চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনাবসান ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে পুরীতে। এই ঘটনা কিভাবে তাঁর জীবনীগুলিতে বিবৃত হয়েছে, সে নিয়েই এই পোস্ট। চৈতন্য অন্তর্ধান নিয়ে নানা মুনির নানা মত। শুধুমাত্র একটা স্টেটাসে পুরোটা জানতে চান? পড়ুন।
১। স্বরূপ দামোদর চৈতন্যদেবের নীলাচল লীলার অন্তরঙ্গ সাক্ষী, বাঙালি পরিকরদের মধ্যে অগ্রগণ্য। স্বরূপ দামোদরের কড়চা আর পাওয়া যায় না। অথচ এই গ্রন্থটি কৃষ্ণদাস কবিরাজ দেখেছেন, কবি কর্ণপুরও দেখেছেন। কৃষ্ণদাস বিশেষভাবে বলছেন, যে চৈতন্যলীলার শেষটা স্বরূপ দামোদর লিখে গেছেন (প্রভুর যে শেষ লীলা স্বরূপ দামোদর/ সূত্র করি গাঁথিলেন গ্রন্থের ভিতর), ভক্তবৈষ্ণব পাঠককে বলছেন, প্রভুর লীলাবসানের কথা জানতে স্বরূপ দামোদরের লেখা পড়তে। স্বরূপ দামোদরের কড়চা হল হোলি গ্রেইলের মত, চৈতন্য গবেষকদের কাছে। যাই হোক, এ গ্রন্থটি আজও মেলেনি।
২। প্রসঙ্গত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ নিজে চৈতন্যের জীবনাবসান নিয়ে নীরব। চৈতন্যচরিতামৃতে কেবল লিখে গেছেন, চৈতন্যদেবের অন্তর্ধান হয়েছিল (শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নবদ্বীপে অবতারি/অষ্টচল্লিশ বৎসর প্রকট বিহারি/চৌদ্দশত সাত শকে জন্মের প্রমাণ/চৌদ্দশত পঞ্চান্নে হইল অন্তর্ধান)। কবি কর্ণপুরও নীরব, চৈতন্যচন্দ্রোদয়ে শুধু বলছেন সাতচল্লিশ বছর বয়েসে মহাপ্রভুর মৃত্যু হয়। কোথায়, কিভাবে? নীরব।
৩। মুরারি গুপ্তর কড়চা কেবলমাত্র জগাম্ নিলয়ং বলেছে, এ ব্যতীত চৈতন্য অন্তর্ধানের ব্যাপারে আর কিচ্ছু বলা নেই।
৪। চৈতন্যের উড়িয়া ভক্ত রায় রামানন্দ এবং কাহ্নাই খুন্টিয়া মহাপ্রভুর শেষদিন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ছিলেন। অন্য অনেক বিষয়ে এঁরা লিখে রাখলেও এই ব্যাপারে নীরব, কিচ্ছু লেখেন নি।
৫। বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত একটি অসম্পূর্ণ গ্রন্থ। এমন না যে গ্রন্থ অসমাপ্ত রেখেই অকালে প্রয়াত, গ্রন্থ রচনার পরেও বহুদিন ধরাধামে ছিলেন, অথচ অসমাপ্ত গ্রন্থটিতে চৈতন্যদেবের শেষলীলা নেই। তবে জানা যাচ্ছে এই অসমাপ্ত গ্রন্থের অপ্রকাশিত শেষাংশ নিয়ে একটা এডিশন প্রকাশ করেন বর্ধমান জেলার দেনুড় শ্রীপাটের অধিকারী অম্বিকাচরণ ব্রহ্মচারী, এবং সেই চৈতন্যভাগবতে বলা হচ্ছে বৈশাখী পূর্ণিমা ত্রয়োদশীতে জগন্নাথ মন্দিরে চৈতন্যদেবের “অন্তর্ধান” ঘটে। শুধু চৈতন্যদেব না, স্বরূপ দামোদরেরও “অন্তর্ধান” ঘটে, বলা হচ্ছে। এখানে বলা দরকার, চৈতন্য অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে প্রচুর গবেষণা হলেও, স্বরূপ দামোদরের অন্তর্ধান নিয়ে গবেষণা হয়নি সেভাবে।
৬। লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল বলছে আষাঢ়ের সপ্তমী তিথি, রবিবার বেলা তিনটের সময় চৈতন্যদেব গুণ্ডিচা মন্দিরে যান জগন্নাথদেবের দর্শনে (সেবছর রথযাত্রা হয়েছিল তৃতীয়ায়, ফলে এইসময় জগন্নাথ বিগ্রহ গুণ্ডিচা মন্দিরেই ছিল)। মন্দিরের কপাট বন্ধ হয়, এরপরে বাইরে থাকা ভক্তরা প্রভুর অদর্শনে ব্যাকুল হয়ে পড়িছা অর্থাৎ পাণ্ডাকে জিজ্ঞেস করেঃ
বিপ্রে দেখি ভক্ত কবে শুনহ পড়িছা।
ঘুচাহ কপাট প্রভু দেখি বড় ইচ্ছা।।
ভক্ত আর্ত্তি দেখি পড়িছা কহয় তখন।
গুঞ্জা বাড়ীর মধ্যে প্রভুর হৈল অদর্শন।।
সাক্ষাৎ দেখিল গৌর প্রভুর মিলন।
নিশ্চয় করিয়া কহি শুন সর্ব্বজন।।
৭। ঈশান নাগর তাঁর অদ্বৈতপ্রকাশে জানাচ্ছেন, জগন্নাথ মন্দিরে মহাপ্রভু ঢুকেছিলেন, এবং প্রবেশমাত্র কপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কপাট কিছুক্ষণ পরে আপনা আপনি খুলে যায়। এতে সবাই বুঝলেন, চৈতন্য “অপ্রকট” হয়েছেন। ঈশানের গ্রন্থে সময় একই দেওয়া আছে। কিন্তু সেসময় জগন্নাথ মন্দির শূন্য, কাজেই সেখানে যে কিভাবে চৈতন্যদেব “জগন্নাথ নিরখিয়া/ শ্রীমন্দিরে প্রবেশিলা হা নাথ বলিয়া”, সেটা একটা বড় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
৮। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল। মাধব পট্টনায়কের অনুগামী, যদিও মৃত্যুর সময়কাল ও তিথির বিষয়ে নয়। মাধব পট্টনায়কই প্রথম বলেন যে চৈতন্য নামসংকীর্তনকালে নৃত্যরত অবস্থায় পায়ে ইঁটের খোঁচা লেগে মারা গেছিলেন। কিন্তু মাধব বলেন অক্ষয় তৃতীয়ার আগের অমাবস্যার (রুক্মিণী অমাবস্যা) সন্ধ্যায় সংকীর্তনে সময় চৈতন্যের পায়ে ইঁটের খোঁচা লাগে এবং সেই আঘাত বিষিয়ে গিয়েই অবশেষে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন তাঁর মৃত্যু।
জয়ানন্দ মৃত্যুর কারণ এক রাখলেও সময়টা পাল্টে দিয়েছেন, বৈশাখকে আষাঢ় করেছেন, অক্ষয় তৃতীয়াকে রথযাত্রা করেছেন। জয়ানন্দ যে দিনটার কথা বলছেন, সেটা আবার লোচনদাসের সঙ্গে মেলে, আষাঢ়ের সপ্তমী তিথি। সময় অবশ্য হুবহু মেলে না, জয়ানন্দ রাত দশটায় মহাপ্রভু দেহত্যাগের কথা লিখছেন। বর্ণনাও মেলে না, লোচন কোনও আঘাতের কথা লেখেন নি, প্রভু দিব্যি সুস্থ অবস্থায় গুণ্ডিচা মন্দিরে ঢুকছেন। আর যেটা মিলছে না, সেটা হল দেহত্যাগের স্থান। “টোটাএ শয়ন অবশেষে” জয়ানন্দের বক্তব্য। এই টোটা কথাটার অর্থ বাগানবাড়ি বা বাগান ঘেরা মন্দির। টোটা গোপীনাথ হতে পারে, আইটোটা (জগন্নাথবল্লভ উদ্যান) হতে পারে, এমনকি গুণ্ডিচাবাড়িও হতে পারে।
৯। উড়িয়া লেখক মাধব পট্টনায়ক অনেকগুলো কারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মহাপ্রভুর পূর্বপুরুষকে উনিই প্রথম উড়িয়া (যাজপুরের বাসিন্দা) বলে দাবি করেছিলেন (সমসাময়িক কোনও সোর্সে এমন কথা বলা নেই)। চৈতন্যর পূর্বপুরুষ পাশ্চাত্য বৈদিক ছিলেন, দাক্ষিণাত্য বৈদিক ছিলেন না। আজকে উড়েরা যে সমস্ত নামকরা জিনিস এবং লোকজনকে নিজেদের বলে দাবি করেন, এই প্রবণতার উৎসে মাধব। মাধব পট্টনায়ক চৈতন্যের সমসাময়িক ছিলেন, এবং উনি চৈতন্যের মৃত্যুর যে কারণ দেখান, পরে জয়ানন্দ সেটাই অনুসরণ করেছেন। কিন্তু মাধব চৈতন্যের মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী, উনি বলছেন, মহাপ্রভুর মৃতদেহ দেখে গৌড়ীয়রা কদর্থ করবে এই আশঙ্কায় মৃতদেহটিকে চুপচাপ জগন্নাথ মন্দিরে কোইলি বৈকুণ্ঠ (নবকলেবরের সময় যেখানে পুরোনো দারুমূর্তির সমাধি দেওয়া হয়)-এ পুঁতে দেওয়া হয়। এরপরে সিংহদ্বার খোলা হয়, ভক্তদের বলা হয় মহাপ্রভু জগন্নাথবিগ্রহে বিলীন হয়েছেন।
মাধব যে সময়টা দিচ্ছেন, সেটা অবশ্য জয়ানন্দ অনুসরণ করেন নি। মাধবের মতে অক্ষয়তৃতীয়ার আগের অমাবস্যায়, অর্থাৎ রুক্মিণী অমাবস্যার দিন সন্ধ্যার কিছু আগে সঙ্কীর্তন চলাকালীন চৈতন্য ইঁটের খোঁচায় আহত হয়েছিলেন। এরপর অক্ষয়তৃতীয়ার দিন জীবনাবসান ঘটে, জগন্নাথ মন্দির প্রাঙ্গনেই (অক্ষয়তৃতীয়ার আগের রাত্রে স্বচক্ষে চৈতন্যকে জগন্নাথে লীন হতে দেখেছেন, এরকম দাবি উড়িষ্যার পঞ্চসখা সম্প্রদায়ের অচ্যুতানন্দ তাঁর শূন্যসংহিতায় দাবি করেন)। এবং মাধব ও মাধব অনুসারী জয়ানন্দ ছাড়া আর কেউই চৈতন্যের পায়ে চোট লাগার কথা বলেন নি, না বাঙালি লেখক, না উড়িয়া লেখক।
১০। চৈতন্য হত্যা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যিনি খুন হয়েছিলেন, সেই জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের কাছে একটি উড়িয়া পুঁথি, বৈষ্ণবদাস রচিত চৈতন্য গৌরাঙ্গ চকড়ার খণ্ডাংশ এসে পৌঁছেছিল। শোনা যায় তাতে বেশ কিছু বিস্ফোরক তথ্য ছিল। দুঃখের কথা জয়দেববাবুর মৃত্যুর পর ওঁর কোনও কাগজপত্রই আর পাওয়া যায় নি। কাঁহা গেলে তোমা পাই জানাচ্ছে যে এই গ্রন্থে বলা আছে এক পূর্ণিমা তিথিতে রাত দশটার সময় জগন্নাথের চন্দনবিজয়ের পরে গরুড় স্তম্ভের পেছনে চৈতন্যের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছিল। মাস বলা নেই।
এ লেখা শেষ করা যাক ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের বক্তব্য দিয়ে। তিনি জয়দেববাবুকে লিখেছিলেনঃ “চৈতন্যদেবকে গুম খুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং চৈতন্যদেবের দেহের কোনও অবশেষের চিহ্নও রাখা হয়নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটি কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল। … এই বয়সে শহীদ হওয়ার ইচ্ছে নেই বলেই বলতে পারবো না, ঠিক কোথায় চৈতন্যকে খুন করা হয়েছিল।”
(চৈতন্যর মৃত্যু/অন্তর্ধান সম্পর্কে প্রাইমারি টেক্সটগুলির বয়ান সংক্রান্ত আমার এই পুরোনো লেখাটা ঋতুপর্ণা খুঁজে পেয়েছেন, সমস্ত কৃতিত্ব তাঁরই ❤️
আমি এ লেখার পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টায় ছিলাম, তার তো আর প্রয়োজন নেই। তবে আরও বিস্তারিত ও বিন্যস্ত একটি কাঠামোয় এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটা নিয়ে এসে আর একটা লেখা দেওয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলাম।
আগের লেখাটা এ পোস্টে সামান্য পরিমার্জন করেছি)
© তমাল দাশগুপ্ত
http://fb.me/tdasgupto থেকে, ১৯শে এপ্রিল ২০২০