মহলি জনজাতি : একটি ছিন্নবৃন্তের গান ড. বিশ্বজিৎ রায়


পড়ন্ত বিকেলের রাক্ষসী রোদ্দুর ঠিকরে আসছে দিগন্তজোড়া চা বাগিচার পিছনের পাহাড়গুলির গা বেয়ে ।

সেই আলোয় ‘রাজাভাত ‘ চা বাগানের ‘ গাঙ্গোঁটিয়া বস্তির’ 4 নং কুলি লাইনের সংকীর্ণ শুড়িপথ ধরে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে আসছেন এক মাঝবয়সী যুবক । বুকের কাছে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা বিবর্ণ কিছু ছবি , পৃষ্ঠা । দেখছি ছুটতে ছুটতে পায়ের নীচে নুড়ি পাথরের আঘাতে উড়ছে ধূলো………..কিন্তু যুবক অবিশ্রান্ত । কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করে এক অমোঘ প্রশ্ন , যে প্রশ্নে আজন্ম সভ্য জগতে লালিত আমার সমাজ-ইতিহাস -দর্শন চেতনা টলে যায় নিমেষে । আমায় প্রশ্ন করে রাজাভাত চা বাগিচার শ্রমিক শিবদয়াল মহলি – ‘ বাবু , আমাদের জাতির কথা ইতিহাস বইতে লিখা নেই কেন ? আমরাও তো অনেক লড়াই দিছি ইংরাজ গুলোর সাথে……….., কথা শেষ করতে পারে না ।

আমিও আর চোখে চোখ রাখার সাহস দেখাতে পারি না । কি করে সাহস রাখি ? বিশ্বায়নের এই যুগে , যেখানে লোভ, প্রতিযোগিতা আর ভোগই জীবনের সবটা জুড়ে -সেখানে একজন চা শ্রমিকের অন্তহীন প্রচেষ্ঠা ইতিহাসের পাদপ্রদীপে তাদের ভুলে যাওয়া জনজাতিকে একটু প্রতিষ্ঠা দেবার !
শিবদয়ালের মা একটু আগেই আমায় এগিয়ে দিয়েছিলেন চুন দিয়ে পাকানো বাড়ির দুটি কলা আর তামার একঘটি জল । আমার সারা দিনের খাবার । কিন্তু খাবারের চেয়েও আকর্ষণীয় ছিলো তামার ওই বড়ো ঘটি খানা । মাত্র 13 বছরে বয়সে , 1949 সালে (নিজেই বিড়বিড় করে জানালেন , যে বছর গান্ধীবুড়া খুন হলো , তার পরে …..),শিবদয়ালের বাবা ভীমদয়ালের হাতটি ধরে ঝাড়খন্ড থেকে উত্তরবঙ্গের এই চা বাগানে চলে এসেছিলেন নতুন কনে তেত্রী মহলি। স্বামী মারা যাবার পর সংসারে হাল ধরেন ঐ লোটা সম্বল করেই । 4 মেয়ে আর 1 ছেলেকে মানুষ করেছেন , সংসার গড়ে দিয়েছেন , নাতি নাতনির মুখ দেখেছেন , আর এই যাত্রা পথে বারবার তাঁর লোটাখানি বন্ধক পড়েছে মহাজনের কাছে । বন্ধকে মেলা টাকায় কখনো কিনেছেন বাচ্ছাগুলোর মুখে যোগান দেবার জন্য একমুঠো চাল , কখনো দুটো ওষুধ । চা বাগানে কাজ করে আবার লোটা ছাড়িয়ে এনেছেন , পরের বারের জন্য । তার ঘরের দাওয়ায় বসেই কথা হচ্ছিল ধূরন মহলি সহ অন্যান্যদের সাথে ।

‘ জিতিয়া পরব ‘ এর অনু্ষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে । করম পূজার সাথেই মহিলাদের কাছে পবিত্র এই পরব । ধূরন জানালেন ‘ আমরা তো আদিবাসী , তাই পাহাড় , জঙ্গল , নদী আর গাছপালাই আমাদের ঠাকুর হয় । জিতিয়া পরব হয় আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা সপ্তমীতে । ‘ করম পূজার ‘ সাথে কিছু পার্থক্যও আছে । করম হয় ভাদ্র মাসের একাদশীতে , করম গাছের ডাল নিয়ে, যেখানে জিতিয়া গাছ অর্থাৎ অশ্বস্থ গাছই জিতিয়াপরবে মূল । করম পূজা করেন অবিবাহিতারা দাদা -ভাই -বাবার দীর্ঘায়ু কামনায় , আর জিতিয়ায় বিবাহিতাদের প্রার্থনা তাদের সন্তানদের মঙ্গলার্থে । গোল করে ঘিরে বসলেন বাড়ির সাথে আশেপাশের বাড়ির মহিলারাও । চলে এলো মহিলাদের প্রিয় মাদল । গেয়ে শোনালেন করম পূজার গান …………….


“লানু থাবা ফুলিয়া
পূজা করল্যাইন পার্বতী
লানু থাবা ফুলিয়া
লানুু লোটা পানিয়া
লানু পুয়া রোটিয়া
লানু ক্ষিরা বেটোয়া
লানু ধূপা ধূয়ন
পূজা করল্যাইন পার্বতী”


গাইলেন করম পুজা শেষ করার গানও , বললেন এই গান জিতিয়ারও:
“কার লাগিন সেত্তালি
শিবা শিবা রাইত
বেটা লাগিন সেত্তালি
শিবা শিবা রাইত
পূজা করল্যাইন পার্বতী
শিবা শিবা রাইত”,


করম ও জিতিয়া উভয় পরবেই মহিলারা উপোস করেন । যব, করহিন , ধান , মকাই , কুর্থী , ছোলা , মটরের বীজ একটি ডালায় রেখে প্রার্থনা করেন , ক্রমে অঙ্কুরোদগম হয় (স্মরণীয় বিলুপ্তপ্রায় ‘ ইতুপুজো ‘ )।চলে নাচ-গান-আনন্দ । আবার আষাঢ় মাসে হয় সরল পুজা । এ পুজায় মূল ভগবান শালগাছ । এ সময় দরিদ্রদের গণবিবাহের আসরও বসে এখানে । গতবছরেই 51 জোড়া হাত আর হ্ৃদয় বাঁধা পড়েছে শাল গাছকে সাক্ষী মেনে । মেয়ের দল কথায় কথায় গেয়ে উঠলো গায়ে হলুদের ভালোবাসার কুয়াশায় মোড়া গান :
“ভাদো কে মাহিনা কাঁদো
রিম ঝিম পানি বরসে
তেতের ফুল ঝেড় গেলা
দে আইয়ো মোকে ঝড়ু
মে থাবো ফুলকে বড়াক
মুর্গা যে ডাক দে
তো ফুলকে কইছ্যা মো আনবু
রিম ঝিম পানি বরসে…….”


শিবদয়াল জানালেন ছেলে মেয়ের সম্পর্ক হলে পাত্রপক্ষ মেয়ের বাড়ি যায় । কনে রাজী হলে শ্বশুরের পা ধুইয়ে দেয় , লোটা ভরে জল দেয় , সম্পন্ন হয় বাগদান । তবে স্বগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ এখানে, স্বগোত্রীয়কে ভাইবোন ভাবা হয় । জানালেন মহলিদের সমাজে তিরকি , টপুয়ার , ইন্দুয়ার, বাগুয়ার , বার্লা , ষাড় , কছুয়া , শৌর প্রভৃতি গোত্র আছে । এদের মধ্যে টপুয়ার, ইন্দুয়ার, বাগুয়ার আর কছুয়ারাই সমাজ পরিচালনায় মুখ্য । আর্যদের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত এই অনার্য জাতির পুরোহিত দের বলে পাহান্ড। তবে আকর্ষণীয় বিষয় এই পাহান্ড কর্মভিত্তিক , বংশানুক্রমিক নয়। জন্মের ছয় দিনের দিন নাড়ী ছেড়ার অনুষ্ঠান ছট্টি , আর মরণের 10 দিন পর দশকরমা বা মুণ্ডন । দাহকার্য শেষে সবাই একত্রে বসেই কার্যক্রমের ও অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয় ।


আদিতে বাঁশ থেকে ঝুড়ি , ধামা তৈরি ছিলো মহলিদের বৃত্তি । এখনো মহলিদের গোষ্ঠী প্রতীক বা ‘ টোটেম ‘ হলো বাঁশঝাড় । কিন্তু নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে মহলিরা এখন ছিন্নমূল শ্রমিক মাত্র । তবে শিবদয়ালারা বদ্ধপরিকর । নিজেদের শিকড়কে তারা মুছে যেতে দেবেন না পৃথিবীর ইতিহাস থেকে । নিজে 10 ক্লাস পড়েছেন । মহলি সংগঠনের জন্য উদয়াস্ত খাটেন। মহলি জনজাতিদের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে তিনি আমন্ত্রিত সদস্য । মহলি স্বাধীনতা সংগ্রামী শঙ্কর মহালির শহীদবেদী গড়েছেন । সম্প্রদায়ের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করছেন । অন্য রাজ্য থেকে বই এনে সাদান ভাষায় কথা বলা , সাদরি বর্ণে লিখে রাখার চেষ্টা করেছেন মহলি লোককথা , গল্প , ছড়া আর প্রবাদ প্রবচন । যাবার বেলা শোনালেন নিজের লেখা গানের কলি …….বুকের যন্ত্রণা হাহাকার হয়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরলো চাবস্তির আনাচে কানাচে………


“চায় বাগানে রহে বালা মহলি জাতি
কব তক তোড়প চা এ পাতি
চা এ পাতি
ঝাড়খণ্ড সে আইকে হিয়া বসলি
এখন বুঝেক সকতহি , কাঁহা ফাঁসলী
কয় স্যান পড়াহবই হামার আয়ো বাবা
চায় বাগানকো ছোড়কে , তোঁহরে কাঁহা যাবা
চায় বাগানে রহে বালা মহলি জাতি
কব তক তোড়প চা এ পাতি । “

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s