বারো মাসে তেরো ষষ্ঠী। বারো মাসে তেরো পার্বণের মতোই সম্বৎসর ধরে ষষ্ঠীর বারংবার উদযাপন বাঙালির ধর্মভাবনার এক বৈশিষ্ট্য। ষষ্ঠী সন্তানদায়িনী মাতৃকা। সন্তান পরিবেষ্টিতাও তিনি। কাঁখে কোলে আর হাতে সন্তানদের ধারণ করে তাঁর মাতৃরূপের প্রতীক আজও আঁকা হয় ষষ্ঠীপূজার সময়। বসুন্ধরা মাতৃকার প্রতীক রূপে আঁকা বসুধারা চিহ্নের মতোই এই চিহ্নটিও আবহমান কাল ধরে বাঙালির কাছে মঙ্গলের প্রতীক। আদিমাতৃকার যে রূপগুলি তাম্রাশ্মযুগ থেকে প্রচলিত তার মধ্যে সন্তানকোলে জননীরূপে তাঁর বিগ্রহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশ্বচরাচর তাঁর থেকে উদ্ভূত। তাঁর কোলেই কীট থেকে মহামানব পর্যন্ত সকলের অস্তিত্ব। এই তত্ত্বই সন্তানকোলে মাতৃমূর্তির অন্তর্নিহিত ভাবনা। গঙ্গারিডির শিশু কোলে মাতৃমূর্তি; সন্তান কোলে ষষ্ঠী; শিশু শিবকে কোলে নিয়ে বশিষ্ঠারাধিতা তারা; গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোকে ভয়গ্রস্ত কৃষ্ণকে কোলে নিয়ে রাধা; গণেশজননী উমা; স্কন্দমাতা; সবই এই তত্ত্ব থেকেই উৎসারিত।
ষষ্ঠীর নামের একটি ব্যাখ্যা হল তিনি আদি প্রকৃতির ষষ্ঠাংশ। আবার বাঙালির প্রাচীন সমাজে সাঙ্খ্য প্রভাবিত তন্ত্রে সংখ্যার বিশেষ গুরুত্ব ছিল। সাঙ্খ্য শব্দটির একটি ব্যুৎপত্তিই হল : সংখ্যার মাধ্যমে তত্ত্ব আলোচনা। তন্ত্র ও ব্রতকর্মে তিন, পাঁচ, সাত, আট, নয়, তেরো, চৌদ্দ প্রভৃতি সংখ্যার বিশেষ গুরুত্ব দেখতে পাওয়া যায়। মনসার উনকোটি (৯৯৯৯৯৯৯) নাগ, ভূত চতুর্দশীর চৌদ্দ ভূত, বণিকদের সপ্তডিঙা, ভাগবতধর্মের পাঞ্চরাত্র, বিপত্তারিণী পূজার তেরো সুতো, রূপকথার সাত সাগর তেরো নদী সবই সংখ্যার তান্ত্রিক তাৎপর্যের দৃষ্টান্ত। পরবর্তী সময়ে চৌষট্টি যোগিনী, কালীর পঞ্চদশ নিত্যা, চুরাশি মহাসিদ্ধ, একান্ন পীঠের মধ্যেও এই ভাবনারই প্রতিফলন ঘটেছে। অন্যদিকে বারো মাসে তেরো ষষ্ঠীরও তান্ত্রিক তাৎপর্য আছে। দেহতত্ত্বে ষটচক্রের প্রতীক হিসাবে বারো এবং নিরালম্ব সহস্রার সেই বারোর উপরে তেরো; এই তত্ত্বই সম্ভবত এখানে প্রকাশিত। বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীজ, বারো চড়ুইয়ের তেরো ডিম, বারো ঘর তেরো উঠান, বারো মাসে তেরো পার্বণ প্রভৃতি রহস্যময় শব্দবন্ধও সম্ভবত একই তাৎপর্য বহন করে।
ষষ্ঠীর ব্রতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল অরণ্যপ্রকৃতির সাথে নিবিড় সংযোগ। সাতটি বাঁশপাতা ও সাতগাছি দূর্বা দিয়ে তাঁর রূপ নির্মিত হয় জৈষ্ঠ্য মাসের অরণ্যষষ্ঠীর দিনে। দুর্গাপূজার নবপত্রিকার মতোই এ হল অরণ্যানি তথা শস্যমাতৃকা প্রকৃতির প্রতীক। তাঁর বাহন কালো বেড়াল। আমরা জানি গোধা বা গোসাপ নিয়ে দেবী মঙ্গলচণ্ডীও অরণ্যপ্রকৃতির মধ্যে অধিষ্ঠিতা; নিষাদ, পুলিন্দ, শবরগণ কর্তৃক পূজিতা। ষষ্ঠীর উপাসনাও এর সাথে একই সূত্রে গাঁথা। আবার মঙ্গলচণ্ডীর ব্রতে ষাঠ বা ষষ্ঠী এবং জাঠ বা জ্যেষ্ঠা চণ্ডিকার দুই সহচরী।
প্রকৃতির মধ্যে মাতৃকার যে অপূর্ব প্রকাশ বাঙালির আদি পূর্বসূরিরা উপলব্ধি করেছিলেন; ষষ্ঠীদেবী তারই অনবদ্য বিগ্রহ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর থান কোনো বটগাছ বা অশ্বত্থ গাছের নিচে। ত্রিকোণাকার শিলাখণ্ড, ডিম্বাকার নোটন, রান্নাঘরের শিল তাঁর প্রতীক রূপে পূজিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ত্রিকোণাকার শিলা তথা মৃৎফলক সমগ্র বিশ্বে মাতৃকার বিমূর্ত বা aniconic রূপসমূহের মধ্যে প্রাচীনতম এবং হরপ্পা থেকে পাণ্ডুরাজার ঢিবি পর্যন্ত তার বহুল প্রচলনের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মিলেছে। পূর্ববঙ্গে আজও টেপাটেপি পুতুলে ষষ্ঠীপূজার রীতি আছে। এই ধরণের গোল চোখ, ছোটো হাত, তীক্ষ্ম নাক আর মোটা পেটযুক্ত schematic মূর্তি তাম্রাশ্মযুগের মূর্তিশৈলীর বৈশিষ্ট্য এবং সিন্ধু সভ্যতা, পাণ্ডুরাজার ঢিবির উৎখননে তো বটেই; কালীঘাটের মা কালী এবং পুরীর জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার মূর্তিতেও আজও তার প্রকাশ দেখতে পাই আমরা।
আজ অরণ্যষষ্ঠীর উপাসনার তিথি। বিশ্ব পরিবেশ দিবসও বটে। যাঁরা তাম্রাশ্মযুগ ও লৌহযুগের সূচনাকালে প্রকৃতির মধ্যে নিহিত মাতৃকার বিশাল রূপকে স্নেহময়ী ষষ্ঠী দেবীর রূপ দান করেছিলেন; তাঁর উপাসনায় ঘরের আদরের সন্তান থেকে পোষা বিড়াল পর্যন্ত সবার মঙ্গলকামনার মহতী ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন; তাঁদের সেই প্রাচীন অথচ আধুনিকতম মননের জন্য কোনো শ্রদ্ধাই যথেষ্ট নয়। বাঙালির ব্রতকর্মের সব দেবীই করুণার মূর্ত বিগ্রহ। তাঁরা অন্ধকে চক্ষু দেন; নিরন্নকে অন্ন দেন; সন্তানহীনকে সন্তান দেন; পথহারাকে পথ দেন। অবলোকিতেশ্বরের জগতের দুঃখ দেখে নির্বাণসুখ পরিত্যাগ; মহাযানের মহাকরুণা; বজ্রযানের আর্যতারার করুণাময়ী রূপ; সবই উৎসারিত হয়েছে বাঙালির সমাজভাবনায় নিহিত এই আর্ততারণের মধুর ভাবনা থেকেই। চিরন্তন স্নেহের প্রতিমূর্তি হয়ে শিশুসন্তান পরিবৃতা মা ষষ্ঠীও বারো মাসে তেরোবার আমাদের মাতৃভূমিতে নিজের সেই মধুরতম রূপেই চিরকাল অবতীর্ণ হন।
রক্তিম মুখার্জ্জী
ছবি ও তথ্য কৃতজ্ঞতা তমাল দাশগুপ্ত মহাশয় ও ময়ূখ ভৌমিক মহাশয়


