নববর্ষে ঈশ্বর গুপ্ত – তমাল দাশগুপ্ত

সে দিনটাও ছিল পয়লা বৈশাখ।

সে অনেকদিন আগের কথা, ঠিকঠাক করে বললে ১৭০ বছর আগেকার কথা। ১২৫৭ সনের পয়লা বৈশাখ। সেই কলকাতায় আপনাকে নিয়ে যাব আজ। আসুন, যাওয়া যাক।

পটলডাঙার দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে, সেখানেই সংবাদ প্রভাকরের প্রকাশক-সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত থাকেন। ঠনঠনের কালিবাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয় ঈশ্বর গুপ্তের বাড়ি, বাড়ির লাগোয়া নিজেরই প্রভাকর প্রেস। আগে অবশ্য বড়বাজারে ছিল গুপ্তকবির বাসা, ইদানিং ঠনঠনে বাড়ি করেছেন।

এই ঠনঠনে গুপ্তকবির প্রেসের বিশাল উঠোন। সেখানে আজ পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে বিপুল ও অভিনব এক উৎসব আয়োজন করেছেন গুপ্তকবি। লোকে লোকারণ্য, গমগম করছে ভিড়। এর আগে ইংরেজের উপনিবেশ কলকাতা মহানগরী এরকম জনসমাগম দেখেনি কখনও বাংলা নববর্ষে। এ যেন সাহেবদের নিউ ইয়ার পার্টিকে টেক্কা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন ঈশ্বর গুপ্ত।

আর নেমন্তন্ন করে এনেছেন কলকাতার বাঙালি সমাজের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কদের। সেখানে আজ চাঁদের হাট বসেছে। কে নেই সেখানে? হাটখোলার দত্তরা আছেন, জানবাজারের রাণী রাসমণির জামাই মথুর বিশ্বাস আছেন। প্রসন্ন ঠাকুর আছেন, ব্রজমোহন সিংহ আছেন। শ্যামাচরণ সেন আছেন, ধর্ম্মদাস পালিত আছেন। ঘুরে ঘুরে অতিথি আপ্যায়ণ করছেন ঈশ্বর গুপ্তের ভাই রাম গুপ্ত। সভাস্থলের একদিকে প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ আর জয়গোপাল তর্কালঙ্কার দুজনে এক অভিনব চেষ্টা করছেন, সংস্কৃতে কবির লড়াই। সে দেখতে শুনতে লোকজন ভিড় করে এসেছে। একটা হাসির হররা উঠল, কারণ পাশ থেকে গৌরীশঙ্কর ওরফে গুড়গুড়ে ভটচায একটা আদিরসাত্মক উদ্ভট শ্লোক বললেন।

জোড়াসাঁকো থেকে এইমাত্র এসে পৌঁছলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। শোভাবাজার থেকে আগেই এসে গেছেন রাজা রাধাকান্ত দেব। এই দুজন বাঙালি সমাজের দুটি অংশের নেতৃত্ব দেন, বাঙালির টোরি পার্টি আর হুইগ পার্টি বলতে পারেন। ওঁরা দুজনেই আজকের সভার মধ্যমণি। এককালে এই ঈশ্বর গুপ্তর উদ্যোগেই দেবেন ঠাকুরের ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে রাধাকান্ত দেবের ধর্ম্মসভার মিটমাট হয়েছিল। দেবেন ঠাকুরকে সভাস্থলে পদার্পণ করতে দেখে রাজা রাধাকান্ত দেব আসন ছেড়ে এগিয়ে গেলেন।

দুজন নক্ষত্র পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন আজ ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে। রাধাকান্ত দেব আর দেবেন ঠাকুর পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে যখন কোলাকুলি করলেন, সেই সময় সমবেত জনতার উল্লাস আর জয়ধ্বনি শুনে মনে হল, বাঙালির আজ বড় সুখের দিন।

কুশল বিনিময়ের পর রাধাকান্ত আর দেবেন দুজনেই একমত হলেন, আজ পয়লা বৈশাখে ঈশ্বর তার নতুন রচিত একটি কবিতা না শোনালেই নয়। চারদিকে যা জটলা হচ্ছিল তারা তো ইতিমধ্যেই বাঙালির ত্রিদেবকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। তাদের সবারও একই দাবি। সবাই সাগ্রহে উপবেশন করলেন এবার। প্রেসের দালানে তৈরি মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন এবার গুপ্তকবি। প্রতীক্ষায় সভার সকলে।

ঈশ্বরের গলা খানিকটা ভাঙা ভাঙা। গুপ্তকবি তাঁর একটি সদ্যরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করলেন। এ কবিতাটির নাম স্বদেশ।

জাননা কি জীব তুমি জননী জনমভূমি
যে তোমায় হৃদয়ে রেখেছে?
থাকিয়া মায়ের কোলে সন্তানে জননী ভোলে
কে কোথায় এমন দেখেছে?

ভূমিতে করিয়া বাস ঘুমেতে পুরাও আশ
না জাগিলে দিবা বিভাবরী
কত কাল হরিয়াছ এই ধরা ধরিয়াছ
জননী জঠর পরিহরি ।।

যার বলে বলিতেছ যার বলে চলিতেছ
যার বলে চালিতেছ দেহ
যার বলে তুমি বলী তার বলে আমি বলি
ভক্তি ভাবে কর তারে স্নেহ।।

প্রসূতী তোমারে যেই তাহার প্রসূতী এই
বসুমাতা মাতা সবাকার
কে বুঝে ক্ষীতির রীতি তোমার জননী ক্ষীতি
জনকের জননী তোমার।।

কত শস্য ফলমূল না হয় যাহার মূল
হীরকাদি রজত কাঞ্চন
বাঁচাতে জীবের অসু বক্ষেতে বিপুল বসু
বসুমতী করেন ধারণ ।।

সুগভীর রত্নাকর হইয়াছে রত্নাকর
রত্নময়ী বসুধার বরে
শূন্যে করি অবস্থান করে করে কর দান
তরণি ধরণিরাণী করে।।

ধরিয়া ধরার পদ পেয়ে পদ, নদী নদ
জীবনে জীবন রক্ষা করে।
মোহিনী মহীর মোহে বহ্নি বারি বন্ধু দোঁহে
প্রেমভাবে চরে চরাচরে।।

প্রকৃতির পূজা ধর পুলকে প্রণাম কর
প্রেমময়ী পৃথিবীর পদে
বিশেষত নিজদেশে প্রীতি রাখ সবিশেষে
মুগ্ধ জীব যার মোহমদে।।

ইন্দ্রের অমরাবতী ভোগেতে হয় না মতি
স্বর্গভোগ উপসর্গ সার
শিবের কৈলাসধাম শিবপূর্ণ বটে নাম
শিবধাম স্বদেশ তোমার।।

মিছা মণি মুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয়প্রেম
তার চেয়ে রত্ন নাই আর
সুধাকরে কত সুধা দূর করে তৃষ্ণা ক্ষুধা
স্বদেশের শুভ সমাচার।।

সভায় পিনপতন নিস্তব্ধতা। এ কোন কবিতা? আমরা কবির লড়াই জানতাম বটে। হাফ আখড়াই আর পাঁচালি। কিন্তু স্বদেশের এমন ডাক তো আগে কখনও শুনিনি! মাতৃভূমি? হ্যাঁ, সে সাহেবরা বলে বটে। জাতীয়তাবাদ? সে নিয়ে বাংলায় কবিতা? সংস্কৃতে নয়, ইংরেজিতে নয়। বাংলায় লেখা, বঙ্গভূমিকে নিয়ে লেখা কবিতা! কি আশ্চর্য!

রাজা রাধাকান্ত দেবের চক্ষু সজল হয়ে এসেছে, বুকের মধ্যে আশ্চর্য উন্মাদনা। এই ভাব এই ছন্দ তাঁর হৃদয়তন্তুতে অপূর্ব ঝঙ্কার সৃষ্টি করেছে। যাতে তার চোখের জল কারও দৃষ্টিগোচর না হয়, সেজন্য রাজা মাথা নিচু করে আছেন, মাথা অল্প অল্প দোলাচ্ছেন। পাশে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর চোখ বুঁজে আছেন, ভাবাবিষ্ট হয়েছেন।

ঈশ্বর গুপ্তর নিজেরও কি একটু কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে আসছিল আবৃত্তি করতে গিয়ে? দুয়েক মুহূর্ত থমকে গেলেন ঈশ্বর, তিনি তো তখন শুধু ঈশ্বর নন, তিনি তখন ঐন্দ্রজালিক, তিনি এই সভাকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন, এবং বাঙালি জাতি আগামী অনেক শত বছর ধরে তাঁর সেই পয়লা বৈশাখের মহামন্ত্রে মোহাবিষ্ট হয়ে থাকবে, ঈশ্বর আবার আবৃত্তি শুরু করলেন।

ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে দেখ দেশবাসীগণে
প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া
কতরূপ স্নেহ করি দেশের কুকুর ধরি
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া…

© তমাল দাশগুপ্ত

[বঙ্কিমের ঈশ্বর গুপ্ত সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ থেকে গৃহীত কয়েকটি ঐতিহাসিক তথ্যের ওপরে এই কল্পকাহিনী নির্মিত। ঈশ্বর গুপ্ত কলকাতায় আধুনিক বাঙালির নববর্ষ সম্মিলনীর জনক। ১২৫৭ সনের পয়লা বৈশাখ তাঁর যন্ত্রালয়ে অর্থাৎ প্রভাকর প্রেসে প্রথমবার যে নববর্ষ সম্মিলনী হয়েছিল, তাতে শ পাঁচেক নাগরিক আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সে এক অভিনব অনুষ্ঠান ছিল সেযুগের কলকাতায়। ঈশ্বর গুপ্তের এই বিরল ছবিটি জার্নাল অভ বেঙ্গলি স্টাডিজ পত্রিকা ও মাৎস্যন্যায় ফেসবুক পেজের সৌজন্যে।]

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ১৪ই এপ্রিল ২০২০

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s