ইতিহাসে বাঙালির জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসাব্যবস্থা ও চিকিৎসক – তমাল দাশগুপ্ত

বাঙালির রোগ, চিকিৎসা ও চিকিৎসক – প্রাচীনতম যুগ

পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে যে উন্নত নগর সভ্যতা ছিল, সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন হত, আমাদের জানা নেই। কিন্তু বাঙালির চার সহস্র বছরের ইতিহাসে কপিলের সাংখ্য দর্শন যাকে আমরা তন্ত্রের একটি নির্দিষ্ট প্রোটেস্ট্যান্ট ভার্শন (প্রাচীনতম রেকর্ডেড তন্ত্র হিসেবে সাংখ্যকেই ধরতে হবে) হিসেবে গণ্য করি, সেটি প্রাচীন বাঙালির মধ্যে একটি চিকিৎসা ব্যবস্থার নিউক্লিয়াস হিসেবেও কাজ করত।

প্রসঙ্গত বিদ্যাসাগর শুধু সাংখ্যকে ভ্রান্ত দর্শন বলেন নি। সংস্কৃত কলেজে আগে আয়ুর্বেদ পড়ানো হত। সেটা বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে ক্ষমতাসীন হওয়ার আগেই ইংরেজরা বন্ধ করে দিয়েছিল, সাহসী সমাজসংস্কারক বিদ্যাসাগর আয়ুর্বেদকে ফিরিয়ে আনার কোনও চেষ্টা কিন্তু করেন নি। যাই হোক, সে প্রসঙ্গে আধুনিক যুগের বাঙালির চিকিৎসা-আলোচনায় ফিরব।

সাংখ্য/তন্ত্র শুধু প্রকৃতি-কেন্দ্রিক দর্শন নয়। সাংখ্য বা তন্ত্র যখন প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করে, সেটি মানব শরীরের সঙ্গে বহির্জগতের সম্পর্ক বিচারও বটে। এবং সেজন্য,এই দর্শনকে পূর্ব ভারতে প্রাচীন যুগে আয়ুর্বেদের যে স্ফূরণ ঘটেছিল, তার জন্য সঙ্গত কারণে ক্রেডিট দেওয়া যায়।

সাংখ্যের দুঃখবাদ অনেকাংশেই আমাদের রোগব্যাধিময় অস্তিত্ব সম্পর্কে একটা কমেন্টারি। শেষ বিচারে একে অতিক্রম করতে পারে সাংখ্যের উচ্ছিত্তি, যাকে বৌদ্ধধর্মে মোক্ষ বলা হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে দুঃখের উৎস জেনে (আধিদৈবিক, আধিভৌতিক), মানব অস্তিত্বের কষ্ট অপনোদন করার উদ্দেশ্যে যে তিগিচ্ছাসত্ত বা চিকিৎসা শাস্ত্র আদি বৌদ্ধ যুগে দেখি, তাকেই পরবর্তীকালে পৌরাণিক হিন্দুধর্ম আয়ুর্বেদ নাম দিয়েছে। এই শাস্ত্র পূর্ব ভারতের আউটার এরিয়ানদের সৃষ্টি। এজন্য সারা ভারতের মধ্যে একমাত্র বাংলাতেই বৈদ্য নামে আলাদা একটি জাতি দেখতে পাওয়া যায়।

ইন্ডো-ইউরোপিয়ানদের মধ্যে কেল্ট জাতির ড্রুইড (Druid) যে কাজ করতেন, ভারতে অবৈদিক আউটার এরিয়ান, অর্থাৎ আমাদের বাঙালিদের পূর্বমানুষদের মধ্যেও নিঃসন্দেহে সেরকম একটা শ্রেণী ছিল। পূর্বভারতে ও বিশেষত বাংলায় বিভিন্ন ওষধিগুণসম্পন্ন ভেষজ পদার্থের উৎপাদন ঘটেছিল, যেগুলো মূলত আমাদের গন্ধবণিকরা সারা পৃথিবীতে রপ্তানি করতেন। এজন্যই জীবকের সেই বিখ্যাত উক্তি, ওষধি গুণ নেই, এমন একটিও বৃক্ষ লতা গুল্ম তিনি গোটা অরণ্য তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করেও খুঁজে পান নি।

ভাবলে বিষণ্ণ লাগে। আমরা জানিও না, আমরা বারবার বিজাতীয় শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে আমাদের কোন্‌ অমূল্য সম্পদ হারিয়েছি, যার ফলে শুধু আমরা নই, সারা পৃথিবীই দরিদ্র হয়েছে, সুস্বাস্থ্য হারিয়েছে। বিশেষত, আমাদের আবহাওয়া, আমাদের জেনেটিক গঠনের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসার যা যা নিদান আমাদের পূর্বমানুষরা জানতেন, আমরা তার একাংশও জানি না, এ আক্ষেপ রাখার স্থান নেই।

আয়ুর্বেদ চর্চা যদি তার পুরোনো আলোকোজ্জ্বল চরিত্রে ফিরতে পারে, অনেক অসুখের আরও দ্রুত প্রতিকার করা সম্ভব হত, অন্তত পশ্চিমি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অগমেন্ট করা যেত তাতে সন্দেহ নেই।

ছবিতে দেখছেন পিপ্পলী বা দীর্ঘ মরিচ। ওষধিগুণের জন্য সেযুগে বিখ্যাত। তাছাড়া তখন রান্নায় স্বাদ আনতে এই বস্তুটির ব্যবহার। অত্যন্ত মহার্ঘ। তাম্রলিপ্ত থেকে এই পিপ্পলী নিয়ে বাংলার গন্ধবণিক যেতেন বহির্বাণিজ্যে। এই পিপ্পলীর এক পাউন্ড বা আধ সের সেযুগে পনেরো স্বর্ণমুদ্রা দামে বিক্রি হত রোমে, প্লিনি জানাচ্ছেন। রোমের স্বর্ণমুদ্রায় এভাবে বাংলার গঙ্গারিডাই সভ্যতা ধনী হয়ে উঠেছিল।

আলোচনা চলবে।

© তমাল দাশগুপ্ত

১৬ই মার্চ ২০২০

বাঙালির চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাস – ২

বাঙালির চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাস -২

ঋগ্বেদের সময়কাল থেকে যত দূরে সরে আসা যায়, বৈদিক আর্যের ওপরে তন্ত্রের প্রভাব এবং তন্ত্রনির্ভর যে সভ্যতা একদা সরস্বতী মোহনা ও পরে গাঙ্গেয় মোহনার বাসিন্দাদের দ্বারা পরিচালিত, তাদের চিন্তাধারা, জ্ঞানবিজ্ঞান ও জীবনচর্যার প্রভাব দেখতে পাই। এ কথা চিকিৎসা শাস্ত্র সম্বন্ধে খাটে। যজুর্বেদ এবং অথর্ব বেদে আমরা এমন অনেকগুলো উক্তি পাই যেগুলো চিকিৎসা শাস্ত্র সম্বন্ধীয়। এগুলো বৈদিক আর্যের ওপরে অবৈদিক তান্ত্রিক পদ্ধতির প্রভাব। প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হল ঋগ্বেদের সোমকে কেন্দ্রে বসিয়ে (যেমন ধরুন কোনও পুরুষ দেবতাকে কেন্দ্রে বসিয়ে এবার সেই দেবতার শক্তি হিসেবে কোনও নারীদেবতার কল্পনা – যেটা আর্যাবর্তের সঙ্গে ব্রাত্য অবৈদিক আর্যের সিস্টেমের একটা পরিচিত কম্প্রোমাইজ ফর্মুলা) তার চারধারে নানা ওষধি ভেষজের সমাহারসংক্রান্ত শ্লোক। এখানে সোম হচ্ছে সভারেন, বাকিরা সবাই প্রজা; সোম গুরু, বাকি সব ওষধি তার শিষ্য।

ঋগ্বেদের বর্বর আর্য ওই সোম নামে একরকম গুল্মর রস খেয়ে নেশা করতেন। সোম আদতে কি ছিল, সেটা নিয়ে নানা বিতর্ক আছে, আমি সেটার মধ্যে এখানে যাব না, কারণ বাঙালির বিষয় না। ওটা বর্তমান আফগানিস্তানে বসবাসকারী বর্বর বৈদিক আর্যদের প্রিয় নেশার দ্রব্য ছিল। যাদের আরও জানার ইচ্ছে সুকুমার সেন দেখে নিতে পারেন, তিনি সোম সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখেছেন। গত শতকের হিপি আন্দোলনের যুগে সোম সম্পর্কে নতুন করে আগ্রহ জন্মেছে, এবং একটা ইন্টারেস্টিং তত্ত্ব হচ্ছে বনমানুষ থেকে আদিমানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় এরকম একটা কোনও নেশার দ্রব্য বড় ভূমিকা নিয়েছিল, এবং সোমই সেই দ্রব্য ছিল, এরকম একটা তত্ত্ব আছে। আগ্রহীরা গুগল করলে জেনে যাবেন। বর্বর বলতে কোনও ভ্যালু জাজমেন্ট দিচ্ছি না। আমরা সবাই সত্যজিত রায়ের আগন্তুক দেখেছি।

গুরুশিষ্য সংবাদের ধাঁচে যজুর্বেদ অথর্ববেদ এবং সংহিতার যুগে বৃক্ষায়ুর্বেদ লেখা হয়েছে, সেখানে সোম কেন্দ্রে আছেন, বাকিরা তার কাছে এসে রিপোর্ট করছে, যে তাদের কার কি ওষধিগুণ, কে কোন রোগ নিরাময় করে, কোন বৃক্ষ কোন গুল্ম কোন অঞ্চলে ভালো ফলে।

এখানে সাংখ্যের প্রভাব স্পষ্ট দেখি, যখন ত্রিধাতুর উল্লেখ পাই। কোনও বেদেই স্পষ্ট করে ত্রিধাতু সম্পর্কে বলা নেই, কিন্তু ঋক ১/৩/৬ সূক্তে ত্রিধাতুর নামমাত্র উল্লেখ আছে। এর অর্থ সায়ন করেছেনঃ ত্রিধাতু হল বায়ু, পিত্ত, কফ, এবং তারাই সোম, তেজস ও অপ্‌। সায়নভাষ্য নিঃসন্দেহে অনেক পরে লেখা এবং যখন লেখা তখন সাংখ্যকেন্দ্রিক আয়ুর্বেদের প্রভাব স্পষ্ট এসেছে। এইভাবে সংখ্যা দিয়ে গুণ-তত্ত্ব-উপাদান বিচার নিঃসন্দেহে সাংখ্যের অবদান।

ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয় যখন ত্রিধাতুকে পঞ্চভূত (স্থূলভূত) -এর সম্পূট হিসেবে দেখা হয়েছে পরবর্তী আয়ুর্বেদে।

নামটি আয়ুর্বেদ বটে। কিন্তু আয়ুর্সাংখ্য বা আয়ুর্তন্ত্র হলেই যথার্থ হত।

আলোচনা চলবে।

© তমাল দাশগুপ্ত

১৭ই মার্চ ২০২০

প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাঙালির জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ইতিহাস – একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা

চন্দ্রকেতুগড় অঞ্চলে খ্রিষ্টপূর্ব যুগের গঙ্গারিডাই সভ্যতার যে নগর পরিকল্পনা দেখি, সেখানে কয়েকটি জিনিস প্রথমেই চোখে পড়ে।

আবর্জনা ফেলার আলাদা কুণ্ড। জীবজন্তুর হাড়গোড়, মৃৎপাত্রর ভগ্নাংশ, কাষ্ঠ ভগ্নাংশ।

পানীয় জলের কুয়ো। পোড়ামাটির বলয় একটির পর একটি সাজিয়ে তৈরি, অন্তত দশ বারো হাত গভীর পানীয় জলের গভীর কুয়োর অবশেষ পাওয়া গেছে।

পয়ঃপ্রণালী। মাটির ১৩-১৪ ফিট নিচে পোড়ামাটির নলের পয়ঃপ্রণালী এই নলগুলি পর পর সাজানো থাকত এবং প্রত্যেকটি নলের দৈর্ঘ্য ছিল দুই ফিট সাত ইঞ্চি। এই ভূগর্ভের পয়ঃপ্রণালী মৌর্যপূর্ব যুগের, অর্থাৎ নন্দবংশের সমসাময়িক বলে গবেষকরা অনুমান করেছেন।

এছাড়া ওঁদের স্নানকালে ব্যবহার করার পোড়ামাটির গাত্রমার্জনী পাওয়া গেছে। বডি স্ক্রাব আর কি।

বিস্তারিত জানতে গৌরীশঙ্কর দে দেখুন। দুটি ছবিই তাঁর বই প্রসঙ্গ প্রত্ন প্রান্তর চন্দ্রকেতুগড় থেকে। প্রথমটি পোড়ামাটির নলের ভগ্নাংশ। দ্বিতীয়টি গাত্রমার্জনী।

বাঙালির নগরসভ্যতার মধ্যে মধ্যে উন্নত স্যানিটেশন এবং পাবলিক হাইজিন একটি ধারাবাহিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে সেনযুগ অবধিও দেখি। উদাহরণস্বরূপ, সেনসম্রাট বল্লালসেনের শয়নগৃহ সংলগ্ন একটি ল্যাভেটোরি ছিল।

আমি এখানে একটি কথা পুনর্বার বলতে চাই। সাংখ্য বা তন্ত্র থেকে উদ্ভূত বাঙালির পূর্বমানুষদের জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে বা চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কে যে উন্নত দার্শনিক চিন্তাসমূহ দেখি, তা একটি বস্তুনিষ্ঠ শাস্ত্র হওয়ার সব শর্ত পূরণ করে, সেটি গোবলয়ের গোমূত্র থেরাপি ধরণের voodoo বা mumbo jumbo নয়।

দুঃখের কথা আমাদের বিশ্বমানবদের মধ্যে প্রাচীন বাংলায় যে উন্নত চিকিৎসা বিদ্যা ছিল বা পাবলিক হেলথ সিস্টেম ছিল সেটা জানার কোনও প্রয়াস ঘটেনি। ইতিহাস বিস্মৃত জাতি আমরা। একদলের ইতিহাস শুরু হয় বখতিয়ার আগমন থেকে, কারও হয়ত জব চার্নক থেকে, কারও হয়ত রবীন্দ্রনাথ থেকে আর কারও শ্যামাপ্রসাদ থেকে।

প্রসঙ্গে ফিরি।

বলা দরকার, বাঙালির মধ্যে যে উন্নত পাবলিক হেলথ সিস্টেম চালু ছিল, সেটা রাষ্ট্রের উদ্যোগে পরিচালিত হত প্রাচীন যুগে। অবশ্যই রাষ্ট্রটি বাঙালির নিজের ছিল।

শশাঙ্কের কুষ্ঠরোগ হয়েছিল, বলা হয় তখন গ্রহবিপ্র বলে একদল ব্রাহ্মণকে আনা হয়েছিল। এরা যে যাগযজ্ঞ করতেন সেটা সম্ভবত স্রেফ আগুনে বা ভস্মে ঘি ঢালা নয়, সম্ভবত তার একটা quasi medicinal counterpart ছিল। তবে বিস্তারিত তথ্যের অভাবে শশাঙ্কের গৌড়তন্ত্রে পাবলিক হেলথ সিস্টেম কেমন ছিল সে সম্পর্কে তেমন কিছু বলা যাচ্ছে না।

পালযুগে এসে দেখা যাচ্ছে খ্যাতনামা চিকিৎসকরা রাষ্ট্রের উদ্যোগে তৈরি মহাবিহারগুলোয় চিকিৎসাবিদ্যার অধ্যাপনা করছেন। প্রত্যেকটি মহাবিহার একটি করে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালও বটে।

পালযুগের চক্রপাণি দত্ত বাঙালি বৈদ্যকুলের অন্যতম আইকন। তাঁর পিতা নারায়ণ ছিলেন গৌড়সম্রাটের পাত্র অর্থাৎ মন্ত্রী এবং রসবত্যাধিকারী অর্থাৎ রাজকীয় রন্ধনশালার প্রধান advisor, এই গৌড়সম্রাট ছিলেন জয়পাল। চক্রপাণি লিখেছেন চরকের টীকা – আয়ুর্বেদ দীপিকা বা চরক তাৎপর্য দীপিকা, এবং সুশ্রুতের টীকা – ভানুমতী। শব্দচন্দ্রিকা নামে আকর দ্রব্য ও ভেষজ গাছ গাছড়ার আলোচনা, দ্রব্যগুণসংগ্রহ নামে পথ্য নিরূপণ আলোচনা গ্রন্থ তো আছেই, তবে বীরভূম অঞ্চলের চক্রপাণি দত্তের অতুলনীয় কীর্তি হল চিকিৎসা সংগ্রহ।

চক্রপাণির গুরু নরদত্ত। তাঁর এক ভাই ভানু। এঁরা সবাই পালযুগের রাষ্ট্র-উদ্যোগে স্থাপিত হেলথ সিস্টেমের খ্যাতনামা চিকিৎসক। এছাড়া পালসম্রাট রামপালের সভা চিকিৎসক ভদ্রেশ্বরের কথা জানা যায়। চন্দ্র নামে একটি বৌদ্ধ রাজবংশ ছিল। এবং ভদ্রেশ্বরের পিতা দেবগণ অন্তরঙ্গ বা সভা চিকিৎসক ছিলেন গোবিন্দচন্দ্রের (মধ্যযুগে মুসলমান সুলতানও অন্তরঙ্গ নিয়োগ করতেন, যারা ছিলেন সুলতানের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। কিন্তু পালযুগে দেখছি যে অন্তরঙ্গ হতেন সম্পূর্ণ রাজসভা এবং বাই এক্সটেনশন সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের পাবলিক হেলথ সিস্টেমের কর্ণধার)। ভদ্রেশ্বরের পুত্র সুরেশ্বর বা সুরপাল ছিলেন পালবংশীয় জনৈক ভীমপাল নামক শাসকের অন্তরঙ্গ। এই সুরেশ্বর শব্দপ্রদীপ ও বৃক্ষায়ুর্বেদ নামে দুটি ভেষজ গাছ গাছড়া সংক্রান্ত বই লেখেন। লোহপদ্ধতি বা লোহসর্বস্ব নামে আরেকটি বই লেখেন যেখানে লোহার ওষধিদ্রব্য প্রস্তুত নিয়ে আলোচনা।

বেশিরভাগ গ্রন্থ অবলুপ্ত। বেশিরভাগ বাঙালি চিকিৎসকের নাম হারিয়ে গেছে। এই কজনের নাম নীহাররঞ্জন দিয়েছেন।

মধ্যযুগে এসে দেখি, রাষ্ট্রের উদ্যোগ নেই। কিন্তু বাঙালি নিজের উদ্যোগে একটা নিজস্ব জনস্বাস্থ্য সিস্টেম গড়ে তুলেছে। যেটা অনেকাংশে জঙ্গম, চলনশীল। কারণ বোঝা যায়। মধ্যযুগে অস্থিরতা এবং ভায়োলেন্স। ফলে বৈদ্যরা ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা করছেন। কবিকঙ্কণ তাঁর চণ্ডীমঙ্গলে বলছেন যে বৈদ্যরা বটিকা প্রস্তুত করতেন, এবং তন্ত্র সম্পর্কে তাঁদের ভালো জ্ঞান ছিল (চার বেদ পড়ে তারপর পঞ্চম বেদ পাঠ করলে বৈদ্য, এরকম etymology আছে বটে। তবে বৈদ্য প্রকৃতই তন্ত্রজ্ঞানী ছিলেন। আগেই বলেছি, আয়ুর্বেদ না হয়ে আয়ুর্তন্ত্র বলা গেলে বেশি ভালো হত)। তাঁদের সঙ্গে নানা পুঁথি থাকত এবং তারা ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা করতেন। রোগ অসাধ্য দেখলে কর্পূর পাঁচন তৈরি করে আনার নাম করে পলায়নও করতেন (সেযুগেও সম্ভবত রোগী মরলে ডাক্তার ধরে ঠ্যাঙানোর সুপ্রথাটি চালু ছিল, কাজেই প্রাণরক্ষার তাগিদে এ কাজটা করতে হত)।

এখন বসন্তকাল। পশ্চিমি জগতে গুটি বসন্ত রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হওয়ার অনেক আগে মধ্যযুগের বাঙালির মধ্যে একধরনের টিকা চালু ছিল, বাঙালি শুধু শেতলার পুজো করতো না। শীতকাল শেষ হওয়ার সময় একদল পেশাদার vaccinator তুলোয় ভেজানো একরকম বসন্তর গুটি নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন। সেটি শরীরের উপরিতলে (চামড়ার ওপরেই) প্রয়োগ করা হত। ওই টিকা দিলেই জ্বর আসতো, এবং চার পাঁচদিন জ্বরের পর রোগী সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যেত।

বাঙালির চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাস একটি সমুদ্রসম বিষয়। আমি বুড়ি ছোঁয়া করলাম গত তিনদিনের তিনটি লেখায়।

© তমাল দাশগুপ্ত

১৮ই মার্চ ২০২০

http://fb.me/tdasgupto থেকে

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s