সপ্তমিথ সেনযুগ – তমাল দাশগুপ্ত




সপ্তমিথ সেনযুগ

সেনযুগ নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রচুর মিথ প্রচলিত, অনেক ভ্রান্ত ধারণা। সেগুলো এতই ক্লিশে, যে সেগুলো যে সত্য নয়, এ কথা জেনে অনেকেই অবাক হবেন। আমি আজ সাতখানি মিথ ভাঙব ঠিক করেছি।

এক, বখতিয়ার খিলজি অষ্টাদশ অশ্বারোহী নিয়ে যুদ্ধ করে লক্ষ্মণসেনকে হারিয়ে বঙ্গবিজয় করেছিলেন।

এটি মিথ, সত্যি নয়। বখতিয়ার খিলজি ঘোড়াবিক্রেতার ছদ্মবেশে নদীয়া নগরীতে একটি অতর্কিত হামলা চালায়। রেইড যাকে বলে ইংরেজিতে। যুদ্ধ নয়। নদীয়া সেনরাজধানী ছিল না। রাজা লক্ষ্মণসেন বৃদ্ধ বয়সে গঙ্গাতীরে বাস করবেন বলে নদীয়ায় থাকতেন। বখতিয়ার ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বীরভূম হয়ে নদীয়ায় এসেছিল। রাজমহল বা দ্বারবঙ্গ দিয়ে আসেনি, কারণ সেনসৈন্য সেদিকে প্রহরায় ছিল। অন্তর্ঘাত না হলে এরকম হামলা সম্ভব কিনা, সে প্রশ্ন ঐতিহাসিকরা করেছেন।

বখতিয়ার বঙ্গ বিজয় করে নি। এমনকি নদীয়া বিজয়ও করে নি। নদীয়ায় অতর্কিতে হামলা চালিয়ে পুনরায় বিহারে ফিরে গেছিল। জীবদ্দশায় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের আড়াইখানা জেলার বেশি দখল করতে পারে নি বখতিয়ার খিলজি।

দুই, লক্ষ্মণসেন অতি অপদার্থ একজন রাজা। “তুমি কলিকালে বৃদ্ধ সেনরাজা, নহিলে বঙ্গদেশে মুসলমান কেন?” বঙ্কিম লিখেছিলেন গর্দভস্তোত্রে। বঙ্কিমের ক্ষোভ স্বাভাবিক, সে ক্ষোভকে মাথায় তুলে রেখে বলি পূর্বে বিহার থেকে পশ্চিমে স্পেন অবধি মুসলমানের অধিকার যে যুগে বিস্তৃত হয়েছে, সে যুগেও মুসলমানকে সম্মুখযুদ্ধের সাহস না দেখিয়ে চোরের মত হামলা করতে হয়েছে নদীয়ায়, এবং সেই অতর্কিত হামলা আটকাতে না পারার জন্য বৃদ্ধ সেনরাজাকে গাধা বলে বঙ্কিম সুবিচার করেন নি।

এটি মিথ। বস্তুত লক্ষ্মণসেন একজন দিগ্বিজয়ী রাজা ছিলেন। তিনি স্বীয় বাহুবলে তাঁর যৌবনকালে কলিঙ্গবিজয় করেছিলেন, অল্পবয়সে তিনি এই কলিঙ্গবিজয় করেন। তিনি গয়া থেকে কামরূপ, কলিঙ্গ থেকে বিক্রমপুর অবধি সেনসাম্রাজ্য শাসন করতেন। গঙ্গাবক্ষে তাঁর কৈবর্ত রণসেনা অপ্রতিরোধ্য ছিল, তারা প্রয়াগ পর্যন্ত নৌবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। আজকের বিহারের একটা বড় অংশ তাঁর সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। মুসলমান ঐতিহাসিক মিনহাজ লিখে গেছেন, সেযুগের ভারতে লক্ষ্মণসেন শ্রেষ্ঠতম নৃপতির মর্যাদা পেতেন।

লক্ষ্মণ রূপবান ছিলেন, পণ্ডিত ছিলেন। গুণের সমাদর করতে জানতেন বলেই তাঁর রাজসভায় অনেকগুলি রত্নের সমাহার ঘটেছিল। গীতগোবিন্দের একটি বাক্যবন্ধ, রাধামাধবয়োর্জয়ন্তী, সেটি লক্ষ্মণের রচিত বলে অনুমান, কারণ সদুক্তিকর্ণামৃতে লক্ষ্মণ ও তাঁর পুত্রের শ্লোকে এই বাক্যবন্ধ আছে, এবং এটি সম্ভবত লক্ষ্মণসেনের সৈন্যবাহিনীর রণধ্বনি ছিল। তাঁর সেনাবাহিনী উগ্রমাধবের প্রতিমূর্তি নিয়ে যুদ্ধ করত। দুঃখের কথা আমি সেযুগের একটিও উগ্রমাধব মূর্তি কোথাও খুঁজে পাইনি। উগ্র নরসিংহ দেখে খানিক অনুমান করার চেষ্টা করি। যাই হোক, লক্ষ্মণসেনের পরে এমন দিগ্বিজয়ী সম্রাট বাঙালি আর পায়নি। মধ্যযুগে গৌড়বঙ্গের মুসলমান শাসকরা কেউই বাঙালি ছিল না, অপিচ তাদের মধ্যেও লক্ষ্মণের মত দিগ্বিজয়ী শাসক কেউ ছিল না। আর কেউ একইসঙ্গে বিহার উড়িষ্যা গৌড়বঙ্গ কামরূপ একত্রে শাসন করতে পারে নি। লক্ষ্মণ আমাদের শেষ সূর্য।

তিন, লক্ষ্মণসেন বখতিয়ারের আক্রমণে ভয় পেয়ে কাপুরুষের মত পালিয়ে গেছিলেন, আর এমুখো হন নি।

মিথ। লক্ষ্মণ জানতেন যে বখতিয়ার তাকে জীবন্ত বন্দী করতে চাইছিল। উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত জোর করে লক্ষ্মণকে মুসলমান করা, অথবা লক্ষ্মণকে পণবন্দী করা, যাতে সেনরাষ্ট্রকে নতজানু করা সম্ভব হয়। সেজন্য বখতিয়ার যখন চোরের মত হামলা চালায়, তিনি দ্রুত নদীপথে পূর্ববঙ্গের যশোর-খুলনার শাখানুটি চলে যান। কিন্তু তিনি এরপর সসৈন্যে ফিরে এসেছিলেন, এবং অশীতিপর বৃদ্ধটির সঙ্গে হানাদার বখতিয়ারের অন্তত একটি সম্মুখযুদ্ধর রেকর্ড আমাদের কাছে আছে যেখানে আমরা জানতে পেরেছি মারাঙ্কমল্লদেব (লক্ষ্মণসেনের আরেক নাম) পর্যদুস্ত করেছিলেন বখতিয়ারকে। আশি বছর বয়সী বৃদ্ধের পক্ষে বখতিয়ারের মত একটা বর্বর ডাকাতের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করে তাকে হারানো কাপুরুষের কাজ নয়। লক্ষ্মণ বীরপুরুষ ছিলেন নিঃসন্দেহে।

লক্ষ্মণসেন বৃদ্ধ বয়সে পূর্ববঙ্গে মারা যান, স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। এবং তিনি যে ফিরে এসে বখতিয়ার নামক হানাদারকে অন্তত একটি সম্মুখযুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন, এই তথ্য ইতিহাসবিস্মৃত বাঙালিকে জানানোর জন্য নীহাররঞ্জন আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। দুঃখের কথা, বাঙালির ইতিহাস একটি ক্ল্যাসিকে পরিণত। বাকি ক্ল্যাসিকের মত, সেটাকেও কেউ পড়ে না। অতএব এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি অজ্ঞাত থাকে।

সেনেরা ব্রাহ্মণ্যবাদী (চার নম্বর মিথ), অত্যাচারী ও কাস্টিস্ট (পাঁচ নম্বর মিথ), বিজাতীয়, বহিরাগত (ছয় নম্বর মিথ)।

সেনরা বাংলার তান্ত্রিক ধর্মে দ্রুত দীক্ষিত হয়েছেন। শেষ যে সেনসম্রাট গৌড়েশ্বর উপাধি ধারণ করেন, মধুসেন, তিনি বৌদ্ধ হয়ে গেছিলেন। তিনি ১২৮৯ খ্রিস্টাব্দেও রাজত্ব করছিলেন পূর্ববঙ্গে, তার প্রমাণ আছে।

তিনজন সেনরাজ প্রকৃত অর্থে গৌড়েশ্বর হয়েছেন। এর আগের ও এর পরের রাজারা এই তিনজনের মত খ্যাতনামা নন, উপরন্তু এরা যথাক্রমে রাঢ়ে ও বঙ্গে রাজত্ব করেন, গৌড় এদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না।

গৌড়েশ্বর হিসেবে এই তিনজনই সর্বাধিক বিখ্যাতঃ বিজয়, বল্লাল, লক্ষ্মণ। প্রথম দুজন শৈব (বল্লাল পদ্মিনীকে বিবাহ করে সম্ভবত শাক্ত হলেন), পরেরজন বৈষ্ণব। প্রত্যেকেই বাংলার নিজস্ব তান্ত্রিক ধর্মের চর্চা করেছেন। বল্লালকে তো প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ বলা হয়েছে। কৌলীন্য প্রথা বল্লাল শুরু করেছিলেন কিনা তা নিয়ে নানা বিতর্ক। সেগুলোর মধ্যে এখন যাব না, কিন্তু কৌলীন্য একান্তই তান্ত্রিক ধর্মাচার। কৌলধর্ম তন্ত্রের একটি স্তম্ভ। বল্লালের সঙ্গে ঢাকেশ্বরী এবং কালিঘাট, দুটি সর্ববৃহৎ শাক্ত পীঠের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। অন্যদিকে লক্ষ্মণসেনের রাজসভা বৈষ্ণবতান্ত্রিক, এবং রাধাভাবনার উৎস জয়দেব এই রাজসভায় রচনা করছেন গীতগোবিন্দ। কেশবধৃত বুদ্ধশরীর জয় জগদীশ হরে, গীতগোবিন্দের এই অমর উক্তি যে রাজসভায় লেখা, সে রাজসভার বিরুদ্ধে বৌদ্ধবিদ্বেষের অভিযোগ যারা করেন, তারা হয় বাঙালির শত্রু অথবা অজ্ঞ, অথবা দুটোই।

বল্লালকে দেখলে বোঝা যায়, তিনি বৌদ্ধ বজ্রযানকে এবং লক্ষ্মণকে দেখলে বোঝা যায় তিনি বৌদ্ধ সহজযানকে নতুন বেশে নবকলেবরে পুনরুজ্জীবিত করেছেন, এবং বাঙালির শেকড়কে আরও শক্তিশালী করেছেন।

অত্যাচারী ও কাস্টিস্ট। বস্তুত এই মিথ একাধিক বিশ্বমানবিক ক্যাম্প থেকে প্রচারিত। আমি অতি সংক্ষেপে দুয়েকটি কথা বলব।

গৌড় গোধূলি বলে একটি বাজারচলতি ঐতিহাসিক উপন্যাস আছে। সেটি পড়ে আমি আঁতকে উঠেছিলাম। কৈবর্ত বিদ্রোহ সেখানে সেনদের অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ঘটছে। ইতিহাসের কতখানি ঘণ্ট পাকালে এমনটা সম্ভব হয়!। বস্তুত, কৈবর্তদের সঙ্গে পালদের যুদ্ধ হয়েছিল। সেনদের সঙ্গে কৈবর্তদের ভালো সম্পর্ক থেকেছে, কৈবর্ত ছিলেন সেনদের মিত্র। সেনরাজসভায় পপীপ নামে কৈবর্ত কবি ছিলেন, তাঁর একটি চমৎকার গঙ্গাস্তোত্র আছে। কৈবর্তজাতীয় মহেশ ছিলেন সেনসাম্রাজ্যের মহামাণ্ডলিক।

নবশাখ আরেকটি উদাহরণ সেনযুগের সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর। একাধিক কাস্টের সঙ্গে সেনদের আঁতাত ছিল, এবং আজও সেই স্মৃতি পুরোপুরি বিস্মৃত হইনি আমরা। যেমন মাহিষ্য জাতির সঙ্গে সেনদের আঁতাত।

সেনযুগের কাস্ট ডায়নামিক্স এবং তার পেছনের রাজনীতি একটা চিত্তাকর্ষক ব্যাপার। বাংলায় বর্তমান যে কাস্ট স্ট্রাকচার, যে স্মৃতিশাস্ত্র মধ্যযুগে মুসলমান আগমনের পরে লেখা হয়েছিল, যে বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তের সাক্ষ্য নিঃসন্দেহে মধ্যযুগে মুসলমান আগমনের পরে, তারা বল্লাল সম্পর্কে যা যা বলেছে, তার পেছনে কিছু ভেস্টেড ইন্টারেস্ট থাকতে পারে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেখুন। বল্লালসেন বৈশ্বানর গোত্রীয় বৈদ্য, কুলজি থেকে জানছি (পোড়ারাজা দ্বিতীয় বল্লালসেনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না, ইনি ধন্বন্তরী গোত্রীয় এবং প্রথম বল্লালের কয়েকশো বছর পরে)। বৈশ্বানরগোত্রীয় সেনসম্রাট বল্লালের এই বংশধররা আজ বৈদ্যজাতির মধ্যে কৌলীন্যর দিক থেকে সর্বনিম্ন অবস্থানে আছেন। প্রহেলিকা নয়? এ স্ট্রাকচার যদি বল্লালের হাতে বানানো, তাতে বল্লালের বংশধররাই সবার নিচে?

আমার সন্দেহ, মধ্যযুগে মুসলমান শাসকের স্বার্থে বাঙালির পুরোনো শক্তিকেন্দ্রগুলোর অবনমন করা হয়েছিল, রাজনৈতিক কারণে, এবং যে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণরা মধ্যযুগে আমাদের স্মৃতিগুলো লিখলেন, পুরাণ পুনর্লিখন করলেন, তারা অনেকে গৌড়ের সুলতানের মদতপুষ্ট। এই দিকটি মধ্যযুগের ইতিহাস বলে শুধু নয়, বাঙালির বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে বুঝতেও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি সামরিক জাতি, যারা সেনরাজশক্তির স্তম্ভ ছিল, আজ বাংলার হিন্দুসমাজের নিচের দিকে অবস্থান করছে, আর যারাই কমপ্রাদর, তারা উচ্চ স্থানে।

সেন আমলে কিছু খারাপ হয়নি, তা বলছি না। রাজনৈতিক কারণে স্বর্ণবণিকের ওপরে অত্যাচার ঘটেছে সম্ভবত, কারণ স্বর্ণবণিক বল্লভানন্দ ছিলেন পালরাজের শ্বশুর। নমঃশূদ্র জাতির মধ্যে প্রবাদ প্রচলিত আছে, বল্লালের কোপেতে জঘন্য। মতুরারা আজও কালীপুজো করেন না, করতে চান না। বল্লালসেনের সময়েও কি? যোগেন মণ্ডল যেমন মুসলিম লিগ, বল্লালের সময়েও কি বিক্ষুব্ধ ছিলেন এঁরা? ইতিহাসের এই বিপজ্জনক ইঙ্গিত বড় মাপের স্টাডির প্রত্যাশা করে। বাঙালির মধ্যে এলিট অংশটি তান্ত্রিক, যেমন শাক্ত, যেমন গৌড়ীয় বৈষ্ণব। বাঙালির প্রান্তিক অংশও তান্ত্রিক, যেমন বাউল, যেমন জাতবোষ্টম।

বাঙালি প্রকৃতি-উপাসক জাতি। তন্ত্রের প্রকৃতি বলছি, ইংরেজি নেচার নয়। যারা প্রকৃতি উপাসনা করেন না, তারা বাঙালি জাতির মধ্যে ঠিকঠাক ইন্টিগ্রেটেড হন নি, আমরা বলতে পারি।

ওদিকে পালযুগের শেষাবস্থার অবসাদ কাটিয়ে ওঠার প্রয়াসে একটা কোর্স কারেকশনের পরে সেনরাষ্ট্র একটা টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। বল্লাল যদি কোনও অন্যায় করে থাকেন নমঃশূদ্রদের প্রতি, সেটা খুবই খারাপ করেছেন, কিন্তু এইটা স্মরণ রাখুন, প্রত্যেকটি পাল ইন্সক্রিপশন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লে বুঝবেন, চণ্ডালদের সঙ্গে পালরাষ্ট্রেরও সদ্ভাব কিন্তু ছিল না। অতএব যদি সঙ্ঘর্ষ সেদিন হয়ে থাকে, তার পেছনে বৃহত্তর ইঙ্গিতটি বুঝতে হবে।

না বলে পারছি না, বল্লাল পণ্ডিত ও সুলেখক ছিলেন। বস্তুত বল্লাল আর লক্ষ্মণ দুজনেই পণ্ডিত সুপুরুষ বীর ছিলেন, এবং বল্লাল যাকে বলে অত্যন্ত কালারফুল লোক ছিলেন। এদের একমাত্রিক এবং অজ্ঞ চিত্রায়ণ বাঙালির ইতিহাসের ক্ষতি করছে।

প্রসঙ্গ বহিরাগত। কর্ণাটদেশ আগত। সত্যি, এরা নিজেরাই বলে গেছেন, কর্ণাটের ব্রহ্মক্ষত্রিয়। কিন্তু পালযুগে যে একটি চলাচল হয়েছিল কর্ণাটক উপকূল এবং গৌড়বঙ্গের মধ্যে (কোঙ্কনি ভাষা এবং গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ আজও তার সাক্ষ্য দিচ্ছেন), তার সঙ্গে সেনদের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে আমি মনে করি, তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ, তা নিয়ে বৃহৎ সন্দর্ভ লিখতে হবে, এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেটা সম্ভব হবে না। কিন্তু সেনরা বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে রাঢ় অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন, এদেশেই বিবাহাদি করেছেন। সেনদের সঙ্গে বৈদ্যবংশীয় সম্বন্ধের সূত্রপাত সম্ভবত এখানেই। বস্তুত ইংরেজ আমলেই প্রথম এ কথাটা উঠল যে সেনরা বৈদ্য নন। তার আগে পর্যন্ত পুরো মধ্যযুগ ধরে সবাই জানত যে এরা বৈদ্য। এ প্রসঙ্গে সুধীরকুমার মিত্রের পাঠ স্মর্তব্য। তিনি লক্ষ্য করেছেন লক্ষ্মণসেন তাঁর মাধাইনগর তাম্রশাসনে নিজেকে বৈদ্যবংশীয় বলে পরিচয় দিয়েছেন। পদ্মিনীর বৌভাতে বৈদ্যরা নিমন্ত্রিত ছিলেন, অনেকে যেতে অস্বীকার করেন, যারা গেছিলেন, সোনার পিঁড়ি পেয়েছিলেন এবং স্বর্ণপীঠী নামে পরিচিত হন। পদ্মিনীর সঙ্গে বিবাহ না করে তাঁকে উপপত্নী হিসেবেও রাখতে পারতেন বল্লাল। তাঁর এক কায়স্থজাতীয় উপপত্নীর সন্তান কালুরায়ের থেকে চন্দ্রদ্বীপের রাজবংশের সৃষ্টি। বল্লাল কাস্টিস্ট হলে পদ্মিনীকে সমাজের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিবাহ করতেন না। এবং বল্লালরা বহিরাগত হলে বাংলার নিজস্ব কাস্ট, বৈদ্যদের সঙ্গে তাঁদের সুনির্দিষ্ট সম্পর্কের এতগুলি ইঙ্গিত থাকত না। ব্রহ্মক্ষত্রিয় বললে সেটা কোনওভাবে বৈদ্যদের সঙ্গে সম্পর্ক বাতিল করে না, কারণ বর্ণ আর জাতি ভিন্ন ক্যাটিগরি। বর্ণে ব্রহ্মক্ষত্রিয় হলে জাতে বৈদ্য হতে আটকায় না, এটা লক্ষ্য না করা ইতিহাসবিদের গাফিলতি।

আদিশূরের বংশ সম্পর্কেও একই কথা খাটে, তাঁদেরও বর্ণ যাই থাকুক, জাতিতে সম্ভবত বৈদ্য ছিলেন। বস্তুত সেন ও শূরবংশের মধ্যে বিবাহের সম্পর্ক ঘটেছে বিজয়ের সময়। বল্লাল সম্পর্কে শূর-দৌহিত্র।

বাঙালির ইতিহাসের পাঠ করতে গিয়ে মনে রাখা দরকারঃ গৌড়সাম্রাজ্যের শেষ তন্ত্রধর্মাশ্রয়ী সার্বভৌম রাজবংশকে বহিরাগত লেবেল সেঁটে দিলে, সেই সূত্রে তাদের থেকে বাঙালির একটি বড় অংশের কাস্টগুলিকে, বাঙালির শক্তিকেন্দ্রকে ও বাঙালির প্রাণের ধর্ম, তন্ত্রধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারলে বাঙালির শত্রুর সুবিধা হয়।

আজকের সপ্তম ও শেষ মিথ, বখতিয়ারের আক্রমণে সেনসাম্রাজ্য ধূলিসাৎ হয়েছিল।

ওপরের আলোচনা থেকে বুঝতেই পারছেন, উল্লেখের আগেই অবশ্য অপ্রমাণিত।

লক্ষ্মণসেনের পরে কেশব ও বিশ্বরূপসেন গর্গযবনান্বয়প্রলয়কালরুদ্র উপাধি ধারণ করেছেন, আগ্রাসী তুর্কআফগানদের হারিয়ে। সেনরা পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করেছেন বখতিয়ার আগমনের প্রায় একশো বছর পরেও। চন্দ্রদ্বীপের রাজবংশ (দনুজমাধব থেকে দনুজমর্দন বিখ্যাত হয়েছেন) বহুযুগ তাঁদের স্বাধীনতা ধরে রেখেছেন, এবং এঁরা সেনদের জ্ঞাতি ছিলেন, যদিও কায়স্থ (এ প্রসঙ্গে আমার মধ্যযুগের বাঙালি ও রাজশক্তি নামক সন্দর্ভটি উল্লেখ্য, লিঙ্ক দিলাম https://shoptodina.wordpress.com/2019/09/16/%e0%a6%ae%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%97%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%99%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%bf-%e0%a6%93-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%b6%e0%a6%95/)। অন্যদিকে সেনদের মূল বংশটি লুপ্ত হওয়ার পরেও (সম্ভবত তাঁদের দৌহিত্রবংশীয়) দ্বিতীয় বল্লালসেন বিক্রমপুরে রাজত্ব করেছেন, তিনি আক্রমণকারী বাবা আদমকে (বল্লালচরিতের বায়াদুম্ব) পরাস্ত করেছেন। কলকাতার কাছে চন্দ্রকেতুগড়ের কিংবদন্তী রাজা চন্দ্রকেতুও সেনবংশীয় ছিলেন বলে দিলীপ মৈতে মনে করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পীর গোরাচাঁদের কাহিনীর সঙ্গে বাবা আদমের কাহিনীর সাযুজ্য আছে।

অর্থাৎ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে সেনরা আরও কয়েকশো বছর ধরে বাঙালির স্বাধীনতা ধরে রেখেছেন। এ ইতিহাস গর্বের। এ ইতিহাসকে যারাই বিকৃত করে, আমার ক্ষুদ্র সামর্থে আজ তাদের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধ ঘোষণা করলাম এই লেখায়।

© তমাল দাশগুপ্ত

ছবিতে দেখছেন সেনযুগের দুর্গামূর্তি এবং উমা-মহেশ্বর মূর্তি। ছবি কৃতজ্ঞতা ঋতু পর্ণা

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ১৪ই মার্চ ২০২০

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s