রমণীর নৃত্যকে বলে লাস্য। পুরুষের নৃত্যকে বলে তাণ্ডব। পুরুষ ও নারীর মিলিত নৃত্য হল্লীসক নামে পরিচিত। আর সেই হল্লীসক যদি নৃত্যগীত সহযোগে আরো রমণীয় হয়ে ওঠে তখন তাকে রাসনৃত্য অভিধায় অভিহিত করা হয়। শ্রীধরস্বামী রাসের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছেন:
“অন্যন্যব্যতিরক্তহস্তানাং স্ত্রীপুংসাং গায়তাং মণ্ডলীরূপেন ভ্রমতাং নৃত্যবিনোদো রাসো নাম।”
অর্থাত্ স্ত্রীপুরুষগণের পরস্পরের হাত ধরে মণ্ডলরচনা করে নৃত্যগীত সহযোগে ভ্রমণপূর্বক যে নৃত্য; তারই নাম রাস।
রাসলীলা বর্তমানে বৈষ্ণবীয় লীলাতত্ত্বের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা। রসতত্ত্বের চরমে রাসের উদ্ভব। হরিবংশ ও বিষ্ণুপুরাণে প্রথম রাসনৃত্যের বিবরণ পাওয়া যায়। কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে গোপীবৃন্দের হল্লীসক নৃত্যই এই দুই পুরাণে উল্লিখিত হয়েছে। সেখানে কৃষ্ণ একাকী নন; বলরামও তাঁর সঙ্গে আছেন। এবং কৃষ্ণ শুধুই বংশীধ্বনি করছেন না। তিনি গোপীগণের মনোহরণের জন্য বিবিধ বাদ্যসহযোগে মধুর গীত পরিবেশন করছেন।
সহ রামেণ মধুরম্ অতীব বনিতাপ্রিয়ম্
জগৌ কলপদম্ শৌরীর্নানাতন্ত্রীকৃতব্রতম্।।
এই জগৌ কলপদম্ পদাংশটিই বৈষ্ণবীয় রসতত্ত্বে তান্ত্রিক তাৎপর্যে উন্নীত হয়েছে একাক্ষরী কামবীজের ব্যাখ্যায়; যখন ভাগবতে উল্লিখিত মুরলীর পঞ্চম তানকে বলা হয়েছে ” জগৌ কলপদম্ বামদৃশাম্ মনোহরম্”
এই দুই পুরাণে রাধার নামোল্লেখ না হলেও রাইকমলিনীর কমলিনীভাবসংযুক্তা জনৈকা গোপীশ্রেষ্ঠার উল্লেখ আমরা পাই; যখন বিষ্ণুপুরাণ রাসমণ্ডল থেকে সহসা অন্তর্হিত কৃষ্ণকে এবং তাঁকে অনুসরণকারিণী সেই গোপিকাকে বর্ণনা করে:
কৃষ্ণম্ শরচ্চন্দ্রমসং কৌমুদীম্ কুমুদাকরম্
জগৌ গোপীজনস্ত্বেকম্ কৃষ্ণনামম্ পুনঃপুনঃ।।
এই শ্লোকটির দ্বারা।
কৃষ্ণরূপ শরৎচন্দ্র যে কুমুদিনীর জন্য কৌমুদীস্বরূপ; তিনিই এই গোপীশ্রেষ্ঠা। তিনিই পরে ভাগবতের রসরাজের পরমাহ্লাদিনী; ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের শ্রীরাধা।
লক্ষণীয় বিষয় হলো এই অপূর্ব বিশেষণটি কিন্তু পরবর্তী বৈষ্ণব সাহিত্যের রসতত্ত্বের সারকথাটিই সংক্ষেপে বলে দিয়েছে। কৃষ্ণরূপ চন্দ্রের সার্থকতা গোপীকুমুদিনীর জন্য কৌমুদী বিতরণে। অর্থাত্ প্রকৃতিশক্তির সংযোগেই ঐ পরম পুরুষের সার্থকতা। অন্যথায় কৃষ্ণচন্দ্রের কৌমুদী অর্থহীন।
এখানেই পরমা প্রকৃতির জয়বার্তা ঘোষিত হয়েছে।
হল্লীসকের প্রাকৃতকাব্যে মধুরতম গীতি হালের গাথাসপ্তশতী। সেখানেও গোপচূড়ামণি গোপীগণপরিবৃত। তবে তারই মধ্যে জনৈকা গোপিনীর প্রতি তাঁর অধিক অনুরাগ। নৃত্যকালে সেই বিশেষ গোপিনীর চোখে ধুলো পড়লে তিনি নিজে তার নেত্রে ফুৎকার দিচ্ছেন। এখানেও পুরুষ প্রকৃতির ভাবে ব্যাকুল; তন্ময়।
এরপর ভাগবতের রাসপঞ্চাধ্যায় ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ রাসের যে মধুরতর বর্ণনা করেছে; তা মাধুর্যের শীর্ষে উপনীত হয়েছে জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যের মধুরকোমলকান্তপদাবলীতে। মূলতঃ রাসকে কেন্দ্র করে নায়ক নায়িকার বিলাসলীলার সমস্ত ভাবরাজিকে তিনি উত্তুঙ্গ উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। প্রকৃতির প্রতি পুরুষের পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শনকারী এই কাব্য আরম্ভ হচ্ছে মেঘমেদুর আকাশ এবং বনের তমালবৃক্ষরাজির শ্যামলিমা দর্শনে ভীত কৃষ্ণের রাধার অঙ্কাশ্রয়ী হয়ে নির্ভরতা লাভের বর্ণনায়। রাধার কোলে একান্ত আশ্রিত কৃষ্ণকে দেখে কবি বলেছেন: রাধামাধবোর্জয়ন্তি যমুনাকুলেরহ কেলয়।
এই ভাবই তার পূর্ণরূপ লাভ করেছে যখন রাসমণ্ডলে রাধার মানভঞ্জন করতে কৃষ্ণ বলেছেন: স্মরগরলখণ্ডনম্ মম শিরসিমণ্ডনম্ দেহি পদপল্লবমুদারম্।
আকুল হয়ে কৃপাপ্রার্থীর মতো বলেছেন: ত্বমসি মম জীবনম্ ত্বমসি মম ভূষণম্ ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম্
জয়দেবের সহজপ্রেমের এই ভাবের সাথে হুবহু মিলে যায় ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে কৃষ্ণকর্তৃক রাধার মহিমাবর্ণনা; যেখানে কৃষ্ণ রাধাকে বলেছেন:
ক্ষীরের ধাবল্য,অগ্নির দাহিকাশক্তি,পৃথিবীর গন্ধতত্ত্বের মতো তোমা হতে আমি অভিন্ন। আমি বীজরূপ; তুমি সৃষ্টির আধারভূতা। তুমি ভিন্ন আমি জগতকার্যে একান্ত ভাবেই অক্ষম।
সুতরাং রাসের মূল তত্ত্ব হল নায়িকাবৃন্দকর্তৃক পরিবৃত নায়কের আনন্দনৃত্য; যেখানে নায়িকাশ্রেষ্ঠার প্রতি নায়কের পূর্ণ আনুগত্যই প্রকাশিত। রাসের পুরুষতত্ত্ব কৃষ্ণ প্রকৃতিরূপিণীর বিমূর্ত ভাবকে আত্মস্থ করে প্রকৃতিময়। তাই বলাই যায় কেন্দ্রে পরমাপ্রকৃতি ও তদাশ্রিত পুরুষ এবং পরিধিতে প্রকৃতিশক্তির অংশরূপা সহচরী শক্তিগণ; এটাই রাসমণ্ডলের মূল আকৃতি। আমরা যখন সর্বতোভদ্রমণ্ডলে অষ্টদলকমলের কেন্দ্রে অষ্টচণ্ডিকাগণ পরিবৃতা রুদ্রচণ্ডিকার রণরঙ্গ দর্শন করি; যখন পীঠপূজায় সহস্রদল কমলের কর্ণিকায় অষ্টসখীপরিবৃতা মহাসিংহারূঢ়া দুর্গা বা সদাশিব মহাপ্রেতাসনা কালিকাকে দেখি; তখন রাসেরই এক অন্যতম রূপ দর্শন করি আমরা। এখানে ঐ সিংহ বা সদাশিবই সেই পুরুষ; যে মাধুর্যরসে রাধার চরণকমল ধারণ করে নিজ শিরে। আরো আদিতে এই পুরুষও ছিল না। শুধুই মুখ্য মাতৃকা তাঁর সহচরীগণ পরিবৃত হয়ে নৃত্যরতা; এটাই ছিল সেই রাসমণ্ডলের মূল চিত্র। চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত একটি মৃৎপাত্রে এইরকম একটি মণ্ডল পাওয়া গেছে। দক্ষিণ ভারতীয় কবি রামকৃষ্ণের মহিষাসুরমর্দিনীস্তোত্রে আমরা এই চিত্র পাই। সেখানে দেবীর বংশীধ্বনি সমবেত কোকিলকন্ঠকে লজ্জা দিচ্ছে; তাঁরই অংশভূতা মহাযোগিনীগণের কেন্দ্রে তিনি নৃত্যরতা।
করমুরলীরববিজিতকুজিতলজ্জিতকোকিলমঞ্জুমতে
মিলিতপুলিন্দমনোহরগুঞ্জিতরঞ্জিতশৈলনিকুঞ্জরতে
নিজগুণভূতমহাশবরীগণসদগুণসম্বৃতকেলিরতে
জয় জয় হে মহিষাসুরমর্দিনী রম্যকপর্দিনী শৈলসুতে।।
শিব ও উমার রাসনৃত্যও পুরাণে পাওয়া যায়। সেখানেও একই ভাব প্রকাশিত। তাছাড়া কর্পূরমঞ্জরী নাটকে কবি রাজশেখরের উপাস্যরূপে যখন সেই হরকে দেখি যিনি স্বীয় জটানির্গত গঙ্গাধারা ও ললাটচন্দ্রের জ্যোৎস্নার অর্ঘ্য উমার চরণে নিবেদন করেন; কিম্বা যখন বসুবন্ধুর বাসবদত্তায় কাত্যায়নী দেবীকে “প্রণয়প্রণত-গঙ্গাধর-জটাজুটস্খলিত-জাহ্নবীজলধারা-শ্বেতপাদপদ্মা”রূপে দেখি তখন বুঝতে পারি একদা শৈবধর্মেও এই মধুর ভাব বর্তমান ছিল। সিন্ধু সভ্যতার পশুগণসমাবৃত পশুপতির মাতৃকাবন্দনারত মূর্তিটিও সেই ভাবনাই প্রকাশ করে। যদি পরবর্তী সময়ে শৈবযোগীগণ বিশেষত নাথপন্থীগণ প্রকৃতিবিচ্ছিন্নতার আদর্শে মত্ত না হতেন; তাহলে হয়তো হরগৌরীর যুগলপ্রেমের তত্ত্বও বৈষ্ণব দর্শনের মতো উচ্চতায় আরোহণ করতে পারত।
তাই রাস মূলতঃ প্রকৃতিপরায়ণতার উৎসব। যে পুরুষ প্রকৃতির প্রেমে মত্ত হয়েছেন; তিনিই রাসমণ্ডলে আনন্দনৃত্য করতে পারেন। সাঙ্খ্যের প্রকৃতি তন্ত্রের পথে এই প্রেমসাগরে পরিণত হয়েছেন। তাঁর চতুর্বিংশতি তত্ত্বই অষ্টসখী চৌষট্টি গোপিণীর রূপ লাভ করেছে। পুরুষ সেই রসসিন্ধুতে অবগাহন করে রসরাজ হয়েছেন। গোবিন্দদাসের ভাষায় তাঁদের এই সম্মিলিত রূপ এই প্রকার :
কাঞ্চন মণিগণ জনু নিরমাওল
রমণীমণ্ডল সাজ
মাঝহি মাঝ মহামরকত সম
শ্যাম নটবররাজ…
থির বিজুরি সনে চঞ্চল জলধর
রাস বরিখয়ে অনিবার
© রক্তিম মুখার্জি

