মার্ক্সপূর্বের মার্ক্সীয় ভাবনার স্মৃতিচারণা- ঋতুপর্ণা কোলে

মার্কসবাদের কথা এলেই সাম্যের কথা উঠে আসে বারবার। আসলে সমাজে সাম্যবাদী চেতনা তাঁর হাত ধরে নতুনভাবে জেগে উঠে ছিল । সেই সাম্যর ভাবনা কেবল বুর্জোয়া-পলিতারিয়েতের মধ্যে আটকে নেই, যতরকমের বৈষম্য আছে সবকিছুকেই নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। সবচেয়ে অন্যতম হলো লিঙ্গবৈষম্য। সে বৈষম্য আজও মেটেনি এবং কখনো বা মেটাতে গিয়ে হয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার। সঠিক দিশা দেখার মত দিন এখনো আসেনি।

আজ কার্ল মার্ক্সের জন্মদিন। প্রাচীন ও মধ্য বাংলার কিছু ঘটনাকে তুলে ধরে সে বাংলার সাম্যবাদী (মূলত লিঙ্গের সাম্য) ভাবনার কয়েকটি দিক তুলে ধরব। তা দিয়ে করা যাক মার্ক্সপূর্বের মার্ক্সীয় ভাবনার স্মৃতিচারণ।

আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ছিলো গঙ্গারিডাই সভ্যতা। আজ আমরা চন্দ্রকেতুগড় বলে চিনি। সেই সভ্যতার মানুষজন কেমন ছিলো আমরা জানি না। কিন্তু হাতে আছে অজস্র মূর্তি। বলা ভালো নারী মূর্তি। মূর্তিগুলিকে দেখলেই বোঝা যায় নারী মানে “কয়েক প্রহরের বিলাস সঙ্গিনী”-মাত্র নন। মাথায় দশ রকমের অস্ত্র রণসাজকেই প্রকাশ করে। কেবল মাথায় নয় হাতেও অস্ত্র নিয়ে থাকা নারী মূর্তি পাওয়া গেছে। তাছাড়া একটি মূর্তি আছে যেখানে এক পুরুষকে বহন করছে এক নারী। মুখাবয়ব শিশুকে বহন করার কথা বলছে না। এই একুশ শতকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে যখন সুপ্রিমকোর্টের শরণাপন্ন হতে হয় মেয়েদের তখন আড়াই হাজার বছর আগে এভূমিতেই তৈরি হয়েছে রণসাজের নারী মূর্তি।

বাংলার ইতিহাসে প্রথম যে রাজবংশ পাওয়া যায় তা হলো গঙ্গারিডাই/ নন্দ বংশ। সেই বংশের রাজার নাম মহাপদ্মনন্দ। নানা গ্রন্থ থেকে জানা যায় তিনি নাপিতপুত্র ছিলেন। পুরাণে তাঁকে “শূদ্রোগর্ভোদ্ভব” বলা হয়েছে। সুতরাং সে যুগে রাজকীয় গুণই রাজা হবার ব্যাপারে মুখ্য ছিলো। জাত-পাতের বৈষম্য তখনও তৈরি হয়নি।

নন্দ বংশের সূচনা খ্রীস্টপূর্ব ৩৪৫ অব্দ নাগাদ। এরপর ক্ষমতা হাতে যায় মৌর্যবংশের কাছে। বংশের নামের মধ্যেই আছে সে যুগের জাতিচেতনা। কেবল পিতৃবংশ নয় মাতৃবংশও পরিচয়ের কেন্দ্রে থাকার উপযুক্ত ছিলো। এছাড়া ‘মুরা’ নামটি দুহাজারের অধিক সময় হয়েগেলো এখনো হারিয়ে যায়নি। তার সন্তান চন্দ্রগুপ্ত মুরার সন্তান হিসাবেই পরিচিত।

মৌর্যবংশের পর যে বংশের কথা উল্লেখ করতে হয় তা হল গুপ্ত বংশ। রাজত্ব শুরু হয় ৩১৯ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ। সমুদ্রগুপ্তের একটি মুদ্রা পাওয়া যায় যেখানে গুপ্তবংশের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্ত এবং কুমারদেবীর প্রতিকৃতি রয়েছে। ফলত গুপ্তযুগেও একক নয় বরং প্রথম চন্দ্রগুপ্তের দাম্পত্যসঙ্গীও সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।

পাল, সেন যুগের কথায় নিহাররঞ্জন রায় “বাঙ্গালীর ইতিহাস” (আদিপর্ব) গ্রন্থে বলেছেন যে বাঙলার পাল ও সেন আমলের লিপিগুলি পড়লে বোঝা যায় লক্ষ্মীর মতো কল্যাণী, বসুধার মতো সর্বংসহা নারীকেই চাইতেন রাজারা। ভাবতে অবাক লাগলেও সত্যি সে যুগে স্ত্রী-র মধ্যে এক বন্ধুর কামনা করতেন তাঁরা। সমকালে তা যে প্রকৃতরূপেই সত্য তার প্রমাণ পাই ডাক-ডাকিনির কথায় তথা নাঢ়া-নাঢ়ির কথায় কিংবা বলা ভালো নাঢ়োপা আর নিগুমার কথায়। সে যুগের তাঁরা কেবল স্বামী-স্ত্রী নন অধ্যাপক-অধ্যাপিকাও।

সাম্যের বক্তব্য শুরু করেছিলাম স্থাপত্যের উদাহরণ দিয়ে শেষ করবো সাহিত্যের উদাহরণ থেকে। প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী নারীর কথা চর্যাপদে বারবার উঠে এসেছে। আজ বলবো রাধার কথা। আসলে বলবো না, স্মরণ করাবো “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে”র রাধাকে। যাকে পথে ঘাটে বারবার বিরক্ত করে কৃষ্ণ। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় আর সে মথুরা যাবে না দই, দুধ বেচতে। কিছুদিন পর পাড়ার মহিলারা রাধার শ্বশুরবাড়িতে আসে ঝগড়া করতে। রাধার শাশুড়িকে বলে, বাড়ির বৌ বাইরে কাজ না করে ঘরে বসে থাকবে তা তারা কিছুতেই হতে দিতে পারেনা। আশ্চর্য না? আজও একটা মেয়ে বিশেষ করে সে যদি বাড়ির বৌ হয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য বাইরে যায় তবে ঘরে বাইরে কতরকমের আক্রমণের শিকার হতে হয় অথচ তখনের সমাজের কাছে ছিলো সেটাই স্বাভাবিক।

সমাজ বদলে যায় এরপর কোনো এক সময়। এই বদলে যাওয়া সময়টায় কিংবা তার আগে মার্ক্স ছিলেন না কিন্তু দর্শনটা ছিলো, সাম্যের ভাবনাটা ছিলো। আজ রইলো লিঙ্গ বৈষম্যের প্রেক্ষিতে বাকিকথা তোলা রইলো কোনো একদিন বলা যাবে।

চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত মূর্তি

সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রা
সেনযুগের স্থাপত্য

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s