করে প্রাচী, বৃহত্তর মগধ, কাশী, কোশলে। চরকের টীকা রচনা করার জন্য মহারাজ বিরাটদন্তী তাঁকে সম্প্রতি ‘চরকানন’ উপাধি ও অন্যান্য নানা উপহারে ভূষিত করেছেন। ভিষকগোষ্ঠীতে জল্পনা চলছে, অনতিবিলম্বেই হয়তো ত্রিবিক্রম ‘রাজান্তরঙ্গ’ অর্থাৎ মহারাজের প্রধান বৈদ্য পদে নিযুক্ত হবেন। অন্যান্য ভিষকেরা তাঁকে ঈর্ষা করেন, তবে সম্মান করেন তার থেকে বেশী।
কিন্তু সম্প্রতি ত্রিবিক্রমের মনে একটা অভূতপূর্ব আলোড়ন দেখা দিয়েছে। নিজের পুরাতন দর্শন, নিজের বাহ্যিক আত্মপরিচিতির সঙ্গে একটা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন তিনি। ধ্রুপদী ঘরানায় তাঁর ছাত্রজীবন লালিত। তাঁর গুরু এবং তস্য গুরুর প্রদর্শিত পথে তিনি তাত্ত্বিক গবেষণা ও তত্ত্বপ্রয়োগ করে এসেছেন, তাতে আরোগ্যকর্মে যেমন সাফল্য এসেছে, এসেছে উত্তরাপথের অন্যান্য বৈদ্য সম্প্রদায়ের থেকে প্রশংসাবাণীও। যা আসেনি, তা হল মানসিক সন্তুষ্টি। অনবরত পাঠে মগ্ন ত্রিবিক্রমের মনে হয়, কোথাও গিয়ে যেন একটা আটকে যাচ্ছেন তিনি। নিজের বুদ্ধি, যুক্তিকে নিরপেক্ষভাবে প্রশ্ন করতে করতে দেখছেন অনেক জিজ্ঞাসারই সঠিক উত্তর, ঋজু উত্তর তিনি তাঁর হস্তগত শাস্ত্ররাজিতে পাচ্ছেন না। চরক পড়তে পড়তে তাঁর মনে হয়, অনেক প্রসঙ্গ যেন সেখানে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। চরাচরব্যাপী এই সৃষ্টি এবং তথিমধ্যে এই দেহভাণ্ড – এর গতিপ্রকৃতি, এর অস্তিত্ব, এর কারণ – এইসব অসামান্যভাবে ব্যাখ্যা করেও যেন ঋষিরা অনেক কিছু উহ্য রেখে দিয়েছেন, যেন নীরব ইঙ্গিত করেছেন অনেক কিছুর প্রতি। মাঝে মাঝে ত্রিবিক্রমের মনে হয়, পরবর্তী ঋষিরা আয়ুর্বেদকে একটা নির্দিষ্ট খাতে বওয়াতে গিয়ে বৃহৎত্রয়ীর, বিশেষ করে চরকের একপ্রকার অঙ্গহানি ঘটিয়েছেন। সেইসব নিয়ে প্রশ্ন করতে গেলে সুস্পষ্ট অস্বস্তি লক্ষ্য করেছেন তিনি তাঁর গুরুদের চোখে। যত দিন গেছে, চিকিৎসাশাস্ত্রের মূলধারার পাঠ্যসূচীতে স্বাভাবিক বিবর্তন ও পরিবর্ধনের বদলে নানাপ্রকার অলঙ্ঘ্য সীমাবদ্ধতা চেপে বসেছে – এমনটাই ত্রিবিক্রমের মনে হয়েছে।
অথচ গতানুগতিকতার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে একটু অন্যধারায় গবেষণা কিন্তু অদ্ভুত ফলপ্রসূ হয়েছে। দক্ষিণে রসশাস্ত্রীরা যে বিপ্লব এনেছেন সে সম্পর্কে ভিষকগোষ্ঠীতে প্রাথমিক প্রতিরোধ দেখা গেলেও আজ রাসায়নিক প্রয়োগ সম্বন্ধে সংস্কার ধীরে ধীরে দূরীভূত হচ্ছে। যোগের প্রয়োগবিধিতেও নিষেধাবলী উপেক্ষার সাহস দেখিয়েছেন অনেক পণ্ডিত, যদিও এইজাতীয় পাঠ সম্বন্ধে যাজকমহলে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অতন্দ্র প্রহরায় কাজ করতে হয় স্বাধীনচেতা গবেষকদের। তাই দীর্ঘদিন ধরে বৌদ্ধসাধকদের চর্চিত কিছু তত্ত্ব সম্বন্ধে জানার আগ্রহ থাকলেও প্রকাশ্যে তাঁদের সঙ্গে ওঠাবসা করার সাহস পাননি ত্রিবিক্রম। অথচ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, অবারিত পরিবেশে বিভিন্ন ধারায় বস্তুমুখী অনুসন্ধান করলে তবেই তাঁর মনের কিছু প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে। কিন্তু ধ্রুপদী ভিষকদের সম্বন্ধে বৌদ্ধতন্ত্রসাধকেরাও অনেকেই বিরূপ, ফলে এ বিষয়ে ঠিক সুবিধে করে উঠতে পারছিলেন না ত্রিবিক্রম।
অবশেষে তিনি শরণাপন্ন হয়েছেন রত্নগোমীনের। রত্নগোমীন মহাসঙ্ঘিকাবাদী ভিক্ষু, কিন্তু সঙ্ঘের নিয়মবিধি সম্বন্ধে উদাসীন হওয়ায় এবং মহিলাদের সন্ন্যাস সম্বন্ধে কিছু ব্যতিক্রমী মতপ্রকাশ করায় সঙ্ঘের প্রভাবশালী ভিক্ষুদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন তিনি। শোনা যায়, খুব শীঘ্রই সঙ্ঘত্যাগ করে স্বাধীন প্রব্রজ্যা অবলম্বন করবেন তিনি। ত্রিবিক্রম অনুরোধ করায় তাঁকে কিছু গোপন তত্ত্ব ও ব্যাখ্যান জানাতে সম্মত হয়েছেন রত্নগোমীন। কিন্তু প্রকাশ্যে আলোচনায় সম্মিলিত হতে সাহস হয়নি ত্রিবিক্রমের। তাই নিশাচর রত্নগোমীন গভীররাতে ত্রিবিক্রমের কাছে এসে বিমর্শে উপবেশন করবেন এমনই ঠিক হয়েছে। আজ দ্বিতীয় পাঠ।
রত্নগোমীনের অপেক্ষা করতে করতে তারাখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে গতদিনের বাক্যালাপের কথা ভাবছিলেন ত্রিবিক্রম। মুহুর্মুহু প্রশ্ন করছিলেন তাঁকে রত্ন, এবং সেখানে শ্লেষ ও ব্যঙ্গের ভাগ নিতান্ত কম ছিল না। যেমন – “বৌদ্ধদের সম্বন্ধে তোমাদের যে এত অনীহা, জীবক পুনরায় অবতীর্ণ হলে তাঁকেও কি তোমরা উপেক্ষা করতে?”।
ত্রিবিক্রম এ প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু করে নিশ্চুপ ছিলেন। কারণ বৈদ্যমাত্রেরই সম্মানীয় ভিষক জীবক কুমারভট্ট শুধু যে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন তাই নয়, তাঁর পালক বিম্বিসারই সারস্বতব্রাহ্মণগোষ্ঠীর ভিষকদের পূর্বভারতে কেন্দ্রীভূত করেন। ত্রিবিক্রমের পূর্বপুরুষদের বিম্বিসার তাঁর প্রথমা স্ত্রী-র জন্মভূমি কোশল থেকে মগধে নিয়ে আসেন। ত্রিবিক্রমের ধন্বন্তরি গোত্রীয় মাতুলেরা এসেছিলেন মদ্র থেকে, বিম্বিসারের তৃতীয়া স্ত্রী ক্ষেমার সূত্রে। ফলে বুদ্ধের প্রতি একান্ত অনুগত জৈনরাজা বিম্বিসার এবং বৌদ্ধভিষক জীবক, এই দুজনের প্রতি এই সারস্বত ভিষক গোষ্ঠী কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ। এখনও সারস্বত অতীতের প্রতি আবেগতাড়িত হয়ে তাঁরা নামান্তে সরস্বতী যোগ করেন, তা সেই মগধেই থাকুন বা গঙ্গালদেশে। মধ্যদেশে থাকলে প্রতিদ্বন্দ্বী যাজকগোষ্ঠীর প্রাবল্যে তাঁদের নিজস্ব পরিচিতি, নিজস্ব ধ্যানধারণা ক্রমেই যে বিপন্ন হতো সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। বিশেষ করে এই গঙ্গালরাজ্যে ভিষকেরা অনেক নির্বিঘ্নে তাঁদের স্বাধ্যায় ও চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারছেন।
তারপরে রত্নগোমীন বলেছিলেন “কৃষ্ণযজুর্বেদী বা সামবেদীদের সঙ্গে আমাদের নাহয় আড়াআড়ি সম্পর্ক, কিন্তু তোমাদের এই আমাদের সঙ্গে দেওয়াল তৈরির বিষয়টায় আমি যুক্তি খুঁজে পাই না”। ত্রিবিক্রম বোঝেন, রত্ন বৌদ্ধঘরানার সঙ্গে আয়ুর্বেদের দার্শনিক সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত করছেন। মহাযানীরা তাঁদের তত্ত্বের কাঠামো তৈরি করেছেন সাংখ্য থেকে, যে সাংখ্য আবার চরকসংহিতার মূল ভিত্তি। আদি তন্ত্রধর্মকে মেনে চলা সাংখ্যদর্শন ও আদিতম বেদ অথর্বই ধ্রুপদী ভিষকদের অধ্যয়নের ভিত্তি। কিন্তু তন্ত্রবিরোধী একটা ধারা সূত্র ও ব্রাহ্মণ রচয়িতাদের মধ্যে প্রকট হওয়ার পরে সাংখ্য এবং অথর্ববেদ দুইই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সর্বপ্রথম সঙ্কলিত বেদসংহিতা হওয়া সত্ত্বেও অথর্বের বেদত্ব নিয়ে প্রভাবশালী যাজকগোষ্ঠী প্রশ্ন তুলে মন্ত্রের প্রকৃতি অনুসারে বেদের ত্রিবিধবিভাগে প্রবৃত্ত হয়েছেন, ফলে অথর্বাঙ্গিরসদের ক্ষমতা কমে গিয়ে তাঁদের অনেকেই হয়েছেন দেশান্তরী। অপরপক্ষে সাংখ্যের আদিগ্রন্থগুলিও আজ বিলুপ্ত। ভিষকদের উপর নানা নিষেধবিধি আরোপ করা যাজকেরা সকলেই কৃষ্ণযজুর্বেদী ও সামবেদী। সে তুলনায় বৌদ্ধধর্মে সাংখ্যের, এবং কিছুটা তন্ত্রের প্রতিও বিরোধভাব ছিল কম। ত্রিবিক্রমের জ্ঞাতিত্বসূত্রে এক বৃদ্ধপ্রপিতামহ মোদগল্যায়ণ ছিলেন বুদ্ধের প্রিয় এবং প্রধান শিষ্যদের একজন। ত্রিবিক্রম আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করেন “না আমরা তো বিষ্ণুপূজা করি, দেবীপূজা করি, তোমাদের তো এসব…”। তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রত্ন বলেন “দেবীপূজা আমরাও কেউ কেউ করিনা তোমায় কে বলল?” রত্নের মুখে রহস্যময় হাসি দেখে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন ত্রিবিক্রম। তবে কি রটনাটা সত্যি? তন্ত্রচর্চায় আনুষ্ঠানিক সম্মতিপ্রাপ্তির পর থেকেই মহাসঙ্ঘিকাপন্থীদের মধ্যে দেবদেবীপূজার গোপন ধারা প্রাবল্য লাভ করছে বলে যে শোনা যায়, রত্ন কি সেদিকেই ইঙ্গিত করছেন?
ফলে ত্রিবিক্রমের আগ্রহটা আরও বেড়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যাভাষা আর প্রতিপ্রশ্নের শেষে আজকে তত্ত্বব্যাখ্যান শুরু করবেন রত্নগোমীন, সেই আশায় অধীর আগ্রহে বসে রয়েছেন তিনি। কিন্তু রত্নের দেখা নেই।
খটখট একটা শব্দে সহসা সচকিত হয়ে উঠলেন ত্রিবিক্রম। দূরে তাকিয়ে দেখলেন ক্রমে পরিস্ফুট হচ্ছে রত্নগোমীনের অবয়ব। তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন রত্ন, আর তাঁর হাতে কিছু একটা রয়েছে যা থেকে খটখট শব্দটা আসছে। ক্রমে ত্রিবিক্রমের সম্মুখে এসে দণ্ডায়মান হলেন রত্ন। হাতের বস্তুটা তুলে দেখালেন তাঁকে। সেটা একটা দণ্ডযুক্ত কৌটা। ধাতব কৌটার তলদেশ থেকে নির্গত দণ্ডটা ধরে রত্ন যখনই ঘোরাচ্ছেন তখনই কৌটার সঙ্গে দড়ি দিয়ে সংযুক্ত একটি প্রস্তর আঘাত করছে দণ্ডটাকে, আর খটখট শব্দ হচ্ছে। “এই নাও, তোমার জন্য খেলনা এনেছি” – হেসে বলে উঠলেন রত্ন। তাঁর মতো প্রসিদ্ধ বৈদ্যর সঙ্গে পরিহাস করছেন একজন সাধারণ ভিক্ষু? অনেক কষ্টে ক্রোধসম্বরণ করে ত্রিবিক্রম বলে উঠলেন “কি এটা, দয়া করে বলুন”।
একটু চুপ করে থেকে রত্ন বললেন “এটা চক্র”। চক্র? সে তো অন্যরকম দেখতে হয় বলে জানেন ত্রিবিক্রম, তন্ত্রের মঙ্গলচিহ্নস্বরূপ চক্রের ধারণা থেকেই বৌদ্ধরা তাঁদের ধর্মচক্রের রূপ নিয়েছেন। ত্রিবিক্রম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন দেখে রত্ন বললেন – “তবে তুমি যে চক্রের কথা ভাবছো, তা নয়। এ হল কালচক্র”। “আমি কি ভাবছি আপনি বুঝলেন কি করে?” – বিস্মিতকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন ত্রিবিক্রম। রত্ন বলে উঠলেন – “আগেও ভেবেছো, তাই এখনও ভাবছো, আরও ভাববে”। উফ, আবার সেই সন্ধ্যাভাষা। এবার বিরক্তি বাড়তে লাগল ত্রিবিক্রমের। রাতের ঘুম ছেড়ে তিনি কিছু জানার জন্য বসে আছেন, অথচ এখনও কিছুই নতুন জানা হলো না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইলেন তিনি।
“এই নাও। হাতে নিয়ে দেখো”, বলে কৌটোটা ত্রিবিক্রমের হাতে তুলে দিলেন রত্ন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কৌতূহলের বশে সেটাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন ত্রিবিক্রম। কৌটো অংশটার মাঝবরাবর কতগুলি কীলকযুক্ত অংশ তিনটি সারিতে সজ্জিত। প্রতিটি অংশে একটি করে সংখ্যা লেখা রয়েছে। প্রতি সারিতে সঙ্খ্যাগুলি ০ ১ ২ ৩ করে ৯-এ পৌঁছে একটি বেষ্টন সম্পূর্ণ করে।
এরকম কোন বস্তু এর আগে দেখেননি ত্রিবিক্রম। “কি হয় এই সংখ্যাগুলো দিয়ে?” বলতে বলতে অন্যমনস্কভাবে ত্রিবিক্রম তিন সারিতে ০, ৯ আর ৬-এ আঙ্গুল চেপে ধরতেই হঠাত কি যেন একটা হয়ে গেল। ত্রিবিক্রমের মনে হল তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন কোন গহন সুড়ঙ্গে, অবারিত গতিতে। আর্তনাদ করে কিছু আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোথায় কি? একবার মনে হল তিনি শূন্যে ভাসমান, আরেকবার মনে হল তিনি কোন জলপ্রপাতের ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছেন নিচের দিকে। গতিরোধের আরও কিছু উপায় ভাবার আগেই হঠাৎ চারিদিকটা আলোকিত হয়ে উঠল, আর ত্রিবিক্রম দেখলেন তিনি শুয়ে আছেন মাটিতে।
উঠে বসতেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়ল তাঁর। সম্মুখে সুবিশাল সুনীল জলক্ষেত্র, ঊর্ধে শারদনীল আকাশ, তিনি উপবিষ্ট স্বর্ণময় বালুকায়, আর দুপাশ দিয়ে অর্ধবেষ্টন করে পশ্চাতে বিস্তৃত হয়েছে এক অনুচ্চ বন্ধুর পর্বত। ত্রিবিক্রম বুঝতে পারলেন তিনি কোন সমুদ্রের ধারে বসে আছেন, সম্ভবতঃ এটা কোন দ্বীপভূমি । মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্যে।
“কি দেখছ? সুন্দর, তাই না?” – রত্নগোমীনের কণ্ঠ শুনতে পেলেন ত্রিবিক্রম। কিন্তু তাঁকে দেখতে পেলেন চারিদিকে তাকিয়েও। “আমায় দেখতে পাবে না” – যেন ত্রিবিক্রমের মনের কথা শুনতে পেয়ে উত্তর এল। উপর্যুপরি বিস্ময়ের ধাক্কায় ত্রিবিক্রম তখন বিহ্বল। রত্নের আনা যন্ত্রটি স্পর্শ করে এ কোথায় চলে এলেন তিনি? প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রাথমিক মুগ্ধতা কাটিয়ে এবারে বিচলিত হয়ে উঠলেন ত্রিবিক্রম। এ কি কোনও মায়া? রত্ন কি তাঁকে সম্মোহিত করে কোন কিছু বোঝাতে চাইছেন?
“এখানে সবই কিন্তু সুন্দর নয়, ঐ দেখো দক্ষিণে” রত্নের কথায় ত্রিবিক্রম তাকিয়ে দেখলেন এক ব্যক্তি অদূরে বসে রয়েছে তটভূমিতে। দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁপে কেঁপে উঠছেন বারেবারে। ত্রিবিক্রমের মনে হল লোকটি কাঁদছে। তাঁর অনুমানই ঠিক। হঠাত ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে সরবে কেঁদে উঠল লোকটি। তার ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, কিন্তু বর্ণিল অধোবাসটি কেমন অদ্ভুত লাগল ত্রিবিক্রমের। পায়ের পাদুকাটি অনেকটা গঙ্গাল রাজ্যে প্রচলিত চর্মপাদ্যের মত। কে এ? অবয়বে তো বিদেশী বলে মনে হচ্ছে না। এইসময় রত্নের গলা শোনা গেল – “এ তোমার এক ৯৬তম স্তরের উত্তরপুরুষ। এর নাম রমেশ মাদুগলে। শ্রীলঙ্কার অধিবাসী”। অন্যসময় হলে যুক্তিবাদী ত্রিবিক্রম এমন অদ্ভুত কথা হেসে উড়িয়ে দিতেন, কিন্তু যা ঘটছে তাতে তাঁর সে প্রবৃত্তি হল না। ক্ষীণকণ্ঠে বলে উঠলেন “লঙ্কা? মানে লঙ্কাদ্বীপ?”। – “সেই লঙ্কাদ্বীপ নয়, এ হল শ্রীলঙ্কা, যাকে তোমরা সিংহল বলে চেনো”। ত্রিবিক্রম অবাক হয়ে চেয়ে আছেন। আবার রত্নবাণী – “মহারাজ তিষ্যর শাসনকালে ভিষক হিসেবে তোমার অধস্তন অষ্টমস্তরের একজন বঙ্গ থেকে এসেছিলেন সিংহলে। বিজয়সিংহের উত্তরসূরি শাসকেরা জন্মভূমির সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করেন নি, তাই বৈদ্য, শিক্ষক বা শিল্পী তাঁরা নিয়ে আসতেন রাঢ় থেকেই।”।
ভবিষ্যৎদর্শন? এও কি সম্ভব? ত্রিবিক্রম ব্যক্তিটির মুখাবয়বে তাঁর নিজের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পেলেন। না কি তিনি সে সাদৃশ্য কল্পনা করছেন? লোকটির কান্না কেমন একটা স্পর্শ করলো তাঁকে। “ও কাঁদছে কেন?” অদৃশ্য রত্নের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন তিনি। “ও এখন সর্বস্বান্ত। শুধু ও নয়, সমগ্র দেশবাসীর একই অবস্থা। শাসক সমুদ্রগভীর ঋণে নিমজ্জিত করেছেন দেশবাসীকে। অপরিণামদর্শী কর্মের ফল ভুগতে হচ্ছে সবাইকে। বহির্বাণিজ্য প্রায় বন্ধের মুখে”।
ঋণ? ত্রিবিক্রমের মনে পড়ে গেল গঙ্গাল রাজ্যের করসুগমের কথা। ত্রিবিক্রমকে অল্প কিছুদিন আগেই ভূমিদান করেছেন তিনি। অসংখ্য কৃষিজমির অধিকারী করসুগম সম্প্রতি সম্পূর্ণভাবে বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেছেন। গঙ্গাল রাজ্যের সুদূরের পিয়াসী বণিকদের সাথে তিনিও যাবেন সমুদ্রযাত্রায়। মহারাজের সঙ্গে শ্রেষ্ঠীদের আলোচনাসভায় তিনি যোগদান করবেন, বলছিলেন করসুগম। বণিক ও উদ্যোগীদের ঋণপ্রদানের যে সুব্যবস্থার জন্য গঙ্গাল রাজ্য বিখ্যাত, তাকে আরও রাজকোষসহায়ক করা যায় কিভাবে সে নিয়েই আলোচনা হবে। তিনি একজন বিচক্ষণ রাজনের সমৃদ্ধ রাজ্যে বাস করে সুখে কালাতিপাত করছেন, আর তাঁর বংশধরের এই দুর্গতি! বেদনাহত হলেন ত্রিবিক্রম। হঠাত তাঁর কানে এল দূরে বসে থাকা ব্যক্তিটি বাষ্পরুদ্ধ গলায় গাইছে “নমো নমো মাতা”। সে কি কোন দেবীর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করছে? “বলতে পারো। শ্রীলঙ্কা মাতাকে এরা উপাসনাই করে একরকম” – রত্নগোমীনের গলা শোনা গেল। দেশমাতা ! অসাধারণ লাগলো ত্রিবিক্রমের কল্পনাটা । “অহং রাষ্ট্রী, মনে পড়ে? এখানে ভিক্ষুরা দেবীপূজা বন্ধ করেও সন্তানকে মায়ের নাম ভোলাতে পারেনি” – তৃপ্তি ধ্বনিত হল রত্নকণ্ঠে।
হঠাত ত্রিবিক্রমের দেহটা আলোড়িত হয়ে উঠল, চোখে নেমে এল অন্ধকার। তলিয়ে যাওয়ার সেই অনুভূতি আবার। তারপর স্থিরতা এলে ত্রিবিক্রম চেয়ে দেখলেন সমুদ্রের রং গেছে বদলে, নীলের বদলে তাতে সবুজের আভা। একটা কলরব কানে এলো তাঁর। বামদিকে তাকিয়ে দেখলেন অসংখ্য মানুষ জমা হয়েছে তটভূমিতে। অদ্ভুত তাদের বস্ত্র। অগ্রভাগে কয়েকজন অশ্বারোহী। তাদের পশ্চাতে কয়েকজন একটি প্রতিমা বহন করে আসছে স্কন্ধে। প্রতিমাটি কোনও দেবীর, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা। দেবীর মাথায় অদ্ভুত এক মুকুট, আর সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত শ্বেত বস্ত্রে। কে এই দেবী? এমন সময় অশ্বারোহীগণ গলা ফাটিয়ে যেন জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল – “কালী ! সেন্ট সারা ! সারা–লা-কালী!”। আর সেই একই রব প্রতিধ্বনিত হল সম্মিলিত জনতার কন্ঠে। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ত্রিবিক্রম শুনে। কালী? এরকম সর্বাঙ্গে বস্ত্র-আচ্ছাদিতা? এরা কি প্রতিমা নিরঞ্জন করতে এসেছে? “না ! নিরঞ্জনের রীতি এঁদের মধ্যে আর নেই, এই বিদেশে এরা আর সেটা ধরে রাখতে পারেনি” – রত্নের কণ্ঠ ধ্বনিত হল। “সিংহল বিদেশ?”। – “হ্যাঁ সিংহলও বিদেশ হয়ে যাবে বটে, কিন্তু এখন তুমি সিংহলে নেই। তুমি এখন গলদেশের সমুদ্রতটে। আর ঐ যে সামনে লম্বা অশ্বারোহীকে দেখছ, ও তোমার ৮৬তম স্তরের বংশধর, নাম সেবাস্তিয়েন মোদিগিলানি”। আবার হতবাক হবার পালা ত্রিবিক্রমের। গলদেশের নাম তিনি গন্ধবণিকদের কাছে শুনেছেন। সে বহুদূর, সাতসাগর পেরিয়ে যেতে হয়। মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে সিংহল থেকে সেখানে না হয় মায়াবলে রত্নগোমীন নিয়ে এসেছেন, কিন্তু তাঁর বংশধর এখানে এসে পৌঁছল কোন মায়াবলে? সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর এল রত্নের – “তোমার জন্মের প্রায় হাজার বছর পর বহিরাগত এক দুর্বৃত্ত পারস্য থেকে এসে ধংসলীলা চালাবে বঙ্গসহ সমগ্র উত্তরাপথ জুড়ে। ফেরার সময় সে বন্দী করে নিয়ে যাবে বহু যোদ্ধা, সঙ্গীতজ্ঞ, কারিগর, শিল্পীদের। তোমার বংশের এক বৈদ্যকেও সে নিয়ে যাবে। স্বাধীনতাহীন দুর্বিষহ জীবন কাটাবে তারা দীর্ঘদিন সেই পরভূমে। তারপরে সেই শাসকের মৃত্যু হতেই দলে দলে তারা পালাতে থাকবে। পূর্বদিকে ভারতের আগে পর্যন্ত দুরতিক্রম্য বর্বররাজত্ব, তাই দেশে না ফিরে নতুন জীবনের আশায় তারা পশ্চিমে অগ্রসর হবে। ছদ্মবেশে, মিশরীয় বলে পরিচয় দিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়বে পশ্চিমা ভূখণ্ডের নানা দেশে। শ্বেতকায়েরা এই শ্যামবর্ণ আগন্তুকদের কোনওদিনই সমাজে স্থান দেবে না, তাই ভ্রাম্যমান জীবনেই শান্তি খুঁজে বেড়াবে এরা। উত্তরাপথের চলিত ভাষায় এরা নিজেদের ‘রমতা’ বলে ডাকে। শ্বেতজাতি সেটাকে বলবে ‘রোমা’ বা ‘রোমানি’। পরিবর্তন আসবে ভাষায়, পরিবর্তন আসবে পরিচ্ছদে। নানা জাতির সমন্বয়ে গঠিত এই যাযাবরদের শিকড়ে সংযুক্ত রাখার কাজ করবে তোমার সেই বংশধরের উত্তরপুরুষেরা। বংশপরম্পরায় তারা ধর্ম, ভাষা, চিকিৎসা, জ্যোতিষ শিক্ষা দেবে এদের। তাই বহিরঙ্গে নানা পরিবর্তন এলেও এদের ভাষায় এখনও তুমি তোমার ভাষাকে আবিষ্কার করতে পারবে। গলদেশের যাজকদের চোখে ধুলো দিয়ে এরা এক দেবালয়ে পরিবর্তিত রূপে প্রতিষ্ঠিত করে মা কালীকে, স্বাভাবিকভাবেই মায়ের দিগম্বরী রূপ তাদের আচ্ছাদিত করতে হয়েছিল। বছরের এই নির্দিষ্ট সময়ে এদের যে যেখানেই থাকুক না কেন, এসে জড়ো হয় মায়ের থানে। গানবাজনা উৎসব আনন্দ করে, প্রতিমা বিসর্জনের আদিম স্মৃতি উদযাপন করে সবাই মিলে দেবীমূর্তিকে সমুদ্রতীরে নিয়ে এসে। কিন্তু নিরঞ্জন না দিয়ে প্রতিমাকে জলে অর্ধনিমজ্জিত করে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় মন্দিরে। মায়ের কাছে এসে এরা সংগ্রহ করে সারা বছরের বেঁচে থাকার, অন্যায় অত্যাচার সহ্য করার শক্তি। তাই হাজার চেষ্টা করেও এই যাযাবরদের দমিয়ে রাখতে পারবে না শ্বেত বর্বরেরা।”
শ্বাসরুদ্ধ করে রত্নের কথা শুনছিলেন ত্রিবিক্রম। এমন সময় তাঁর কানে এলো জনতা ফিরে যাচ্ছে। তাদের চার পাঁচ জন বীণার মত কি একটা বাদ্যযন্ত্র হাতে নিয়ে গান গাইছে। একটা কলি বারেবারে শোনা গেল – “গেলেম গেলেম, ই বড়ো থান”। ত্রিবিক্রমের মনে হল গঙ্গাল রাজ্যের কোন অন্তেবাসীর ভাষায় যেন তারা গান গাইছে।
হঠাত আবার সেই ঝাঁকুনি। চোখ বুজে রইলেন ত্রিবিক্রম, তাতে কষ্টটা কম হচ্ছে। ঝাঁকুনি থামলে দেখলেন সমুদ্র আবার নীল। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে, অনেকগুলো নারকেল গাছ গজিয়ে উঠেছে সমুদ্রতীরে, হয়তো রত্নেরই মায়াবলে। “আবার তুমি ফিরে এলে ভারতে, তবে পশ্চিমদিকে।” – রত্নের বাণী কানে এল – “এই তীরভূমির নাম রামবোল, রাম নামে তোমার এক বংশধরের নামে। গোকর্ণের নাম শুনে থাকবে হয়তো, তারই কাছে। তোমার জন্মের ১২০০ বছর পর পুণ্ড্র ও বঙ্গে পাল-নামান্তের এক রাজবংশের শাসনে সেনাবাহিনীর এক অভিযানে বৈদ্য ও সেনাপতি হয়ে অনেক ভিষকবংশীয় গোকর্ণে আসবে। তাদের একাংশ এখানেই থেকে যাবে, রাম তাদের নেতা। কিন্তু মাতৃভূমি থেকে বিচ্যুত হয়েও তারা বিশেষ বদলাবে না খাদ্যাভাস বা ভাষা।”। ত্রিবিক্রম সকৌতুকে বলে উঠলেন – “আমার বংশের বিস্তার দেখছি প্রায় ত্রিভুবন। তা এদের এখন নাম কি শুনি?” – “পরিচয় বদলায়নি। গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ। গঙ্গাল রাজ্যের পশ্চিম অংশের পরে নাম হয় গৌড়। দক্ষিণদিকে তাকিয়ে দেখ, বেশও অপরিবর্তিত”।
চমৎকৃত ত্রিবিক্রম দেখলেন, জলে ডুব দিয়ে সূর্যপ্রণাম করছে এক ব্যক্তি। গোলগাল, গৌরবর্ণ, মাথায় টাক। পরিধানে রঙিন পট্টবস্ত্র, উপবীত আর উত্তরীয়। রত্ন বলে উঠলেন – “ও তোমার ৭৮তম স্তরের উত্তরপুরুষ, রামের প্রত্যক্ষ বংশধর । নাম মঞ্জেশ্বর পাই বৈদ্য। আজ শান্তাদুর্গা মন্দিরে বিশেষ পূজা আছে। তারই জন্য অবগাহনে এসেছে। পূজার শেষে ভাতের সঙ্গে বিশেষ পুইশাকের ব্যঞ্জন আর মৎস্যভক্ষণের সমারোহ। তাই পেটুক মঞ্জেশ্বরের এত তাড়া।” লোকটি জল থেকে উঠে আসছে, এমন সময় আরেকটি লোক, সম্ভবতঃ মৎস্যজীবী তার কাছে গিয়ে বলে উঠল “বামোন! কোসো আসো? মাসোলি?”। লোকটি মৎস্যজীবীর হাতে ধরা ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল “আইজ বাইর খাবচো না”। ত্রিবিক্রম বুঝলেন আজ মঞ্জেশ্বর বাইরের মাছ খাবে না। রত্ন বললেন – “এই আমিষভক্ষণের জন্য এখানকার অন্যান্য ব্রাহ্মণরা বহুভাবে অপদস্থ করবে এদের। কিন্তু এরা ধর্মচ্যুত হবে না। দুর্গাপূজা আর প্রচলিত জীবনরীতি দুইই সংরক্ষণ করবে প্রাণপনে। ঐ দেখো ও মাথায় হলুদ উষ্ণীষ বাঁধছে, তোমরা উৎসবের সময় যেমন বাঁধো”।
“আচ্ছা, ঐ পাহাড়ে উঠবো না? তখন থেকে তো সমুদ্রতীরেই বিচরণ করাচ্ছেন” – ত্রিবিক্রম বেশ একটা মজা পেয়েছেন এই অভিজ্ঞতায়, তাই ছোট ছেলের মত আব্দারের সুরে বলে উঠলেন। রত্নের প্রত্যুত্তর এলো – “হে হে, সমুদ্রই তো তোমাদের চিরকাল আশ্রয় দেবে। আচ্ছা, চলো”।
সেই ঝাঁকুনির পুনরাবৃত্তি শেষে ত্রিবিক্রম দেখলেন তিনি এক পাহাড়ের গায়ে একটু সমতল স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু সমুদ্র আর দেখতে পেলেন না তিনি। একটা শব্দ শুনে ঘুরে দেখলেন একদিকে একটি মন্দির, আর শোভাযাত্রা করে একদল পার্বত্যজাতীয় ব্যক্তি সিংহাসনে উপবিষ্ট এক রাজাকে নিয়ে আসছে মন্দির অভিমুখে। “তুমি এখন নেপাল মণ্ডলে। ঐ যে সম্মুখে লোহিতবস্ত্র পরিহিত আয়তচক্ষু লোকটি হেঁটে আসছে, ওর নাম অম্বিকাপ্রসাদ কৈরালা। তোমার ৬৮তম স্তরের উত্তরপুরুষ এক চিকিৎসক, নেওয়ার রাজবংশ কর্তৃক তাঁর প্রপিতামহ আনীত হবেন এই ভূমিতে। নেওয়ার বংশের নতুন রাজার আজ অভিষেক। তাই রাজমন্ত্রী অম্বিকাপ্রসাদ রাজাকে নিয়ে আসছেন গড়ীমাতা কালীমন্দিরে। উত্তর হিমালয়ের গোরক্ষজাতি নেপাল অধিকারের পরিকল্পনা করছে দীর্ঘদিন ধরে। নতুন রাজা কিভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন, তার উপরেই নির্ভর করবে নেওয়ার রাজ্য আর কতদিন এই আগ্রাসী জাতির সঙ্গে যুঝতে পারবে।”
বাতাসের একটা দ্রুত ঝটকা। তারপরেই ত্রিবিক্রম দেখলেন শোভাযাত্রায় যারা ছিল তাদের অবয়ব ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন অস্পষ্টতা কাটলো, দেখা গেল উপস্থিত জনগণের বেশভূষা, মুখশ্রী সব বদলে গিয়েছে। পার্বত্য শোভাযাত্রীদের স্থলে এখন উত্তরাপথের সাধারণ বেশভূষা পরিহিত এক জনতা সম্মিলিতভাবে ধ্বনি তুলছে “শিবকোটনরেশ রাজা কল্যাণ সেন জয়তু”। সম্মুখে প্রহরী পরিবেষ্টিত হয়ে দণ্ডায়মান অপরূপ সম্ভ্রান্ত রূপবান এক রাজপুরুষ। এক পণ্ডিত এসে তাঁর সামনে দাঁড়াতে সেই রাজপুরুষ তাঁর পদস্পর্শ করলেন। “তুমি এখন শিবকোটের রাজধানীতে। ঐ দেখো রাজা কল্যাণ সেন তাঁর মাতুল প্রভাকর দাশ শাস্ত্রীকে প্রণাম করলেন। প্রভাকর তোমার ৬২তম স্তরভুক্ত উত্তরপুরুষ। এই কল্যাণ সেনের পূর্বজেরা সমগ্র পূর্বভারত জুড়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলবেন, ইতিহাসে তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তোমার আরেক বংশধর পন্থদাশ হবেন সেই সাম্রাজ্যের প্রধান সেনাপতি, এই প্রভাকর পন্থেরই এক ভ্রাতার বংশজ। কালে বহিরাক্রমণে রাঢ়ে সেনরাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে রাজবংশের এক শাখা গুরু পুরোহিত বৈদ্য পণ্ডিতসহ উত্তরাপথ ধরে ক্রমে চলে আসবেন হিমালয়ের কোলে এই শিবকোটে। প্রাচীন পাঞ্চাল রাজ্যের অন্তর্গত এই শিবকোটে সেনবৈজয়ন্তী হবে উড্ডিয়ান। এরপরে এরা চলে যাবেন সুক্ষেত্র ও মাণ্ডিতে। প্রতিষ্ঠা করবেন শ্যামাকালী ও আরও অনেক মন্দির।”
ত্রিবিক্রম বললেন “একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম। আমার উত্তরপুরুষদের কারুরই ভাষার বিশেষ পরিবর্তন ঘটবেনা। সকলেই দেখলাম বঙ্গভাষারই নানা প্রকারভেদ বলবে। এটা দেখে নিশ্চিন্ত লাগছে, ভাষাই তো জাতির প্রাণ। ভাষা এক থাকলে আর কিছু চিন্তা করার দরকার নেই।” রত্নের কাছ থেকে কোনও উত্তর এল না। “রত্নগোমীন? রত্ন?” আক্ষরিক অর্থেই হাওয়ায় প্রশ্ন ভাসিয়ে দিলেন ত্রিবিক্রম। সঙ্গে সঙ্গে আবার ঝাঁকুনি, বেশ জোরেই। আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন গঙ্গাল রাজ্যের বৈদ্যরত্ন।
একটি সুমধুর সঙ্গীত কানে আসায় চোখ মেললেন ত্রিবিক্রম। দেখলেন এক আলোকোজ্জ্বল প্রাঙ্গণে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। সম্মুখে এক সুউচ্চ তোরণ, তাতে অপরূপ সব কারুকার্য আর নানা দেবদেবীর মূর্তি খোদিত। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন তিনি, এত সূক্ষ্ম কাজ ভাস্কর্যের জন্য বিখ্যাত গঙ্গাল রাজ্যেও তাঁর চোখে পড়েনি। তোরণদ্বার দিয়ে একসারি লোক বেরিয়ে এল। তারা নানা বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে, আর সম্মুখে রয়েছে এক গায়ক, তারই গলার মধুর ধ্বনি একটু আগে শোনা গিয়েছিল। এদের পশ্চাতে বেশ কয়েকজন হেঁটে এগিয়ে এলেন। কেন্দ্রস্থলে যিনি ছিলেন তাঁর দুপাশে দুইজন প্রহরী আর পশ্চাতে একজন ছত্রধারী। শিরোভূষণ দেখেই ত্রিবিক্রম বুঝলেন ইনি কোন রাজা। ধীরপদে রাজন তোরণসম্মুখস্থ প্রাঙ্গনের মধ্যস্থলে এসে দাঁড়ালেন। একজন শ্বেতবস্ত্রপরিহিত ব্রাহ্মণ, সম্ভবতঃ রাজপুরোহিত এসে তাঁর ললাটে একটি টিকা এঁকে দিলেন। এবারে সামনে এগিয়ে এলেন এক পণ্ডিত। তাঁর হাতে একটি গোটানো ভূর্জপত্র। উদাত্ত কণ্ঠে একটি স্তবক পাঠ শুরু করলেন তিনি। ভাষাটা ত্রিবিক্রম ঠিক বুঝতে পারলেন না। বেশ কয়েকটি শব্দ সংস্কৃত, কিন্তু সেগুলি আলঙ্কারিক। মূল ভাষাটি সংস্কৃত নয়, দক্ষিণাপথের এক পণ্ডিতের কাছে একবার এইজাতীয় একটি ভাষা তিনি শুনেছিলেন।
“ঠিকই ধরেছো। ভাষাটির নাম তামিল” – অনেকক্ষণ পর আবার রত্নগোমীনের গলা শোনা গেল – “তুমি এখন মাদুরাইতে। এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হলে তুমি আমার সৌজন্যে। আজ প্রবল পরাক্রমী পাণ্ড্যরাজা নেডুঞ্জাদাইয়ান জটিল পরন্তক উপস্থিত হয়েছেন মীনাক্ষী মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার উদ্দেশ্যে। প্রশস্তি যিনি পাঠ করছেন, সম্মুখের ঐ পণ্ডিত, উনি গণপতি বজ্রশর্মা বঙ্গলণ্ডৈ। তোমার ৪৮তম স্তরীয় উত্তরপুরুষ।”
একটু বিচিত্র লাগছিল ত্রিবিক্রমের। এতক্ষণ পর্যন্ত যত উত্তরপুরুষ তিনি দেখেছেন সবাইকার ভাষা অল্পবিস্তর তিনি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু এই অবোধ্য ভাষায় তাঁর এই বংশধরের পাঠ, যতই ঝংকৃত সুললিত হোক না কেন, কেমন বিজাতীয় লাগছিল। রত্নগোমীন বলে চললেন – “বজ্রশর্মা পাণ্ড্যরাজ্যের বিখ্যাত বৈদ্যকুলসম্ভূত। এর আগেও তাঁর দুই জ্যেষ্ঠতাত পূর্বতন পাণ্ড্যরাজ মারবর্মণ রাজসিংহের মহামন্ত্রী হিসেবে কাজ করবেন। বজ্রশর্মা নিজেও অমাত্য হিসেবে জীবন শুরু করবেন, কিন্তু পাণ্ডিত্যবলে তিনি অচিরেই মহারাজ পরন্তকের ধর্মীয় উপদেষ্টা পদে বৃত হবেন। মীনাক্ষী মন্দিরই দাক্ষিণাত্যের প্রথম মন্দির যা সুন্দরেশ্বর শিবের নামে পরিকল্পিত হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার মুখ্য দেবতা হিসেবে পরিগণিত হবেন মীনাক্ষী আম্মানরূপী দুর্গা। এই সিদ্ধান্ত নিতে মহারাজ পরন্তককে বহু প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হবে, কিন্তু তিনি ও বজ্রশর্মা নিজ প্রত্যয়ে দৃঢ় থাকবেন। বঙ্গলণ্ডৈর এই বৈদ্যকুল বজ্রশর্মার দেড় শতাব্দী আগে বঙ্গদেশ থেকে তামিলদেশে বসতিস্থাপন করবেন। বর্তমানে তামিলভাষী হলেও নিজ আদিভূমির নামেই তাঁরা নিজ অঞ্চলের নামকরণ করবেন বঙ্গলণ্ডৈ। বজ্রশর্মার প্রপিতামহের পিতামহ বঙ্গরাজ শশাঙ্ক কর্তৃক শিব ও নীলাবতীর বিবাহ-উৎসব প্রবর্তনের একজন সাক্ষী। দীর্ঘ চিন্তনের পর বজ্রশর্মা শিব-নীলাবতী বিবাহের অনুকরণে সুন্দরেশ্বর ও মীনাক্ষীর বিবাহের উপাখ্যান রচনা করবেন। এই পদক্ষেপটি না নিলে এই প্রবল শৈবভূমির কেন্দ্রে কোন মাতৃকামন্দির স্থাপন এক অসাধ্য কাজ ছিল।”
ত্রিবিক্রম বিস্ময়াবিষ্ট। তিনি বলে উঠলেন “কি অদ্ভুত ! ভারতভূমের উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সর্বত্র আমার বংশ ছড়িয়ে পড়বে, এমনকি দূর গলদেশেও। তাদের পরিচ্ছদ, ভাষা, নামের ধরন, পদবী সবই পরিবর্তনশীল। ভিষক ঐতিহ্য এরা অনেকেই ধরে রাখবে দেখে আনন্দ হচ্ছে, কিন্তু সেটাও সকলের ক্ষেত্রে বলা যাবে না। তাহলে এদের সঙ্গে আমার যোগসূত্র কি? শুধুই রক্ত?”। “তা কেন?” – রত্নের গলা শোনা গেল পুনরায় – “একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য তোমার চোখে পড়ল না? যেটা এদের সবার ক্ষেত্রেই ধ্রুবক?”
“কি বলুন তো?” ত্রিবিক্রমের কণ্ঠে সংশয়।
– “সারা-লা-কালী, শান্তাদুর্গা, গড়ীমাই কালী, শ্যামাকালী, মীনাক্ষী… বুঝতে পারছো?” রত্নের কথা শুনে ত্রিবিক্রম কি যেন ভাবছেন। গুণগুণ সুরে রত্নকে গাইতে শোনা গেল – “নমো নমো মাতা”। বিদ্যুৎঝলকের মত বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেল ত্রিবিক্রমের।
মাতৃপূজা! বিভিন্ন রূপে মাতৃকা উপাসনা! তাঁর উত্তরপুরুষেরা যেখানেই যাবেন সেখানে মাতৃপূজার ধারা অক্ষুণ্ণ রাখবেন। যেভাবে তাঁরা মেতে ওঠেন দশায়ুধার বন্দনায়, সেই একই ধারা ধ্রুবতারার মতো পথ দেখাবে তাঁর উত্তরপ্রজন্মকে। মায়ের আশীর্বাদে সকলেই তাঁরা স্বমহিমায় ভাস্বর।
রত্নের গলা শোনা গেল – “আর এই ধারায় ছেদ পড়লে কি হবে জানো? দেখো”। আবার সেই ঝোড়ো হাওয়ায় বেসামাল হলেন ত্রিবিক্রম। একটু স্থির হয়ে যে দৃশ্য তাঁর চোখে পড়ল তাতে অন্ধকার হয়ে গেল তাঁর মুখ। চন্দ্রাতপযুক্ত একটি প্রাঙ্গণ। এক বৃদ্ধ সেখানে বসে মাথায় হাত দিয়ে আকুল নয়নে কেঁদে চলেছেন। একটি অল্পবয়স্ক নারী, সেও ক্রন্দনরতা, বৃদ্ধের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বৃদ্ধের বস্ত্র, নারীর শাড়ি সবই ছিন্নকৃত। মাথায় আঘাতের চিহ্ন। প্রাঙ্গণের এক কোণে একটি ভগ্ন দেবীমূর্তি, মুণ্ডহীন। এদিক ওদিক মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে পুষ্পপাত্র, নানা অর্ঘ্য, কোশাকুশী। কেউ যেন আসুরিক তাণ্ডব চালিয়েছে এই প্রাঙ্গণে। শিহরিত হয়ে উঠলেন ত্রিবিক্রম। “এ কি? আমি সহ্য করতে পারছি না! কি হয়েছে এখানে?” আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। রত্ন বলে উঠলেন – “ইনি তোমার ৯৭স্তরীয় উত্তরপুরুষ যতীন দাশশর্মা। তোমাদের এখনকার গঙ্গাল রাজ্যের পূর্বপ্রান্তের ভূখণ্ডে এঁর বাস। শুনলে অবাক হয়ে যাবে, ঐ ভূখণ্ড কিন্তু এই সময় বিদেশ। যতীনের আত্মীয়স্বজন প্রায় সকলেই পশ্চিমদিকে চলে যাবেন। যতীন জন্মভূমির মায়া কাটিয়ে যেতে পারবেন না, নানা সমস্যাতেও পড়বেন। দরিদ্র যতীন নিজের সারাবছরের সঞ্চয় দিয়ে ভক্তিভরে দুর্গাপূজা শুরু করেছেন। কিন্তু গতবছর থেকে পাড়ার কয়েকজন সদস্য এই পূজা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন। দুঃখের কথা তার মধ্যে যতীনের এক ধর্মান্তরিত জ্ঞাতিও রয়েছে। তাঁর বাবা খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু ছেলে গানবাজনা জিনিসটা বিশেষ পছন্দ করে না। দুর্গাপূজা বন্ধ করে নববর্ষের সমারোহে যাতে যতীন তাঁর সব টাকা দিয়ে দেন সেজন্য অনেকদিন ধরে জোরাজুরি করছে তারা। আজই প্রতিমার বোধন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার আগেই একদল দুর্বৃত্ত এসে মণ্ডপে এই ধ্বংসলীলা করে যাওয়ার সময় হত্যার হুমকি দিয়ে গিয়েছে। বৃদ্ধ যতীনের পক্ষে এই ধাক্কা সামলানো মুশকিল”।
“আমাকে ফিরিয়ে আনো, ফিরিয়ে আনো” – মুখে হাত চাপা দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন ত্রিবিক্রম। রত্নগোমীন কোনও উত্তর দিলেন না। কাঁদতে আরম্ভ করলেন ত্রিবিক্রম, এমন সময় পা পিছলে গেল তাঁর। তাঁর মনে হল তাঁর দেহটা যেন শূন্যে উঠে যাচ্ছে। অনেক ছায়াপথ নক্ষত্ররাজি অতিক্রম করে তিনি আবার ভূপতিত হলেন। চোখ খুলে দেখেন সম্মুখে রত্নগোমীন দণ্ডায়মান। মুখে তাঁর মৃদু হাসি।
“ এ কি মায়া দেখালেন আপনি?” ত্রিবিক্রম বলে উঠলেন।
– “কালচক্রযান। এ এক নতুন সাধনপন্থা। ভিক্ষুরা এই বিষয়টি ধরতে পারেনি। আমি গত দশ বছর ধরে এই মার্গে সাধনা করে আসছি। মাধ্যমিক ধারার দুই প্রাক্তন পণ্ডিত আমাকে এই বিষয়ে পাঠ দিয়েছেন। সময়, তথা কালই আসল নিয়ন্ত্রক। মহাবিশ্ব প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টি হচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে লয়প্রাপ্ত হচ্ছে। পূর্ব পর – সবই আপেক্ষিক। আসলে সব চক্রাকারে আবর্তিত। কালের গতি উভমুখী। মহাবিশ্বের গভীরতম রহস্য শুধু এই তত্ত্ব দ্বারাই সমাধান করা সম্ভব। আর মহাবিশ্বের ক্ষুদ্ররূপ এই জীবদেহভাণ্ড, তাও প্রকৃতিমধ্যে কালচক্রে নিয়ন্ত্রিত, অস্তমিত ও পুনরুত্থিত হয়।”
ত্রিবিক্রম বিস্ময়স্তব্ধ হয়ে আছেন দেখে রত্নগোমীন বলে উঠলেন “এসো, সর্বাগ্রে তোমাকে দ্বিতীয় অধ্যায়ের চতুর্কুল নিয়ে বলি। তুমি ভিষক, প্রাণ ও শরীরের গূঢ়তত্ত্বই তোমার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ”। – “না!” বলে উঠলেন ত্রিবিক্রম। রত্নগোমীন বিরক্ত হয়ে বললেন – “কালচক্রযানের বিষয়াবলীও চক্রাকার। প্রথম অধ্যায় থেকেই শুরু করতে হবে এমন কোন কথা নেই।”
“সে কথা আমি বলছি না” – ধরা গলায় বলে উঠলেন ত্রিবিক্রম – “শেষে ঐ দৃশ্য দেখে আমি বড়ই বিধ্বস্ত বোধ করছি। আমাকে একটু শান্ত হতে সহায়তা করুন। একটু আনন্দের কোন দৃশ্য আমাকে দেখান, আমার উত্তরপুরুষকে উৎফুল্ল দেখে আমি একটু ধাতস্থ হই”। একটু চুপ করে থেকে রত্ন বললেন “আচ্ছা। এই নাও যন্ত্র। ০, ৯, ৯ চিহ্নিত কীলকগুলি সবলে স্পর্শ করো, একসঙ্গে”।
ত্রিবিক্রম তাই করলেন। আবার সেই তলিয়ে যাওয়া, তবে এবারে প্রস্তুত ছিলেন বলে আর অতটা সমস্যায় পড়তে হয়নি তাঁকে। কিছুক্ষণ পরে স্থিরতা এলে চোখ মেলে দেখলেন তিনি এক কক্ষে একটি শয্যায় শুয়ে আছেন। কিন্তু কক্ষ বা শয্যা কোনটাই তাঁর অচেনা লাগলো না।
এমন সময় ঘরে ঢুকল রত্নদীপ। বলে উঠল – “কিরে ভিকি, এখনও শুয়ে আছিস, ঠাকুর দেখতে যাবি না?” বিরক্ত হয়ে উত্তর করলেন তিনি – “ভিকি ভিকি করিস না তো, বিক্রম বল। বিক্রম বললে যে জোশটা ফিল করি তোর ঐ ভিকি শুনে সেটা ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
একটু পরে বিক্রম দাশগুপ্ত আর রত্নদীপ বড়ুয়া সুসজ্জিত হয়ে পাড়ার মণ্ডপে প্রবেশ করলো। ঢুকতেই মন উচ্ছলিত হয়ে উঠলো তাদের। সম্মুখে বিশালাকৃতি মাতৃকামূর্তি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। সেই দশ প্রহরণ ধারণ করে আছেন, শুধু গঙ্গানগরের রীতিতে যেমন চুলের খোঁপায় সেগুলি সজ্জিত হয়, তার পরিবর্তে এখানে দেবীর দশ হস্তে সেগুলি ধৃত। সেই আদি ঐশ্বর্যময়ী মুখ। চার অনুচরও উপস্থিত। পায়ের তলায় যেন শক্ত মাটি ফিরে এল বিক্রমের। চারিপাশের আনন্দোজ্বল মুখগুলো স্পর্শ করছিল তাঁর চিত্ত। ত্রিনয়নী দুর্গার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে প্রণাম করলো বিক্রম। রত্ন দেখলো, মণ্ডপের এক পার্শ্বে কাঠ দিয়ে বানানো একটি চক্র সমানে ঘুরে চলেছে।

*****