কেউ কথা রাখেনি – সৌভিক সরকার (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

ধুধু তেপান্তরের মাঠ। যেদিকে দুচোখ যায় ,সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু ধূলিকণায় আবৃত ছোট ছোট ঘাসের ‌ঝোপ। এটাই কি তবে পৃথিবীর শেষ প্রান্তর?

 রুক্ষ জনমানবহীন প্রান্তরে নেমে আসছে গোধূলির নরম আলো। হেমন্তকাল । আর কিছুক্ষণ পরে কুয়াশা নেমে আসবে।

 শুধু বহুদূরে ময়ূরাক্ষী নদী তির তির করে বয়ে চলেছে। দৃষ্টি সীমার শেষ প্রান্তে হঠাৎ করে কালো মেঘের আনাগোনা দেখা গেল। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে।

 মেঘ নয় ,পর্বতের মত চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসছে একপাল হাতি ।শীতকালে নদীতে জল কম। তাই পেরোতে সমস্যা হলো না। একের পর এক হাতি সার বেঁধে ছন্দোবদ্ধ ভাবে নদী পার হতে থাকে। মনে হল নদীটি বোধহয় পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে। বদলে এক পাল কালো পর্বত এগিয়ে আসছে।

 প্রত্যেকটা হাতি যুদ্ধ সাজে সজ্জিত। অঙ্কুশ বল্লম তীর-ধনুক নিয়ে যোদ্ধারা প্রস্তুত। তেপান্তরের এক দিক থেকে আরেক দিক পর্যন্ত চলমান কালো পর্বতের সারিতে  ছেয়ে গেছে। ঘনাঘন হাতি বাহিনী এগিয়ে চলেছে ।একমুহুর্তের বিরতি। দ্রিমি দ্রিমি যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। যোদ্ধারা সবাই নিজের নিজের  অস্ত্র শক্ত করে ধরে থাকে। এই উত্তেজনা হাতিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ল। হেমন্তের পড়ন্ত বেলায় ধর্মচক্র ও দুই হরিণের ছবি সহ রাজকীয় পতাকাটা এক বার নড়ে উঠলো।

গৌড়বঙ্গ রাঢ় বঙ্গাল

 মগধ নরেশ ধর্মপাল।।

 প্রত্যেক যোদ্ধার গলা থেকে বেরিয়ে এলো অমানুষিক জয়ধ্বনি। গৌড়বঙ্গ ও মগধের একচ্ছত্র অধিপতি ধর্মপাল দেব অজেয় বাহিনী নিয়ে আবার যুদ্ধ করতে বেরিয়েছেন। দামামার আওয়াজ ও জয় ধ্বনিতে তেপান্তরের মাঠ আকাশ-বাতাস ধূলিকণা অনুরণিত হতে থাকে।

 চন্দন উঠে বসলো। বেশ কদিন ধরেই ভালমতো ঘুম হচ্ছে না তার। এই স্বপ্ন দেখার রোগটা …অনেক বেলা হয়ে গেছে।

***************************

উঠোনে দাঁত মেজে কুলকুচি করতে করতেই মাইকের শব্দ শুনতে পেল- আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে ডাঙ্গা গ্রামের ছেলে, পাড়ার ছেলে ,এলাকার ভূমিপুত্র, কাজের ছেলে, সুখ-দুঃখের সাথী আপনার-আমার ঘরের ছেলে সুপ্রিয় লাহাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন। আগামী দিনে ‘…

পরের কথাগুলো আর খেয়াল করল না সে। ঘরের ছেলে না শুয়োরের বাচ্চা। খিস্তি দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল চন্দন। খিস্তি দেওয়ার কিছু কারণ আছে । গত তিনদিন ধরে চন্দনের জ্যাঠতুতো দাদা সুবল শয্যাশায়ী।

****************************

 পার্টি অফিসে সুবলের গলাটা একটু বেশি চড়ে গেছিল-‘ গত তিন-চার বছর ধরে আমি পতাকা লাগিয়েছি …নেতা মন্ত্রী এলে বাইকে করে এলাকায় ঘুরিয়েছি.. মিছিলে ঝান্ডা ধরেছি আর টিকিট পেল ওই শালা সুপ্রিয়…’

নিতাই ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে দেখলেন। সুবল কে কীভাবে সামলাবেন সেটা ভাবছেন কি?…. মনে হয় না।

-‘ শোন তুই যথেষ্ট পরিশ্রম করেছিস। দল সেটা অস্বীকার

করছে না। কলিমপূর বুথে তুই হচ্ছিস আমাদের দলের সম্পদ।’

 ‘তাহলে?’

 নিতাই হাসলেন -‘সুবল ,তুই এমএ পাস। শিক্ষিত। কিন্তু.. তাতে কি ?. তুই খুব সরল। সবকিছু সমীকরণ মেনে হয় না। তুই জানিস না !.. ..এখন দল এমন লোককে চায় যে আরও দুটো লোক কে ভয় দেখিয়ে চমকিয়ে দাবিয়ে রাখতে পারবে …’

সুবল এত সহজে মানতে চাইলোনা-‘ নিতাইদা আপনি কিন্তু কথা দিয়েছিলেন।’

‘ দিয়েছিলাম…তাই নাকি? মনে পড়ছে না তো। ‘ নিতাই এককথায় অস্বীকার করলেন। সুবলের শুধু অবাক হতে বাকি ছিল।

-‘এটা কোর কমিটির নির্দেশ। সুপ্রিয় এই বুথের পক্ষে বেস্ট চয়েস। আমি শিওর… আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও তাই বলছে।’

‘আপনার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। ছাগলের আবার আমিষ জ্ঞান।’

‘ মুখ সামলে কথা বলিস…. জানিস আমি…’

সুবল মুখ ভেংচিয়ে ওঠে। নিতাই আগের বার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। ষাট হাজার টাকা খরচ করে মাংস ভাত, মদ খাইয়ে মাত্র বারটা ভোট জোটে।

গণনার দিন সকালে ল্যা ল্যা করতে করতে বিডিও  অফিসে গিয়ে…. বিকালে কলিমপুর হাটে মদের দোকানে ফ্যাকার মত মুখ করে বসে ছিলেন। 

পুরনো দিনের সেই স্মৃতি সুবল খুঁচিয়ে দিতেই নিতাইয়ের মাথা থেকে ভালমন্দের ভেদাভেদ টা কিছুক্ষণের জন্য মুছে গেল।

***********************

অ্যাম্বুলেন্সে করে স্ট্রেচারে শুয়ে সুবল যখন বাড়ি ফিরল, তখন তার মাথায় আটটা স্টিচ, ঘাড়ে ও কনুইতে ব্যান্ডেজ বাঁধা, মুখ চোখে কালসিটে পড়ে গেছে।

********************************

ডাঙা গ্ৰামের কলিমপুর মৌজা। গ্ৰামের মাঝখান দিয়ে কলকলার খাড়ি চলে গেছে। এককালে আত্রাই নদীর সঙ্গে যোগ ছিল। নৌবাণিজ্যে এই খাড়ির গুরুত্ব ছিল। এখন আর সেযুগ নেই।

শীতকালে খাড়িতে জল থাকে না বললেই চলে। বরং এখন অপঘাতে মরলে খাড়ির ধারে  পুড়িয়ে দেয়া হয়।অন্য সময়ে মদ গাঁজার আসর বসে।

যদিও গ্ৰামে প্রচুর বড় বড় পুকুর রয়েছে। উঁচু উঁচু তালগাছে ঘেরা পুকুরগুলো গ্ৰামের সৌন্দর্য বাড়ালেও এখানকার জনসাধারণ এসব নিয়ে সচেতন নয়।

এই এলাকায় বহু গ্ৰাম রয়েছে। রাজকীয় নাম তাদের। হাতিশাল, ঘোড়াশাল, রাজারানীর ঘাট, মহারানীর ঘাট- নাম শুনলেই বোঝা যায় এককালে এই গ্ৰামগুলোর প্রচুর গুরুত্ব ছিল। আর এখন … শ্মশানের নীরবতা বিরাজ করে এখানে।

দুপুরে পুকুর পাড়ে বসে চন্দন আনমনে ভাবতে থাকে। ভাবতে তাঁর  ভাল লাগে। এদিকে পারতপক্ষে কেউ আসে না। গ্ৰামের নিশ্চিন্ত নিস্তরঙ্গ জীবনধারাকে অনুভব করার চেষ্টা করে সে। মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে যায় মহীন দাদুর কথা।

মহীনদাদুর কথায় প্রত্যেকটি গ্ৰামের নামের পিছনে কোন না কোন গল্প আছে। হাতিশাল গ্ৰামে সত্যিই হাতি থাকত। ঘোড়াশাল গ্ৰামে ঘোড়া, রাজারানীর ঘাটে রাজা রানীরা স্নান করতে আসত।  হ্যা বড় বড় দীঘি পুকুর দেখে মনে হয় এটা সত্যি।

-‘ কোন রাজা দাদু ?’

-:পাল রাজা গো..পাল রাজা।’

 মহীন দাদু ব্যাখ্যা করে। মাৎস্যন্যায়ের পরে গোপালকে প্রজারা সবাই মিলে রাজা হিসেবে নির্বাচন করেছিল। আদতে এই বরেন্দ্রভূমি থেকেই পাল রাজাদের উত্থান। ধীরে ধীরে পাল রাজাদের দাপট বাড়তে থাকে। বরেন্দ্র মগধ রাঢ় বঙাল সমতট কামরূপ – বিভিন্ন দেশে তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। পাল বংশের চূড়ান্ত সমৃদ্ধির যুগে ধর্মপালের নামে ঘরে ঘরে কীর্তন বসত।

দাদুর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। চন্দন অবাক হয়ে শুনতে থাকে, পন্চাশ হাজার  হাতি নিয়ে যখন পাল সৈন্য যুদ্ধে যেত , কুরু পাঞ্চাল হুণ গুর্জর দ্রাবিড় মাথা নিচু করে সম্মান জানাত। পঞ্চগৌড়ের অধিপতি পাল রাজারা কিন্তু বিনয়ের অবতার ছিলেন। বিক্রমশিলা মহাবিহারে ঢুকলে ছাত্ররা রাজা কে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাত না বরং উল্টোটাই ঘটতো।

চন্দন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জ্ঞানী-গুণীদের সম্মান আজকের দিনে…

 দাদু আফসোস করলেন-‘ আগে আমরা পার্টিটা ভালোবেসে করতাম.. খেয়ে না খেয়ে এলাকায় পড়ে থেকেছি…

টাকাপয়সার ব্যাপারে কোনদিন ভাবতাম না।’

-‘ থাক বাবা আর পুরনো পাঁচালী ঘাটবেন না তো। আপনার হাঁটুর বয়সী সব… তারা পার্টি করে দোতলা তিনতলা বানিয়ে ফেলল…’

 চন্দন এর মা ধমকে ওঠে। দাদু চুপ করে গেলেন। চন্দন শুধু মাথা ঘুরিয়ে  একবার দাদু কে,  আরেকবার মাকে দেখে। চন্দনের মায়ের রাগের যথেষ্ট কারণ আছে ।পুরনো দিনের গল্প শুনে তো আর পেট ভরবে না।

সে গজ গজ করতে থাকে -‘আমরাও তো পার্টি করি। মিছিলে যাই । অথচ কি লাভ টা হল ?…না হল ইন্দিরা  আবাসের ঘর না জুটল একশো দিনের কাজ…’

চন্দনের বাবা বলেন-‘ ওরা তো বলল জবকার্ড নাকি ডিলিট হয়ে গেছে। কিছু বলতে গেলে বলে যান বিডিও অফিসে গিয়ে জানান….’

এই ওরা যে কারা চন্দন ভালমতো জানে। পাড়ার ছিচকে নেতা। আর বিডিও অফিসে তো আস্ত একটা চিড়িয়াখানা। কাকে ধরলে কাজ হবে বোঝা মুশকিল।

*******************************

চন্দন লাইব্রেরী থেকে আনা বই খুলে বসলো। মহীসন্তোষ, মহীপাল দীঘি, মাহীনগর- রাজা মহীপালের নামে এতগুলো জায়গার নাম। ধান ভানতে মহীপালের গীত- আজ প্রবাদবাক্যে পরিণত। এতো আর একদিনে হয়নি।

এত বড় সাম্রাজ্যের মূল কেন্দ্র ছিল এই বরেন্দ্রভূমি। ধল দীঘি,

কাল দীঘি, গড় দীঘি, আলতা দীঘি, মলিয়ান দীঘি – কোন সুদূর অতীতে পাল রাজারা খনন করে গেছেন। আজ আর

লোকে মনে রাখেনি। রাখতেও চায় না।

এই তো সেদিন মাটি খুঁড়তে গিয়ে রাজা রানীর ঘাট থেকে দুটো কষ্টিপাথরের মূর্তি উদ্ধার হল। নেতা, মন্ত্রী ,  মিডিয়া এসে ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিল। সবাই বক্তব্য রাখল। সবচেয়ে সেরা বক্তব্য রাখেন পন্চাদা। গ্ৰামে মিউজিয়াম তৈরী করা থেকে শুরু করে আরো অনেক দাবী তুলেছিলেন। লোকেও হাততালি দিয়েছিল। অথচ এই পন্চাদার বাড়িতে সুবল গেছিল, সেদিন….

-‘তুই ঠিকাদারি করবি ?’পঞ্চা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল।

‘ হ্যাঁ দাদা ।’

পঞ্চাদা এলাকার  এক নম্বর ঠিকাদার ছিল।ব্লক মহকুমা ছাড়িয়ে জেলাতে পর্যন্ত টেন্ডারে অংশ নিত ।এখন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে ঢুকেছে ।

-‘তোর পুঁজি কত ?’

-‘এই পাঁচ লাখ ।’

‘পাচ মোটে?… তুই কি ইয়ার্কি মারছিস ?’

সুবল কুকড়ে গেল-‘ দশলাখ পর্যন্ত ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

 জমিটা বিক্রি করেই অবশ্য …মনে মনে হিসাব করে নেয় সুবল। সেইসঙ্গে পাড়ার আরো তিনটে ছেলে ও কিছু দেবে । সব মিলিয়ে দশ লাখ হয়ে যাবে।

পঞ্চাদা মোবাইল বের করে দেখায় -‘এইটা এক্স ইউ বি ৭০০… পনেরো লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট। চায়নাদির বর নান্টুদাকে এবছর প্রেজেন্ট করেছে।’

‘নান্টুদা মানে?’

‘এম এল এর ভাই ।চায়না দিকে তো আর এমনি এমনি

পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি করা হয়নি। রীতিমতো… নান্টুদার পকেট ভরিয়ে দিতে হয়েছে…. শুধু কি পকেট… শুনেছি টিকিট পাওয়ার আগে নান্টুদার সঙ্গে বিছানায় ঢলাঢলি…চায়নাদির যা একখানা শাসালো ফিগার..’ পন্চা চোখ মারল -‘…নান্টুদার আবার দয়ার শরীর… কাউকেই খালি হাতে ফেরান না…চায়নাদির কপাল খুলে গেল।’ পন্চা ব্যাখ্যা করে ।

সুবল বুঝতে পারেনা তার ঠিকাদারির সঙ্গে চায়না, এসইউভি, নান্টু… এসবের কি সম্পর্ক ?

পঞ্চা এবার সত্যিই রেগে যায়-‘ শোন, তোর দ্বারা হবে না। একটা কন্ট্রাক্ট বাগাতে হলে এম এল একে দিতে হবে, তার পিএকে দিতে হবে,সভাপতিকে দিতে হবে, অঞ্চল প্রেসিডেন্টকে দিতে হবে, এরপর সরকারী বাবুদের টেবিলে টেবিলে। তারপর নান্টু দাকেও দিত হবে।’

-‘ কেন? নান্টুদাকে দিতে হবে কেন?’

-‘ওরে গাধা নান্টু দা হলো এলাকার ঠিকাদার অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি। ওনাকে ভাগা না দিলে এক রাতেই  তোর সব মাল হাপিস হয়ে যাবে।’

সব শুনে সুবল হতাশ হয়ে গেছিল-‘ আমাদের কিছু হবে না রে… বুঝলি কপালটাই খারাপ।’ পুকুর পাড়ে বসে চন্দনকে কথাটা সে বলছিল ।

 তখনো পন্চার কথাগুলো কানের কাছে গুন্ গুন্ করে ভেসে আসছে-‘  দিতে হবে না।… তুই কি  বলিস ? নান্টুকে প্রতিমাসে পঞ্চাশটা ছেলেকে পালতে হয়। তাদের খাওয়া পরা, ভোটের সময় ম্যাগাজিনের যোগান, বাইকের তেল সব কিছুর ব্যবস্থা

রাখতে হয়। কারণ পার্টিটাকে কেউ ভালোবেসে ভোট দেয় না দেয় ভয়ে।… আর এই ভয়টা কে টিকিয়ে রাখতে…’

পুরো ছবিটা পরিষ্কার হতেই সুবল তার পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়।

-‘ চন্দন শুনেছিস পরের মাস থেকে আবার দুয়ারে সরকার শুরু হবে ।’ চন্দন বুঝতে পারলনা দাদার মাথায় আবার কি নতুন মতলব খেলছে।

****************************

ডাঙ্গা হাইস্কুলের লম্বা বারান্দা বরাবর টেবিল চেয়ার পাতা। সরকারি বাবুরা চেয়ারে বসে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। টেবিলের ওপারে একেবারে জনসমুদ্র। দুয়ারে সরকার না দুয়ারে জনতা বোঝা মুশকিল। স্কুলের সামনের মাঠে এত ভিড়। ডাঙ্গাগ্রামে এত লোক কোথা থেকে জুটল। এতসব ভাবার সময় চন্দনের ছিল না।

স্কুলের সামনে আম গাছের নিচে একটা বেঞ্চি পেতে সুবল, নুটু আর চন্দন বসে পড়ল ।

‘ ফর্ম নিয়ে যান দাদা….ফর্ম। কন্যাশ্রী রূপশ্রী স্বাস্থ্য সাথী। প্রত্যেক ফর্ম মাত্র….’

 সুবল থেকে থেকে হাঁক মারতে থাকে ।মুহূর্তের মধ্যেই লাইন করে লোক দাঁড়িয়ে যায়। চন্দনের উপর দায়িত্ব ছিল ফর্ম লিখে দেওয়ার । ফর্ম পিছু দর পন্চাশ টাকা ।

নুটু বলে দিয়েছিল-‘ দেখ চন্দন। প্রচুর লোক হবে। টাইম শর্ট। একটা করে ফর্ম নিবি। টেনে ফিলাপ করে ছেড়ে দিবি। ঠিক হলো না ভুল… অত দেখতে যাবি না।’

‘লোকগুলোকে যে ঠকানো হবে দাদা..’

‘হবে… হবে। আরে ঠিকঠাক ফর্ম ফিল আপ করলেই কি কাজ হবে? সবাই কি সরকারি সুবিধা পাবে?’

-‘ পাবে না?’ চন্দন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।

নুটু হেসে যা বলল, চন্দন অবাক হয়ে যায়।

‘ ওরে গাধা …ওরা যত ঘুরে ফিরে আসবে…তত আমাদের লাভ বুঝলি…নে নে হাত চালা।’

চন্দন প্রাণপণে লিখে যায়। ঘন্টা খানেক পরে দুই সিভিক পুলিশ ছুটে আসে-‘ হেই হেই, তোরা সব গুটিয়ে নে। আর বসা যাবে না।’

‘কেন দাদা?’ নুটু জিগ্যেস করল।

-‘ তোরা লোকের কাছে পয়সা নিচ্ছিস।’

এবার সুবল অবাক হয়ে যায়’ বারে… এতদিন ধরে দুয়ারে সরকারে আমরা এভাবেই চালিয়ে আসছি।’

সিভিক পুলিশ এবার খেপে যায়-‘ শোন কেস খাড়া করবি না তো.. উপর থেকে অফিসাররা ভিজিট করতে আসবে… তার আগে কেটে পড়।’

বাধ্য হয়ে সব গুটিয়ে উঠে যেতে হল। সুবলের এই প্ল্যানটাও ফেল হল।

চন্দন নিজের মনে ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগল।

ভিড়ের মধ্যে তিলধারণের জায়গা নেই। একদিকে চা, আলুকাবলি,চপের দোকান বসেছে। অন্যদিকে সরকারি বাবুদের নাভিশ্বাস উঠছে। চারদিকে ক্যাওম্যাও চলছেই।

এরমধ্যে হঠাৎ একটা টেবিলে চিৎকার উঠল-‘ একি মাসিমা। আপনি তো বার্ধক্য ভাতা পাবেন না। তবু কেন বারবার আসছেন?’

‘ ওসব জানিনা। রেশন ডিলারের বৌ  থেকে পন্চায়েতের বৌ ….সবাই পাচ্ছে। আমি কেন পাব না?’

‘ আরে মাসিমা, আপনার ছেলে তো রেলে সার্ভিস করে। বিডিওর চেয়ে ডবল স্যালারি পায়। তবু,…’

কথা আর শেষ হয় না। বিশাল জনতা যেন টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মার মার কাট কাট শুরু হয়ে যায়। ধাক্বাধাক্বি, হাতাহাতি, ঘুষোঘুষি- কেউ কাউকে চিনতে পারছেনা। এতদিনের চাপা রাগ এবার ফেটে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। গোটা মাঠ জুড়ে শুধু রণক্ষেত্র।

যে কয়টা সিভিক পুলিশ ওখানে ছিল, সব ইউনিফর্ম খুলে লুকিয়ে পড়ল। কে নিয়ন্ত্রণ করবে জনতাকে?

চন্দন প্রথমে ঘাড়ে একটা গুতো খায়… তারপর ধাক্কা খেয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল।

অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে যখন বের করে আনল ঘাড়ে আর কানে মাঝখানে ভীষণ জ্বালা বাম কনুইতে ব্যথা কোন রকমে হাঁপাতে হাঁপাতে স্কুলের পিছনে পুকুরের পাড়ে এসে বসল।

*************************

একদিন রেগেমেগে সে মহিন দাদু কে বলেছিল-‘ দাদু তুমি কেন বারবার পাল রাজাদের কথা বল বুঝতে পারিনা? ইতিহাস বইতে তো চার পাতার বেশি লেখা নেই।’

 মহিন দাদু হাসেন -‘দাদুভাই.… পরে একদিন বুঝবি.. আমরা হলাম গিয়ে পাল রাজার বংশধর… উত্তরাধিকারী….. মহিন পাল…সুবল পাল…. চন্দন পাল …বুঝলি..’

 চন্দন বিশ্বাস করতে পারেনা-‘ এও হতে পারে?’

-‘ হয় হয়… তবে শোন..’

সেদিন মহিন দাদু এক আশ্চর্য কথা বলেছিলেন। কালিন্দ্রী নদীর তীরে পালরাজ তৃতীয় গোপাল ও সামন্ত বিজয় সেন এর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। বহু সামন্ত আগেই পাল রাজের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে যায়।

যুদ্ধের মাঝপথেই গতি প্রকৃতি টের পেয়ে মহাসামন্ত ঐড়দেব তৃতীয় গোপালের সঙ্গে দেখা করেন -‘মহারাজ আপনি এখনই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যান।’

-‘ চলে যাবো ..’নিজের মনে বলে ওঠেন শ্রী মন্মহারাজ পরম ভট্টারক শ্রী গোপাল দেব। যুদ্ধ ছেড়ে চলে যাওয়া  যে মহাপাপ। এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো।

-‘ক্ষমা করবেন মহারাজ ।এই যুদ্ধে আপনি জয়ী হবেন না।‌আর আত্মসমর্পণ করলেই যে শত্রু আপনাকে ছেড়ে দেবে তা কিন্তু নয়। আপনার পুরো পরিবারকে শেষ করে দেবে। বরেন্দ্রভূমি থেকে পালবংশের চিহ্ন মুছে দিতে চায় ওরা।’

জনকভূ বরেন্দ্রভূমি থেকে তাদের মুছে দিতে চায়, যে মাটিতে শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা খেলেছেন বড় হয়েছেন রাজত্ব করেছেন.. সেই পিতৃভূমি বরেন্দ্রে আর তাদের কোন চিহ্ন থাকবে না ।গোপাল দেবের দুই চোখে জল চলে আসে। -‘মহারাজ সময় বেশি নেই ।দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন ।’

‘কিন্তু’- ঐড়দেবের দিকে তাকালেন-‘ মহাসামন্ত পালিয়ে কোথায় যাব বলতে পারেন ? বিজয় সেন যুদ্ধের পরেও খুঁজে বার করবেই…’

‘তারও প্রতিকার ভেবে রেখেছি।’

 পরিকল্পনা শুনে গোপাল দেব মাথা নাড়লেন -‘না এভাবে

মিথ্যাচার করে আপনাকে বিপদে ফেলে পালান …ক্ষাত্র ধর্মের অপমান হবে ।’

ঐড়দেব এবারে জোর করতে বাধ্য হলেন -:এই ছাড়া আর কোন কিছু করার নেই মহারাজ। আপনার মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদ প্রচারিত হলে  বিজয়সেন আর বরেন্দ্রে  থাকবেন না। মিথিলার নান্যদেবকে আক্রমণ করবেন। সেই সুযোগে আপনি নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেবেন।… যুদ্ধের ফলাফল বদলাতে পারবো না আমরা ,কিন্তু আপনি বেঁচে থাকলে যদি ভাগ্যে থাকে …তবে আবার একবার বরেন্দ্রের আকাশে ধর্মচক্র সহ পতাকা উড়বে।’

-‘বেশ ।’গোপাল দেব বিশ্বস্ত মহাসামন্ত কে জড়িয়ে ধরলেন সেই ছিল তাদের শেষ সাক্ষাৎ। ইতিহাস সাক্ষী। যুদ্ধের গতি ঐড়দেব পাল্টাতে পারেননি ।

গোপাল দেব সপরিবারে বহুদূর চলে যাওয়ার পর …

ঔড় দেব চিরাচরিত সর্বতোভদ্র শৈলীতে ব্যূহ সাজিয়ে আক্রমণে মন দিলেন। ধর্মচক্রকে মাঝখানে রেখে সামনে রাখলেন অগ্রবাহিনীকে। দুই পাশে বর্গসৈন্য ও ধানুকীরা। সঙ্গে রইল ঘোড়সওয়ার বিশ্বস্ত ডোম সৈন্যরা। বাদ্যকররা রণবাদ্য বাজাতে বাজাতে এগিয়ে চলল।

 আগে‌ ডোম বাগে ডোম

 ঘোড়া ডোম সাজে

 ঢাক মৃদঙ্গ ঝাঁজর বাজে

 বাজাতে বাজাতে চললো ঢুলি…

……..

 মরণপণ যুদ্ধ হলো। রাজভক্ত ঐড়দেব ক্ষত বিক্ষত শরীরে

যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ ত্যাগ করেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অপর এক অনুগত সামন্ত মিজাং গোপাল দেব ও ঐড়দেবের শ্রাদ্ধ শান্তি করে নিমদিঘিতে প্রশস্তি বসান:

শ্ৰীমদ গোপালদেব স্বেচ্ছায় শরীর ত্যাগ করে স্বৰ্গত হয়েছেন এবং তার পদধূলি মিজং নামে প্রথিত আমি (হায়!) এখনও বেঁচে আছি। পিতৃ আজ্ঞায় (রাজার প্রতি) প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অসীম কৃতজ্ঞাসম্পন্ন ঐড়দেব সেনশত্রুকে একশোটি তীক্ষ্ণ তীর দিয়ে ধ্বংস করে আটজন সহচরসহ রাজার সাথে স্বর্গে গিয়েছেন। যুদ্ধদ্বারা নিজের (জীবিতাবস্থা) অতিক্রম করে চন্দ্ৰকিরণের মতো আমল যশ অর্জনপূর্বক শুভদেবানন্দন (ঐড়দেব) দেবতাগণের মতো ত্ৰিদশ সুন্দরীগণের দৃষ্টি নিয়ে খেলা করছেন। তার (ঐড়দেবের) গীতবাদ্যপ্রিয়, ধর্মধর অমৎসর, গলবস্ত্ৰ, দানশূর সুসংযত বেশ বৈমাত্ৰেয় ভ্ৰাতা শ্ৰীমান ভাবিক যজ্ঞাদি ধর্মকার্য (শ্রাদ্ধ) সম্পাদন করেন। শরশিল্য দ্বারা নিহত বহু প্ৰাণীকে (সৈন্যকে) যে স্থানে দগ্ধ করা হয়েছিল, সেই স্থানে ভাবকাদাসকৃত এই কীর্তি (মন্দির) বিরাজ করছে।…’

গোপাল দেব আর জীবিত নেই… এই খবর শুনে বিজয় সেন তার বাহিনী নিয়ে প্রত্যাশামতোই মিথিলার দিকে অভিযান শুরু করলেন। যদিও পরবর্তীকালে পাল বংশের অন্যান্য জ্ঞাতিবর্গ মগধ আর অঙ্গরাজ্যে রাজত্ব করলেও পাল বংশের মূল ধারা টি কোথায় হারিয়ে গেল… কেউ বলতে পারেনি। ধীরে ধীরে পাল বংশের উত্তরাধিকারীরা সাধারণ জনসমাজে মিশে যেতে শুরু করল ।তারা ভুলে গেল তাদের অতীত ঐতিহ্য ও গরিমার কথা।  যে যোগীপাল ভোগীপালের গীত

শুনে তারা বড় হল, জানতেই পারলো না সেইসব মহান পুরুষদের রক্ত তাদের গায়ে বইছে।

**********************

স্কুলে শৈলেন বাবু ইতিহাস পড়াতেন। একদিন একা পেয়ে তাকে গল্পচ্ছলে চন্দন জিজ্ঞাসা করেছিল।

তিনি কিছুক্ষণ ভাবেন-‘তাই কি?.. অতীতের একটা দুটো ঘটনাকে পাল্টে দিলেই কি ইতিহাসের গতিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়?… যায়না ।’

চন্দন অবাক হয়ে শুনতে থাকে-‘দ্যাখ, চন্দন আমরা যে ইতিহাস বইতে পড়ি, সোজাসাপ্টা কথায় একটা ন্যারেশন মাত্র। ধারাবিবরণী ।আমরা এ থেকে তথ্য জানতে পারছি কিন্তু ইতিহাসকে বুঝতে পারছিনা।  ইতিহাস শুধুমাত্র রাজা বা যুদ্ধের কথা বলে না। এখানে সমাজ রাজনীতি ধর্ম – সব কিছু জড়িয়ে রয়েছে। আজ নাদের শাহ যুদ্ধে হেরে গেলে কি হতো এই প্রশ্নটা অবান্তর। নাদের শাহ ভারতে আসার বহু আগে থেকেই মোগল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়ে গেছিল । মোহাম্মদ ঘোরীর বিরুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহান কে কোন রাজা সাহায্য করেনি । আরে ঘোরী যখন গুজরাট আক্রমণ করেছিল চৌহান তখন মূলরাজকে কেন সাহায্য করেনি? পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদৌলা যদি না হারতো ?….আরে বাবা পলাশীর যুদ্ধের বহু আগে থেকেই বাংলার নবাবী দুর্বল হয়ে পড়েছিল। অপদার্থ হিসেবে সিরাজদৌলা ও শওকত জং একই ক্যাটাগরীর ছিল। না হলে কেউ বৃষ্টির সময় গোলাবারুদ খোলা অবস্থায় রাখে । একটা কমনসেন্স থাকবে না?’

চন্দন কথা বাড়ায়নি। সত্যিই তো… ইতিহাসের গতিমুখ কেউ

পাল্টাতে পারে নি। আর সেটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার কোন মানে হয় না। কালিন্দ্রীর যুদ্ধে গোপাল দেব বেঁচে ফিরলেও পালবংশের জয়পতাকা আর কোনদিন বরেন্দ্রের আকাশে ওড়েনি।

চন্দনের ‌খেয়াল হল। কলকলা খাড়ির ধার বরাবর ছোট ছোট বাড়িগুলোতে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। নিস্তরঙ্গ ডাঙ্গা গ্ৰামে আরও একটা নিস্তদ্ধ রাত নামতে চলেছে। পুকুরপাড়ে বসে উলু ও ঘন্টার আওয়াজ শুনতে পেল সে।

বেলা পড়ে আসছে। একে একে সবাই ঘরে ফিরবে। স্কুলের মাঠে এখন কি অবস্থা? তার আর ইচ্ছা হলনা যে গিয়ে দেখে আসে।

আর বসে সময় নষ্ট করা চলে না। সুবল আর নুটু এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়ি চলে গেছে। সেও চুপচাপ পা ফেলে বাড়ির দিকে হাটতে থাকে।

চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানিচ দুখানি চ। ।

‘সুখ আর দুঃখ সময়ের আবর্তে বারবার ফিরে আসে। আজ যে রাজা কাল সে ফকির। এতো হামেশাই হচ্ছে। আজ যে মন্ত্রী কাল সে জেলের আসামি। সাম্রাজ্যের গঠন একদিনে যেমন হয়না,  তেমনি পতনও একদিনে হয়না। দোষটা হল আমাদের যে, ইতিহাস থেকে আমরা কিছুই শিখিনা।’

শৈলেন বাবুর কথাগুলো কানের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

এককালে মে গ্ৰামগুলো গমগম করত, বিশাল হস্তীবাহিনী আর্যাবর্তকে পায়ের নীচে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলত, বরেন্দ্রের আকাশ বাতাস পন্চগৌড়ের অধিপতি পাল রাজার জয়ধ্বনিতে কেঁপে উঠত,…আজ সেখানে সেই বংশের

উত্তরাধিকারীদের সামান্য দুটো পয়সার জন্য নেতাদের দরজায় দরজায় ঘুরে তেল মারতে হচ্ছে।

সত্যিই ভাবা যায় না। চন্দন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কেউ টেরও পেল না … শুধু কলকলা খাড়ির ধারে গ্ৰামের নিস্তরঙ্গ প্রকৃতি ছাড়া…

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s