চৈতন্য-পরবর্তী যুগে প্রতাপাদিত্যের উৎকলবিজয় – তমাল দাশগুপ্ত

শেষ যে বাঙালি সম্রাট উড়িষ্যা বিজয় করেছিলেন, অতি ক্ষণিকের জন্য হলেও, তিনি যশোরসম্রাট প্রতাপাদিত্য। পুরীতে চৈতন্য হত্যার আনুমানিক অর্ধশতাব্দী পর প্রতাপাদিত্য পুরী যান উড়িষ্যা বিজয়ের উদ্দেশ্যে, তার সুনির্দিষ্ট উল্লেখ পাচ্ছি। তিনি জগন্নাথপুরী গেছিলেন সসৈন্যে, সেখান থেকে (বিজয়স্মারক হিসেবে?) উৎকলেশ্বর নামে মহাদেবমূর্তি এবং একটি পরমসুন্দর কৃষ্ণমূর্তি (গোবিন্দদেব নামক মূর্তি) আনয়ন করেছিলেন খুল্লতাত বসন্ত রায়কে প্রদান করার জন্য।

সেযুগে উড়িষ্যা অরাজক, পাঠান আর মোগলে দ্বন্দ্ব চলছে। প্রতাপ এই দুই মূর্তি নিয়ে যাচ্ছেন দেখে উড়িষ্যার কিছু স্থানীয় রাজা সৈন্য জোগাড় করে যুদ্ধ করেন, প্রতাপকে বাধা দেন, কিন্তু প্রতাপ তাঁর দুই সেনাপতি শঙ্কর চক্রবর্তী এবং সূর্যকান্ত গুহর সাহায্যে তাদের পরাজিত করেছিলেন। পরাজিত উড়িয়াদের সঙ্গে এরপর সুমিষ্ট ব্যবহার করে প্রতাপ মিত্রতা স্থাপন করেন। অনুমান করা হয়, যাদের সঙ্গে প্রতাপের যুদ্ধ ও পরে মিত্রতা হয়েছিল, তারা উড়িষ্যার খণ্ডায়েত জাতি। বাংলায় এই কাস্ট মাহিষ্য নামে পরিচিত।

এবং প্রতাপের সাম্রাজ্য এই সময় সবথেকে বিস্তৃত আকার ধারণ করেছিল (পশ্চিমে উড়িষ্যা থেকে পূর্বে যশোর)।

প্রতাপ সত্যিই সম্রাট ছিলেন।

এ তথ্যটি অভিনব, সত্যচরণ শাস্ত্রীতে পাচ্ছি, এবং যদুনাথে এর সমর্থনের ইঙ্গিত পাচ্ছি যদিও গোবিন্দদেব বিগ্রহ পুরী নয়, কটক থেকে আনা হয়েছিল, যদুনাথ বলেন। এবং বাঙালি যে মাত্র চারশো বছর আগেও উড়িষ্যা বিজয় করেছিল (শশাঙ্ক থেকে পালযুগ থেকে সেনযুগ পর্যন্ত তো বারবার উড়িষ্যা বিজয় করেছিল। চৈতন্য আন্দোলনও এক অর্থে নিশ্চয়ই উড়িষ্যা বিজয়; উড়িষ্যা বাংলাভাষী হিন্দুর জিওপলিটিক্স-এর অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান), সেটি অনুপ্রেরণা দেয়।

এবং এ ঘটনা চৈতন্যদেবের জীবনাবসানের আনুমানিক পঞ্চাশ বছর পর। চৈতন্য-পরবর্তী বাঙালির ইতিহাস এ জাতির বাহুবলের প্রগাঢ় ইঙ্গিত দেয়।

উৎকলেশ্বর শিবকে সুন্দরবন অঞ্চলে একটি গগনচুম্বী মন্দিরে স্থাপিত করা হয়েছিল। কিন্তু গোবিন্দদেবের জন্য একাধিক রাধারাণী তৈরি হয় (উড়িষ্যায় মূর্তিটি রাধাবিরহিত ছিল হতে পারে, উড়িষ্যায় রাধা ধারণা কিঞ্চিৎ বিলম্বে প্রবেশ করেছে, এবং চৈতন্য আন্দোলনের প্রভাবেই প্রবেশ করেছে। চৈতন্য আন্দোলনের সমসাময়িক উড়িয়া পঞ্চসখা বৈষ্ণবরা রাধাকে স্বীকার করতেন না। আরেকটি কিংবদন্তী অনুযায়ী সুবর্ণরেখা পার হওয়ার সময় রাধারাণীর মূর্তিটি জলে হারিয়ে গেছিল),এবং সেই প্রত্যেক রাধারাণীর জন্য আবার একাধিক গোবিন্দদেব তৈরি হয়েছিল। ফলত মূল গোবিন্দদেব কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না, মূল যশোরে হবে না কারণ বসন্ত রায়ের দ্বারা তাঁর রাজ্যমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতাপ-পিতৃব্য বসন্ত রায় যশোর রাজ্যের ছ’আনা অংশের রাজা ছিলেন, তিনি দক্ষিণে এবং পশ্চিমের দিকটা রাজত্ব করতেন (সুন্দরবন এবং চব্বিশ পরগণা)। এরপর অবশ্য পুরোটাই প্রতাপের অধিকারে আসে।

একটি গোবিন্দদেব-রাধারাণী জুটি বারাসাতে স্থাপিত হয়েছিল, প্রতাপের সেনাপতি শঙ্কর কর্তৃক। এই গোবিন্দদেব পরে (মুঘল আক্রমণের সময়?) লাবণ্যবতী নদী (নোয়াই খাল নামে বর্তমানে পরিচিত)-খাতে বিসর্জিত হন, সেই থেকে তাঁর একাকী রাধারাণী নাকি বিধবা ব্রাহ্মণী নামে পরিচিত।

চৈতন্যের জীবনাবসানের অর্ধশতাব্দী পর যশোর সম্রাট প্রতাপের নেতৃত্বে বাঙালির পুরী বিজয় বিভিন্ন গূঢ় কারণে মধ্যযুগের ইতিহাসে একটি চমকপ্রদ ঘটনা। এই পেজ যারা ফলো করেন, মনে হল আপনাদের জানা দরকার।

© তমাল দাশগুপ্ত

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ২৭শে এপ্রিল ২০২০

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s