ধূমাবতী দশমহাবিদ্যার সপ্তম বিদ্যা। ধ্যান অনুযায়ী তিনি দীর্ঘকায়া। লম্বিতকুচদ্বয়শোভিতা। ভীষণ দন্তরাশিযুক্ত মুখমণ্ডল ভয়াবহ। ধুম্রবর্ণা কুটিলনয়না সর্বদা ক্ষুধাতুরা শীর্ণকায়া দেবী ধুম্রাচ্ছন্ন মলিনবসন পরিহিতা অবস্থায় শূর্পহস্তে কাকধ্বজ রথে আসীনা। ঋষি পিপ্পলাদ তাঁর অর্চনা করেছিলেন।
এই ধ্যান যথেষ্ট অর্থবহ। দেবীর এই আপাত অমঙ্গলসূচক রূপ প্রমাণ করে তন্ত্রের নির্মোহ সত্য। প্রকৃতি পুরুষের দ্বৈতাত্মক এই জগতে কোন কিছুই বর্জ্য বা অপবিত্র নয়। মহামায়ার অস্তিত্ব কেবল তথাকথিত শুভ বা মাঙ্গলিক প্রতীকসমূহেই সীমাবদ্ধ নয়। রাজরাজেশ্বরী সালঙ্কারা ষোড়শী ও ভুবনেশ্বরী দেবীরূপের পাশেই তাই মলিনবসনা বিধবা ক্ষুধাশীর্ণা ভীষণকায়া ধূমাবতীও সমান ভাবেই বন্দিতা।
এই ধূমাবতীর ধ্যানে আছে তাঁর এক উপাসক ঋষি পিপ্পলাদের কথা। পুরাণ অনুযায়ী ইনি সেই পরমশৈব ঋষি দধীচির পুত্র যিনি অম্লানবদনে দেবগণের কল্যাণার্থে আত্মবিসর্জন করেছিলেন। তাঁরই অস্থিতে দেবেন্দ্রের বজ্র নির্মিত হয়েছিল।
ধূমাবতীর প্রতীকী ধ্যানরূপটির মধ্যেও নিহিত আছে এক পরম কল্যাণময়ী সত্ত্বা। জগতকে শ্রীমণ্ডিত করার জন্য সমস্ত হতশ্রী সমস্ত কলুষ নিজ অঙ্গে ধারণ করার মহত্ত্বই এই দেবীরূপের বিশেষত্ব। জগতকে আলো বিতরণ করে বিনিময়ে সমস্ত কালিমা সমস্ত ধূমঃজ্বালা সর্বাঙ্গে ধারণের ঔদার্যই ধূমাবতীর রূপকল্পে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাই দধীচিপুত্র পিপ্পলাদের ধূমাবতী বন্দনা একান্তভাবেই স্বাভাবিক।
এই পিপ্পলাদ অথর্ববেদের একটি শাখার মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। তিনি প্রশ্নোপনিষদের প্রণেতা। শিষ্য কবন্ধ কাত্যায়ন কৌশলেয় অশ্বলায়ন প্রমুখের প্রশ্নের উত্তরে জগতের স্বরূপ ব্যাখ্যার্থে তিনি যে দার্শনিকতার অবতারণা করেছেন তাতে তন্ত্রের সুস্পষ্ট উপস্থিতি লক্ষণীয়।
ধূমাবতীর আর একটি বিশেষত্ব হল তাঁর সার্বভৌমতা। দশমহাবিদ্যার মধ্যে একমাত্র তিনিই ভৈরবরহিতা। স্বয়ংসম্পূর্ণা। তন্ত্র অনুযায়ী দেবী মহামায়া ক্ষুধাকাতর হয়ে মহাদেবকে গ্রাস করলে তাঁর সর্বাঙ্গ ধূমাচ্ছন্ন হয় এবং পুরুষরহিতা তাঁর এই রূপ ধূমাবতী নামে পরিচিত হয়। তাই দশমহাবিদ্যার মধ্যে একমাত্র তাঁর রূপকল্পেই আদি মাতৃপরায়ণ তন্ত্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায়। আদিবিদ্বান কপিলের সাঙ্খ্য যে তন্ত্রভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিল সেখানে নিরীশ্বর দুঃখময় জগতের সঞ্চালনশক্তি আদি প্রকৃতিই একমাত্র আরাধ্যা। পুরুষ তাঁরই অঙ্গীভূত একটি তত্ত্বমাত্র। ভৈরবকে গ্রাস বা সম্পূর্ণ আত্তীকরণের মাধ্যমে নিঃসঙ্গা ধূমাবতীর এই রূপে সেই আদি তন্ত্রই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে।
ধূমাবতীর স্তব বন্দনা প্রভৃতির মুখ্য রচয়িতা হলেন ঋষি পিপ্পলাদ ও ঋষি ক্ষপনক। তাঁর স্তব হৃদয় কবচ প্রভৃতির বিশেষত্ব হল ধ্বন্যাত্মক শব্দরাজির বাহুল্য। তন্ত্রে ন্যাস প্রসঙ্গে একাক্ষরী বীজরূপ বর্ণের বহু প্রয়োগ থাকলেও এই শব্দরাজি কিছুটা আলাদা। যথাঃ
ঠং ঠং ঠং ঠং মনুপ্রীতিং ঠঃ ঠঃ মন্ত্রস্বরূপিণীম্ ।
ঠমকাহ্বগতিপ্রীতাং ভজে ধূমাবতীমহম্ ॥
থাং থীং থূং থেং মন্ত্ররূপাং থৈং থৌং থং থঃ স্বরূপিণীম্ ।
থকারবর্ণসর্বস্বাং ভজে ধূমাবতীমহম্।।
নর্ত্তকীনটনপ্রীতাং নাট্যকর্মবিবর্দ্ধিনীম্।
ফূত্কারসহিতশ্বাসাং ফট্ মন্ত্রফলদায়িনীম্ ।
ফেত্কারিগণসংসেব্যাং সেবে ধূমাবতীমহম্।।
চর্বন্তীমস্থিখণ্ডং প্রকট কটকটা শব্দসঙ্ঘাতমুগ্রং কুর্বাণি প্রেতমধ্যে কহহকহকহা হাস্যমুগ্রং কৃশাংঙ্গী । নিত্যং ন্নিত্যপ্রসক্তাং ডমরুডিমডিমাং স্ফারয়ন্তীং মুখাব্জং পায়ান্নশ্চণ্ডিকেয়ং ঝঝমঝমঝমা জল্পমানা ভ্রমন্তী ॥ ৩॥ টণ্টণ্টণ্টণ্টটণ্টা ণ্রকট টমটমা নাটঘণ্টাং বহন্তী স্ফেং স্ফেং স্ফেং স্ফারকারা টকটকিতহসা নাদসঙ্ঘট্ট ভীমা । লোলম্মুণ্ডাগ্রমালা ললহলহলহা লোললোলাগ্রবাচং চর্বন্তীচণ্ডমুণ্ডং মটমটমটিতে চর্যষন্তী পুনাতু ॥
স্তব অনুযায়ী দেবী ধূমাবতী নাট্যনর্ত্তনাদি ললিতকলার এক অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিনি ফেৎকারীগণসেবিতা। প্রসঙ্গত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের তন্ত্রসারে উল্লিখিত ফেৎকারীতন্ত্র অধুনালুপ্ত বঙ্গীয় তন্ত্রসাধনার অন্যতম ধারা।
তন্ত্রমতে দেবী ধূমাবতীর শূর্প জগতের সকল নাদবীজগুলিকে ধারণ করে।
দেবীর সাথে ধ্বনি নাদ বীজাত্মক বর্ণাদির এই ঘনিষ্ঠতা দেখে অনুমিত হয় সুপ্রাচীন গৌড়ীয় তন্ত্রধারা যখন কোন সুমার্জিত শালীন গ্রন্থবদ্ধ রূপ গ্রহণ করেনি; বাঙালির দৌর্দণ্ডপ্রতাপ পূর্বসূরি ব্রাত্য আর্যগণ যখন কেবল মাতৃবন্দনার ঐতিহ্য বহন করে যুগপৎ বৈদিক আর্যগণ ও এই ভূমির রাক্ষস অভিধায় ভূষিত আদি নিবাসীদের সাথে সংগ্রামে রত ছিলেন সেই ধূসর অতীতেরই সংসর্গ আছে দেবী ধূমাবতীর মধ্যে। তিনি চণ্ডমুণ্ডের অস্থি মটমট করে চর্বণ করেন এই সুস্পষ্ট উল্লেখ তন্ত্রের আদিম অকৃত্রিম রূপেরই দ্যোতক। আবার সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় ধূমাবতীর মধ্যে স্থান পেয়েছেন নারীতান্ত্রিক প্রাচীন গৌড়বঙ্গের সেই বৃদ্ধা সমাজমুখ্যা যিনি একাধারে বিজাতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বদা ক্রূরকুটিলা ভীষণা আবার স্বভূমির ললিতকলার প্রধান রক্ষয়িত্রী। রূপকথার গল্পে রাক্ষসী বুড়ি তিন বুড়ির দেশ প্রমুখ ইঙ্গিতবাহী শব্দে যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজচিত্র ধরা পড়ে তারই মূর্ত বিগ্রহ দেবী ধূমাবতী।
পরবর্তীকালে বৈদিকীকরণের প্রভাবে বাঙালির মন যখন থেকে ভীষণ সুন্দরের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে উঠেছে তখন থেকেই ধূমাবতীও বাঙালির কাছে দূরের এক বৃদ্ধ অতীতের ভয়াবহ ছায়ায় পরিণত হয়েছেন। মাৎস্যন্যায়ের ক্ষয়িষ্ণু সমাজে দশমহাবিদ্যার উপাসনা ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠেছিল মারণ উচাটন বশীকরণের মতো নিম্নবৃত্তির চরিতার্থতার সাথে সংশ্লিষ্ট। পরবর্তী সময়ে সুযোগ্য তন্ত্রসাধকগণের মাধ্যমে কালী তারা ষোড়শী প্রমুখ মহাবিদ্যার সাধনক্রম পঙ্কিলতার থেকে মুক্ত হয়েছে। কিন্তু ধূমাবতী বগলামুখী মাতঙ্গী প্রমুখ মহাবিদ্যার সাধনক্রম সেই মাৎস্যন্যায়ের অবনমিত পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে। তাই আজও বঙ্গবাসী দেবী ধূমাবতীর প্রতি ভয় ও সম্ভ্রমের দূরত্ব বজায় রেখে চলে। বৈদিক পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাবে বাঙালির মননে সার্বভৌমা একাকিনী পতিভক্ষণকারিণী আদি তন্ত্রের ভাবস্বরূপিণী সঙ্কটনাশিনী দেবী ধূমাবতী চলে গিয়েছেন রহস্য ও অনাগ্রহের অন্তরালে।