তমাল দাশগুপ্ত মানেই রসগোল্লা, এটা একবার কারা যেন বাংলা বাজারে রটিয়ে দিয়েছিল। চাড্ডিরা লিখতে শুরু করল, রসগোল্লা দাশগুপ্ত। আর কাংলাপক্ষের কর্ণধার একবার লিখে ফেল্ল, রসগোল্লা জাতীয়তাবাদ। তার একটা পুঁটি গ্রুপ ছিল তখন ফেসবুকে, এখনকার মত আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়নি তার, সেখান থেকে আমায় বেরও করে দিল, উড়েদের বিরুদ্ধে কথা বলছি, অতএব ভারতে হিন্দি-বিরোধী ঐক্য দুর্বল করে দিচ্ছি, এই অভিযোগে।
আমি প্রকৃতই রসগোল্লা নিয়ে বিশেষ কিছু লড়িনি। অল্প কিছু লেখালেখি ছাড়া। আসলে সেই সময়ে আমরা লড়ছিলাম বাংলা ভাষার ধ্রুপদী মর্যাদার জন্য। ‘ধ্রুপদী মানো বাংলাভাষাকে’ শীর্ষক একাধিক সেমিনার করেছি তখন। দুহাজার পনেরো-ষোলো সালের কথা। সে লড়াই অবশ্য আজও জারি আছে, কোনও যুদ্ধবিরতি ঘটে নি। চর্যাপদ যে বাঙালির বেহাত হয়েছে, এবং উড়েদের দখলে গেছে, সেটার বিরুদ্ধে লড়া জরুরি। সে লড়াই যখন শুরু করলাম, সেই সময়েই উড়েদের সঙ্গে রসগোল্লা নিয়ে ঝামেলা বাধল। কথা হচ্ছে, রসগোল্লা সাধারণ লোকে বোঝে। চর্যাপদ অন্তত ক্লাস টেন অবধি পড়াশোনা না করলে বোঝে না, সেটা কাংলা বা চাড্ডি কোনও পক্ষই কেউই বিশেষ পড়ে টড়ে নি। ফলে আমরা কি করছি জিগ্যেস করায় অনেকেই বলত, ওই তো, রসগোল্লা নিয়ে উড়েদের সঙ্গে লড়ছে।
আমি দুদিন এই রসগোল্লার প্রতিবাদ করে তারপর হাঁফিয়ে গেলাম। তারপর থেকে কারও মুখে এইরকম কথা শুনলে হাসিমুখে ঘাড় নেড়ে সায় দিতাম। শত্রুমিত্র নির্বিশেষে সবাই একমত হয়েছিলেন, সপ্তডিঙা এবং তমাল দাশগুপ্ত রসগোল্লা নিয়ে লড়ছে। ধ্রুপদী মানো রসগোল্লাকে এরকম একটা সেমিনার করলে অবশ্য মন্দ হয় না। বাঙালির সঙ্গে ছানার সম্পর্কের একটা ইতিহাস লেখার প্রয়োজন আছে।
অনেকটা এরকমই ব্যাপার হল শ্যামা বাংলা ভাগ করেছিলেন। সবাই মেনে নিয়েছেন, এটাই আসল কথা। ছেচল্লিশ সাতচল্লিশের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখবেন বাংলা ভাগের পক্ষে সবাই মত দিয়েছেন। বস্তুত বাংলা ভাগে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন বাংলার কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ। শরত বসু আর সোহরাওয়ার্দি ফরমুলা কেউ মানেনি। শ্যামা একাহাতে বাংলা ভাগ করে হিন্দুর হোমল্যান্ড তৈরি করেছেন, এ প্রকাণ্ড অপলাপের ফাঁকি যিনিই সেযুগের ইতিহাস সম্পর্কে সামান্য ওয়াকিবহাল তিনিই ধরে ফেলবেন। শ্যামা বস্তুত তখন একজন প্রান্তিক চরিত্র। হিন্দু মহাসভায় ছিলেন শ্যামা তখন (গান্ধীহত্যার পরে তিনি হিন্দু মহাসভা ছাড়েন), এবং হিন্দু মহাসভা বাংলায় একটি প্রান্তিক শক্তি ছিল।
আপনারা দেখবেন সেযুগে হিন্দু-মুসলমান সঙ্ঘর্ষে শ্যামার ভূমিকা নগণ্য। বাংলা ভাগ করেছিলেন বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতিবিদরা সবাই, বাংলার আইনসভায়। বাংলার প্রত্যেক দল এই বিষয়ে একমত ছিল। শ্যামা একবার পার্লামেন্টে বলেছিলেন বটে, আই ডিভাইডেড পাকিস্তান, কিন্তু সেটার একটা প্রেক্ষাপট আছে। লোকসভায় বিতর্ক হচ্ছিল, শ্যামাকে কংগ্রেস সদস্যরা বলেন, আপনিও তো দেশভাগ মেনে নিয়েছিলেন। লক্ষ্য করুন, বলা হচ্ছে, আপনিও মেনে নিয়েছিলেন। আপনিই দেশভাগ অথবা বাংলাভাগ করেছেন, এমন কথা প্রশংসা হোক বা অভিযোগচ্ছলে ঘুণাক্ষরেও কেউ বলেন নি। শ্যামাও দেশভাগ মেনে নিয়েছিলেন, এ কথা যখন কংগ্রেসের সদস্যরা বলেন, তখন শ্যামা, তুখোড় রেডি-উইট বা প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল তাঁর, তিনি উত্তর দেন, আপনারা ভারত ভাগ করেছেন, আমি পাকিস্তান ভাগ করেছি। এটা অলঙ্কার, একে আক্ষরিক অর্থে নিলে বেরসিকের কাজ হয়।
কিন্তু বর্তমানে শ্যামার শত্রু মিত্র সবাই বিশ্বাস করে নিচ্ছেন যে শ্যামাই দেশভাগ করেছেন, কারণ এভাবে ইতিহাসের সরলীকৃত যে পাচনটি তৈরি হয়, সেটা এদের বাল-উদরে সহজপাচ্য। সেদিন দেখলাম তথাগত আর সুজন ঝগড়া করছেন এই নিয়ে, দুজনেই একমত যে শ্যামাই দেশভাগ করেছেন, একমত হয়ে এবার একজন বলছেন শ্যামা কত ভালো, আরেকজন বলছেন শ্যামা কত খারাপ। শ্যামাই একাহাতে দেশভাগ করেছেন ধরে নিলে আর বাংলার ইতিহাসের জটিলতাগুলো খোঁজার দরকার পড়বে না, বাংলাভাষী হিন্দু কোন্ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে দেশভাগকে একমাত্র সমাধান ধরে নিয়েছিল, সে ইতিহাস আর জানতে হবে না, বাংলাভাষী হিন্দুর আক্রান্ত হওয়ার বিপুল ইতিহাস এবং তার প্রতিরোধ করার বর্ণময় ক্রনিকল, এককথায় আমাদের সব নায়ক এবং সব খলনায়ককে ধামাচাপা দেওয়া যাবে, যেখানে (সেকুলারদের জন্য) দুষ্টু বা (চাড্ডিদের জন্য) মিষ্টি শ্যামা একাই বাংলাকে ভেঙে দুটুকরো করে দিলেন।
আপনারা কেউ কেউ হরিপদ ভৌমিকের নাম শুনে থাকবেন হয়ত। রসগোল্লা নিয়ে ওঁর একটি দুর্দান্ত ঐতিহাসিক গবেষণা আছে। আমি নিশ্চিত আপনারা প্রায় কেউই হরিপদ বিশ্বাসের নাম শোনেন নি। ইনি উত্তর চব্বিশ পরগণায় নিউব্যারাকপুর নামক জনপদের স্রষ্টা। পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুর পুনর্বাসনের জন্য এই অখ্যাতনামা হরিপদ বিশ্বাস যা করেছিলেন, সে তুলনায় বলতে বাধ্য হচ্ছি, শ্যামা কিচ্ছু করেন নি। পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুর পুনর্বাসনের জন্য একটি বাসস্থান বলুন যা শ্যামা নির্মাণ করেছিলেন। শুধু একটির নাম বলুন।
শত্রুমিত্র কারও অসুবিধে হয় না, সুবিধে প্রচুর, অতএব শ্যামা বাংলা ভাগ করেছিলেন এ মিথ সম্ভবত সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। কিন্তু ইতিহাস অত্যন্ত নির্মম, অনেক বেলুনই ফাটিয়ে দেয়। ইতিহাস অত্যন্ত বহুবর্ণ ও বহুমাত্রিক, তাকে একরঙে সরলরেখায় আঁকতে যাওয়ার চাড্ডি বা বামজেহাদি প্রোজেক্ট সফল হবে না।
© তমাল দাশগুপ্ত
http://fb.me/tdasgupto থেকে, ১৯শে নভেম্বর ২০১৯