ভারতে প্রচলিত প্রাচীন ধর্মমতগুলির একটি গাণিতিক সাদৃশ্য আছে। সেটা হল ১০৮ সংখ্যার মাহাত্ম্য। বেদ পুরাণ তন্ত্র বৌদ্ধমত সর্বত্রই এই বিষয়ের প্রচুর সাক্ষ্য বর্তমান। যেমন:
১০৮ টি তন্ত্রপীঠ,
১০৮ টি উপনিষদ,
১০৮ টি প্রধান গোপী,
১০৮ টি জপমালার গুটি,
১০৮ টি জন মুখ্য শিবগণ,
১০৮ টি ধার সুদর্শন চক্রের,
১০৮ টি মুদ্রা শিবতান্ডব নৃত্যে,
১০৮ টি শ্রীকৃষ্ণের প্রখ্যাত নাম,
১০৮ টি ভাই কৌবর-পান্ডবেরা,
১০৮ টি আস্রব (কর্মপন্থা) জৈন মতের,
১০৮ টি পদ্মফুল দূর্গাপূজায় ব্যবহার হয়,
১০৮ টি প্রশ্ন বুদ্ধের প্রতি লঙ্কাবতার সূত্রে,
১০৮ টি আহুতি দেয়া হয় যেকোনো যজ্ঞে,
১০৮ টি পদে বুদ্ধের বিবৃতি/পদক্ষেপ ঐ সূত্রে,
১০৮ টি প্রদীপ দিয়ে সন্ধিপূজার আরতি হয়,
১০৮ টি পঞ্চদেবতার সংকীর্তনে নামের সংখ্যা,
১০৮ টি তুলসীপত্র নারায়ণ পূজায় অর্পিত হয়,
১০৮ টি ঘন্টাধ্বনিতে জাপানি বৌদ্ধদের বর্ষবরণ,
১০৮ টি দিব্যস্থানমের উল্লেখ আছে দিব্য প্রবন্ধমে,
১০৮ টি বেলপাতার মালা দেবীর গলায় দিতে হয়,
১৮০ টি রূপ সংস্কৃত শব্দের,
১৮০০০ টি শ্লোক শ্রীমদ্ভাগবতমে,
• বিভিন্ন মন্দিরের সন্ত সমাজে মহামণ্ডলেশ্বরের নামের আগে ‘শ্রী শ্রী ১০৮’/অষ্টোত্তরশ্রী দিয়ে শুরু হয়।
• ১০৮ সংখ্যাটিকে বলা হয় ‘হর্ষদ সংখ্যা’।
• ১০৮ সংখ্যাটি ব্রহ্মকে প্রকাশ করে।
• ১০৮ সংখ্যাটি মার্শাল আর্টে অনেক ব্যবহৃত হয়।
• এক প্রহর=১৮০ মিনিট।
• শ্রীযন্ত্রের ৫৪ টা ভাগ, প্রত্যেক ভাগ প্রকৃতি ও পুরুষ নির্দেশ করে. ৫৪×২= ১০৮
• এক ” মূহুর্ত” সময় কে অতীত(৩৬)+বর্তমান(৩৬)+ভবিষ্যত(৩৬)
দিয়ে গননা করা হয়, অর্থাৎ ৩৬+৩৬+৩৬=১০৮।
… আরও অনেক ক্ষেত্রে।
কেন ১০৮ এর এই বিশেষত্ব? উত্তরটা খুঁজে পাওয়ার পথটি খুব অদ্ভুত। রূপকথার একটি বিশেষ গল্প অনেকেরই জানা। বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীজ। রূপকথার গল্পগুলিকে কিছুটা ভিন্ন প্রেক্ষিতে দেখলে তার মধ্যে বহুলাংশে তন্ত্রের ভাব লক্ষ্য করা যায়। ‘তিন তাল গাছ উপরে মরণ ভোমরা’ ‘সাতমহলা পুরী’ ‘তেপান্তরের মাঠ’ ‘সোনার কাঠি রুপোর কাঠি’ ‘ঘুমন্ত রাজকন্যা’ এই সবেরই তান্ত্রিক তাৎপর্য বর্তমান।
বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীজ গল্পটিতেও তন্ত্রের আঙ্গিক বর্তমান।
কাঁকুড় ফলের আকৃতিটি বেশ লক্ষণীয়। একপ্রান্ত বেশ প্রশস্ত। অপরপ্রান্ত ক্রমে সরু হতে হতে বৃন্তে শেষ হয়েছে। ফলটিকে যদি উল্টোভাবে ধরা হয় তবে নিচে সূক্ষ্ম সূত্রাকার ও উপরে প্রসারিত এই আকারটির সাথে সুষুম্নাকাণ্ডের আকৃতির সাযুজ্য কল্পনা খুব কঠিন নয়। আধ্যাত্মিক দিক থেকে সেজন্যই এই ফলের রূপকল্প ব্যবহৃত হয়েছে।
এবার সেই বিশেষ কাঁকুড়ের প্রসঙ্গে আসা যাক। সেটি বারো হাত দীর্ঘ। এই বারো হাত পরিমাণ দৈর্ঘ্যকে দ্বিহস্ত পরিমিত ছয়টি সমান ভাগের সমন্বয় ভেবে নিলে এই ছয়টি অংশ সুষুম্নাকাণ্ডস্থ ষটচক্রের প্রতিভূ। কিন্তু ফলটির বীজ তেরো হাত দীর্ঘ। অর্থাৎ ফলের সমগ্র অংশ জুড়ে বিস্তৃত হওয়ার পরেও বীজটি ফলের প্রসারিত প্রান্ত থেকে এক হাত বেরিয়ে থাকে। এখানে বীজটির ঐ অংশটি সুষুম্নাকাণ্ডের উপর অবস্থিত সহস্রার চক্রের প্রতীক যার আয়তন অন্যান্য চক্রের অর্ধেক।
অর্থাত্ এই আপাতঃ অসম্ভব ফলের সন্ধান করার মধ্যে দিয়ে রূপকথাকার বলছেন দেহের সুপ্ত যোগগম্য আত্মশক্তিকে জাগ্রত করতে। গল্পের নায়ক রাজপুত্র সেই আত্মসন্ধানী জীবাত্মার প্রতীক। সুষুম্নাস্থ ষটচক্রপথে কুলকুণ্ডলিনীকে সহস্রারে উত্তোলন করলে তবেই রাক্ষসীরূপী রিপুর অত্যাচার থেকে দেহরূপী রাজ্যের উদ্ধার তথা চিরসুখ লাভ সম্ভব।
এই একই রূপকল্প দেখা যায় শিবের মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রে যেখানে সাধক ত্র্যম্বক মহাদেবের বন্দনা করে
সংসারবন্ধন থেকে মুক্তি কামনা করেন। তাঁর প্রার্থনা: এই বন্ধনমুক্তি যেন উর্বারুকের (কাঁকুড়) বৃন্তচ্যুত হওয়ার মতোই অনায়াসসাধ্য হয়।
আবার বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীজ মনে করিয়ে দেয় বেদের পুরুষসূক্তের সেই রহস্যময় উক্তি:
স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বা অত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্
তিনি (অর্থাত্ পরম পুরুষ) এই বিশ্বকে আবৃত করে দশ আঙুল পরিমিত অতিরিক্ত স্থানে অবস্থান করেন। দুই ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দশাঙ্গুল পরিমিত স্থান আর এক হাত পরিমিত স্থানের তাৎপর্য একই।
কষ্টকল্পিত হলেও বারো মাসে তেরো পার্বণের বা পুরাণের দ্বাদশ মাসে ত্রয়োদশ আদিত্যের তাৎপর্যও এক। ১৩/১২ এই গাণিতিক প্রতীকটির আধ্যাত্মিক বা মহাজাগতিক গুরুত্ব ছিল এই দ্বাদশভাগে বিভক্ত দেহপুরের ঊর্দ্ধে অর্ধভাগ সহস্রার বা নিরালম্বপুরীর রূপায়ণে। এই তত্ত্বই চণ্ডীতে ত্রিধামাত্রাত্মিকা জগতের অনুচ্চারিতা অর্দ্ধমাত্রারূপে ব্যাখ্যাত হয়েছে। তাই বারোতে তেরোর অনুষঙ্গ বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়।
প্রসঙ্গে ফিরি। পূর্ণতার প্রতীক হিসেবে একশো শব্দটির ব্যবহার বহু প্রাচীন। শতবর্ষ আয়ু পরিপূর্ণ জীবনের ইঙ্গিতবাহী। শতাব্দী আজও কালগণনার মাধ্যম। সেইরকম ভাবে সম্পূর্ণ দেহকাণ্ডটিকে যদি ১০০ ভাবা যায় তাহলে ১০৮/১০০ হল ঐ ১৩/১২ এরই ভিন্ন গাণিতিক প্রকাশ। ১০৮ যেন দেহশতকের মধ্যে থাকা গূঢ় সাধনতত্ত্ব যার জাগরণেই সাধক তত্ত্বদর্শী প্রজ্ঞা লাভ করতে পারেন। তাই আধ্যাত্মিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়কে ১০৮ দিয়ে চিহ্নিত করে এই আদি তত্ত্বের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়।
ভারতের সকল ধর্মমতের উৎসে ছিল আদিবিদ্বান কপিলের সাঙ্খ্য। এই বস্তুবাদী দর্শনে সংখ্যার দ্বারা জগতের স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে। জ্ঞাতে অজ্ঞাতে ১০৮ এর মহিমাকীর্তনের মাধ্যমে বৌদ্ধ জৈন তান্ত্রিক মতসমূহ আজও সেই সাঙ্খ্যেরই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে।