উৎপল দত্ত,মার্ক্স ও জনতার আফিম – তমাল দাশগুপ্ত

মার্ক্স যেখানে ধর্মকে জনতার আফিম বলেছেন, সে সম্পর্কে একটা সরলীকৃত ব্যাখ্যা করা হয়। ধর্ম হচ্ছে নেশা, কু-অভ্যেস, অতএব পরিত্যাজ্য। বেশিরভাগ সরলীকরণের মত এটাও বেশ বিভ্রান্তিজনক। প্রকৃতপক্ষে ধর্ম সম্পর্কে এই আফিম বিশেষণ ব্যবহারের মাধ্যমে – মনে রাখতে হবে সে হল উনিশ শতক – ধর্মের অতিপ্রয়োজনীয় ওষধি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন মার্ক্স, কারণ আফিম ছিল প্রাথমিকভাবে তাই। ওষুধ হিসেবে এর থেরাপিউটিক ব্যবহার ছিল, সেটাই মার্ক্স বোঝাচ্ছেন মূলত।

উনিশ শতকে আফিম অন্তত এই ছখানি ঔষধি কাজ করত, আমি আমার সাধ্যমত বলছি শুনুন – অ্যানাস্থেটিক (অর্থাৎ অবশ/অজ্ঞান করে শল্যচিকিৎসা করার কাজে), অ্যানোডাইন (ব্যথা উপশমে), অ্যানালজেসিক (অচৈতন্যভাব না এনেই ব্যথা উপশমে), সেডেটিভ (প্রশান্তি ও নিদ্রা আনায়), অ্যান্টি-স্প্যাজমোডিক (পেশী-খিঁচুনি উপশমে), অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি (প্রদাহ উপশমে)। যারা ডাক্তার আরও ভালো বলতে পারবেন।

আফিম তো স্থায়ী ব্যথা নিরসন করত না, সাময়িক উপশম করত মাত্র, অর্থাৎ এই আফিম-ওষুধ এক অর্থে কাল্পনিক সমাধান ছিল বাস্তব যন্ত্রণার। মার্ক্সের ওই বক্তব্যের নির্যাস মূলত এই। আমার পিএইচডির বিষয় ছিল টেরি ইগলটনের লেখার মার্ক্সবাদের সঙ্গে ক্যাথলিক ধর্ম ও আইরিশ জাতীয়তাবাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, কাজেই মার্ক্সবাদ এবং ধর্মের সম্পর্কবিচার আমায় বিস্তারিতভাবে করতে হয়েছিল। ইউরোপে বা ল্যাটিন অ্যামেরিকায় অনেকেই খ্রীষ্টধর্মের সঙ্গে এবং জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মার্ক্সবাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। পৃথিবীতে যে কয়টি কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত দেশ আছে বর্তমানে, প্রত্যেকটিই জাতীয়তাবাদী আদর্শে পরিচালিত, প্রত্যেকেই স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের সঙ্গে নিবিড় অ্যালাইনমেন্ট রক্ষা করে। উদাহরণস্বরূপ, চীনের কোনও কমিউনিস্ট চীনের কনফুসিয়ান ধর্ম বা বৌদ্ধধর্মকে পরিত্যাজ্য অর্থে বা নেতিবাচক অর্থে বিবেচনা করবে না, কারণ সেটা করলে চীনের স্বার্থকেই জলাঞ্জলি দেওয়া হয়।

দুঃখের কথা মার্ক্স-উবাচের এই ইতিহাসনিষ্ঠ অর্থ আজ পর্যন্ত এদেশে উৎপল দত্ত ছাড়া আর কোনও মার্ক্সবাদীকে বুঝতে দেখিনি। জনতার আফিম বলে উৎপল দত্ত একটা বিজেপি-বিরোধী প্রহসন লিখেছিলেন বটে, কিন্তু সে তো ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে, ওটা পার্টির ফরমায়েসি লেখা। ইন্টেলেকচুয়াল উৎপল দত্ত আমাদের সামনে এসেছিলেন গিরিশ মানসে। ধর্ম আমাদের ভাষা দেয়, আমাদের যুগযন্ত্রণাকে প্রকাশ করে, মানব অস্তিত্বের বাক্য ও মানসের অগোচর দিগন্তকে ধর্ম সন্ধ্যাভাষায় উচ্চারিত কবিতার মত প্রকাশ করে। ধর্ম সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পপুলার কালচারও বটে। ধর্ম ও মিথ অনেক মানুষকে এক করে, একটা সাধারণগ্রাহ্য ভাষা দেয় যাতে সম্প্রদায় নির্মিত হয়, জাতি নির্মিত হয়। ধর্মকে শাসক নিজ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে বটে, কিন্তু ধর্মকে শাসকের বিরুদ্ধে জনতার স্বার্থে বৈপ্লবিক প্রয়োজনে যুগে যুগে ব্যবহার করে এসেছেন প্রজ্ঞাবান মানুষেরা, যেমন চৈতন্য নিত্যানন্দ করেছেন, যেমন বঙ্কিম করেছেন। সে আলোচনা আমরা বারান্তরে করব। আজ গিরিশ মানস দিয়ে এই বক্তব্য শেষ করি।

উৎপল দত্ত গিরিশ মানসে লিখছেন –

“মার্কসের একটি কথা ঘন ঘন উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে- ধর্ম হচ্ছে জনগণের আফিম। পুরো অনুচ্ছেদটি উদ্ধৃত করলে দেখা যাবে, মার্কস অমন একদেশদর্শী কোনো রায় দেন নি, দিতে পারেন না। ধর্মের ইতিহাসের যিনি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকার তিনি অমন একটা অতি-সরলীকরণ করতেই পারেন না। মার্কস বাস্তবিকপক্ষে বলেছিলেনঃ

ধর্ম হচ্ছে জগতের এক সামগ্রিক তত্ব, বৃহৎ সংক্ষিপ্তসার, জনপ্রিয় আঙ্গিকে সে-জগতের যুক্তি, তার আধ্যাত্মিক সম্মানের আস্ফালন (point d’honneur), তার উদ্দীপনা তার নৈতিক অনুমোদন, তার দুঃখাপনোদন ও সমর্থনের ব্যাপক ভিত্তি। যেহেতু মানবসত্তার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই ধর্ম হচ্ছে সেই সত্তার কাল্পনিক বাস্তবায়ন। ধর্মীয় দুঃখবাদ হচ্ছে বাস্তব দুঃখের প্রকাশ (in bold letters) ও বাস্তব দুঃখের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ (in bold letters) । ধর্ম হচ্ছে নির্যাতিত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন জগত পরিবেশে কল্পিত আত্মা। এ হচ্ছে জনতার আফিম।”

© তমাল দাশগুপ্ত

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ২০শে নভেম্বর ২০১৯

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s