শিবিখ্যা মাতৃকার উপাসনা

কাল ছিল আষাঢ়ের নবমী। রাঢ়ে এই তিথিতে শিবিক্ষা(শিবিখ্যা) মাতৃকার পূজা হয়। সুপুরের সুরথ রাজার ঢিবির কাছেও শিবিক্ষার থান আছে। বোলপুরের যেখানে সুরথ মহামায়ার নামে লক্ষবলি দিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে; সেখানেও শিবিক্ষা আছেন। এছাড়া অজয় অববাহিকার বিভিন্ন স্থানে তাঁর প্রাচীন পীঠ খুঁজে পাওয়া যায়। শিবিখ্যা অর্থাত শিবা এই আখ্যায় আখ্যায়িতা অথবা শিবারূপিণী। রাঢ়ের শিবিখ্যা থেকে মলুটির মা মৌলিখ্যা হয়ে কামরূপের কামাখ্যা পর্যন্ত নামের মিল লক্ষণীয়। বৃহৎ বঙ্গের ব্রাত্য সংস্কৃতির নিজস্ব ভাষারীতির অগণিত নিদর্শনের এটিও একটি। শিবিখ্যা রূপে মাতৃকার মুখাবয়ব শিবা অর্থাত শৃগালের মতো। তিনি শিবাদের দ্বারা পরিবেষ্টিতা। তাঁর এই মুখাবয়ব তন্ত্রের আদিতম অধ্যায়ের সাথে সংযুক্ত। হরপ্পায় এবং পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে পক্ষীর মুখাবয়ব সম্পন্না মাতৃকা পূজিতা হতেন। বলাকিনী; বগলামুখী; কাকীমুখ প্রমুখ নামে সেই উপাসনার রীতি আজও বিদ্যমান। একইভাবে এই নিশাচর শিবা কোক( নেকড়ে) প্রমুখ জীবের মুখাবয়বেও মাতৃকা আমাদের সংস্কৃতিতে বন্দিত হয়েছেন। তমাল দাশগুপ্ত মহাশয়ের কাছে জেনেছি হরপ্পার ঝোব উপত্যকার পক্ষীমাতৃকাকে যুগপৎ মৃতদের রক্ষক এবং শস্যদায়িনী মাতৃকা রূপে উপাসনা করা হতো; এই বিষয়ে অধিকাংশ গবেষক সহমত। সম্ভবত মৃতের সমাধি এবং শস্যের উদ্ভব দুইই ধরণীর গর্ভে হয় বলেই এমন একীভবন। গ্রীসে পৃথিবীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী নেকড়েদের দ্বারা পরিবেষ্টিতা; সুকুমার সেন লক্ষ্য করেছেন। আবার বেদের রাত্রিসূক্তে নিশাদেবীর সন্তানরূপে নিশাচর বৃক বা নেকড়েদের প্রসঙ্গ এসেছে। নিশাদেবীর কোলে সমস্ত জগত কর্মক্লান্তি অপনোদন করে। তাঁর সন্তান বৃকগণ যেন তাদের ক্ষতি না করে; এমনটাই ছিল সেই সূক্তের প্রার্থনা। সুতরাং সমস্ত চরাচরকে যিনি ধারণ করে আছেন; সেই অব্যক্তা প্রকৃতির তত্ত্বই শিবামুখী শিবিখ্যার তত্ত্বে প্রকাশিত হয়েছে।
হরিবংশে শিবারূপে দেবী যোগমায়া বসুদেবকে কৃষ্ণকে নিয়ে গোলোকে আসার সময় পথপ্রদর্শন করেছেন। বৈন্যগুপ্তের বৈগ্রাম তাম্রশাসনে কোকামুখী মাতৃকা এবং কোকামুখস্বামী বিষ্ণুর উল্লেখ পাই। বিষ্ণুর নৃসিংহ ও বরাহ রূপ আজও পূজিত হলেও কোক অর্থাত শৃগাল বা নেকড়ের মুখ আজ অবলুপ্ত। কিন্তু এই উল্লেখ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ হরিবংশের একানংশা যোগমায়া ও বাসুদেবের মতোই এটিও প্রাচীন ভাগবতধর্মের সাথে মাতৃসাধনার আদিতম ধারার নিবিড় সংযোগের অনবদ্য দৃষ্টান্ত।
চণ্ডীতে রক্তবীজ এবং শুম্ভ নিশুম্ভের সাথে দেবী কৌশিকীর সংগ্রামের সময় যখন সপ্তমাতৃকা এবং চামুণ্ডা রণক্ষেত্রে অবতীর্ণা; তখনই দেবীর দেহ থেকে আবির্ভূত হচ্ছেন অত্যন্ত উগ্রা দেবী চণ্ডিকা। তিনি শত শত শৃগালের রবের মতো ধ্বনিতে দৈত্যদের সন্ত্রস্ত করেন। তিনি শিবদূতী। তিনি শিবকে শুম্ভের কাছে দূত হিসাবে প্রেরণ করে বলেছিলেন: যদি একান্তই যুদ্ধের অভিলাষ রাখো; তবে তোমাদের রক্ত ও মাংসে আমার শিবাগণকে তৃপ্ত করো। তাঁর অট্টহাস্যকে চণ্ডীর কথক অশিব বা অমঙ্গলসূচক বলেছেন। শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয়ের মতে; তাঁর শিবদূতী নামের সাথে শিবাগণের সংযোগও আছে। অন্যদিকে পালযুগে বজ্রযোগিনীর সাধনক্রমে দেবীকে অতিভয়াকুল শ্মশানে নিশাচর জীবদের দ্বারা পরিবৃত অবস্থায় ধ্যান করা হয়েছে। বাঙালির প্রাণের মাতৃকা কালী ও তারার সাথে আজও নিত্য সহচর রূপে শৃগালদের দেখি আমরা। শিবাভোগ আজও মা কালীর সাধনার এক রহস্যময় অনুষ্ঠান; যেখানে ধারণা করা হয় মাতৃকা স্বয়ং শৃগালের মাধ্যমে ভোগ গ্রহণ করেন। তাই শিবিখ্যা বাঙালির মাতৃসাধনার অগণিত ধারার উৎসে আছেন।

আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। দেবীর উপাসনার তিথিটি বর্ষার মধ্যলগ্নে। প্রবল বর্ষণে যখন সমস্ত আকাশ অন্ধকার; অথচ সেই অন্ধকার আগামী দিনের শস্যের ও মাছের প্রাচুর্য, নদীমাতৃক সভ্যতার উর্বরতার চরম পর্যায়ের বার্তা বয়ে আনছে; সেই মুহূর্তেই দেবীর উপাসনার তিথি। হরিবংশের শিবারূপিণী যোগমায়ার উল্লেখটি যেন এই তিথিরই প্রতীকী। সেখানেও প্রবল বর্ষণের মধ্যে ভবিষ্যতের যুগাবতারের বার্তা বহন করছেন দেবী নারায়ণী। এই তিথি তাই নদীমাতৃক মাতৃপূজক বাঙালির সংস্কৃতির মহা উদযাপনের তিথি।

রক্তিম মুখার্জ্জী

তথ্য কৃতজ্ঞতা তমাল দাশগুপ্ত মহাশয়।
ছবিতে ঝোব উপত্যকার মাতৃকা, পাণ্ডুরাজার ঢিবির পক্ষীমাতৃকা( কৃতজ্ঞতা তমাল দাশগুপ্ত মহাশয়) ; বাংলার টেরাকোটার মন্দিরে কোকমুখী কালী এবং মঙ্গলকোটের একটি প্রাচীন মুদ্রায় শিবামুখী মাতৃকা। শেষোক্ত ছবিটি পেয়েছি Ranadeb Mukherjee মহাশয়ের কাছে।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s