তমাল দাশগুপ্ত
রাজা গণেশ এবং রাজা দনুজমর্দনদেবঃ মধ্যযুগের প্রহেলিকা?
দুজনে কি অভিন্ন ব্যক্তি? রমেশ মজুমদার সেরকমই মনে করে গেছেন, সেই থেকে জনপ্রিয় ইতিহাসে, বিশেষ করে নভেল-টভেলে এরকম লেখা শুরু হয়েছে। যদিও বাকি ইতিহাসবিদরা প্রায় কেউই রমেশ মজুমদারের সঙ্গে এই বিষয়ে সহমত নন।
মধ্যযুগের ইতিহাস গভীরভাবে পাঠ করে আমার প্রতীতি জন্মেছে যে গণেশ এবং দনুজমর্দন – এই দুজন পৃথক ব্যক্তি। দুজনে কাছাকাছি সময়ের, কিন্তু সময়কাল কিঞ্চিৎ পৃথক। এবং গণেশ ছিলেন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, দনুজমর্দন ছিলেন বঙ্গজ কায়স্থ। গণেশ রাজত্ব করতেন গৌড়ে এবং দনুজমর্দনের রাজধানী ছিল চন্দ্রদ্বীপে। দুজন ভিন্ন ব্যক্তি আমি নিঃসন্দেহ। রমেশ মজুমদার সেরকম ভ্রান্তি করেছেন যেরকম প্রমাদে রাখালদাস একদা পতিত হয়েছিলেন শশাঙ্ককে শেষ গুপ্তসম্রাট মহাসেনগুপ্তর পুত্র অনুমানে। অর্থাৎ অনুমানের ভিত্তি নেই, ইতিহাসের একটি গ্যাপ বা ব্ল্যাঙ্ক স্পেসকে ভরাট করতে এই অনুমান করা হয়েছে মাত্র, কিন্তু খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলে বোঝা যায় যে এ হল ভ্রান্ত অনুমান।
মধ্যযুগের সমস্ত ফার্সি নথিতে রাজা কান্স বলে পরিচিত গণেশ রাজত্ব করেছেন ১৪০৯-১৫ খ্রিষ্টাব্দের সময় (এই বিষয়ে সবকটি ফার্সি নথিই একমতঃ রিয়াজ-উস-সালাতিন, তারিখ-ই-ফিরিশ্তা, তবাকত-ই-আকবরি সবাই বলছে গণেশ মোটামুটি সাত বছর ক্ষমতায় ছিলেন) । তিনি নিজের নামে মুদ্রাঙ্কন করতেন না, ইলিয়াস-শাহী বংশীয় বায়াজিদ শাহের নামে মুদ্রা চালাতেন। গণেশ নিজে সিংহাসনে বসেন নি, গৌড়ের সিংহাসনে কাফিরের পক্ষে সরাসরি শাসন করা সেযুগে প্রায় অসম্ভব ছিল, এবং অতিরিক্ত ক্ষমতাশালী হয়ে পড়ায় গণেশকে অপসারণ করার জন্য পাণ্ডুয়াবাসী নুর কুতব-উল-আলম যিনি শেখ নুর বাঙ্গালি নামেও পরিচিত – ইনি বাঙালি ছিলেন না, ইনি বাংলার অধিবাসী মুসলমান ছিলেন বলে অন্য জায়গার মুসলমানরা এঁকে বাঙ্গালি বলত – জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কি-কে আহ্বান করেন। গণেশ এর পরে আত্মসমর্পণ করেন শেখ নুরের কাছে, এবং শেখ নুর তখন জৌনপুরের সুলতানকে ফেরত পাঠিয়ে দেন। গণেশ অবশ্য এরপর সুপটু রাজনীতিবিদের মত দ্রুত বিশ্বাসভঙ্গ করেন এবং এই শেখ নুরের পুত্র শেখ আনোয়ারকে হত্যা করেন। এ বর্ণনা রিয়াজ-উস-সালাতিনের।
কিন্তু গণেশ সম্পর্কে মধ্যযুগের ফার্সি নথিতে এরকমও বলা আছে যে তিনি মুসলমানদের প্রিয়পাত্র ছিলেন, এবং মুসলমানি আচার-ব্যবহার এতদূর অবধি রপ্ত করেছিলেন যে তিনি মারা যাওয়ার পরে তাঁকে সমাধিস্থ করার প্রস্তাব উঠেছিল (তারিখ-ই-ফিরিশ্তা)। লোকমুখে প্রচলিত প্রবাদের ওপরে ভিত্তি করে দুর্গাচরণ সান্যাল (লেখক বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, গণেশ এই জাতির লোক) বলেছেন যে গণেশ যখন গৌড়ে থাকতেন তখন মুসলমান বেগমদের সঙ্গে মুসলমানের মত থাকতেন এবং যখন পাণ্ডুয়ায় থাকতেন তখন পরিবারবর্গের সঙ্গে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের মত বাস করতেন। রজনীকান্ত চক্রবর্তী আরেকটি লোকপ্রবাদের কথা বলেছেন, গণেশই প্রথম সত্যপীরের সিন্নি প্রচলন করেন, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাংস্কৃতিক অভিন্নতা প্রচলনের স্বার্থে।
গণেশের জন্ম একটাকিয়ার ভাদুড়ি বংশে। এরা বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, এবং এরা মুসলমান শাসকের পুরোনো কমপ্রাদর। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহর হয়ে এই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণরা সেনাপতির কাজ, মন্ত্রীর কাজ করে প্রথম ক্ষমতাসীন হয়েছেন। এর কয়েক প্রজন্ম পরে গণেশের উত্থান। তিনি অতিরিক্ত শক্তিশালী হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু তিনি নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন নি। যদু, গণেশের পুত্র, জালালুদ্দিন নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন (এর মুসলমান হওয়ার, তারপর গণেশের উদ্যোগে প্রায়শ্চিত্ত করে পুনরায় হিন্দু হওয়ার, এবং তারপরে আবার মুসলমান হওয়ার কাহিনী আছে রিয়াজ-উস-সালাতিনে), এর মুদ্রায় দেখা যায় ইনি নিজেকে বিন-সুলতান বলেন নি, অর্থাৎ এঁর বাবা গণেশ রাজ-উপাধি ধারণ করতেন না।বস্তুত গণেশ সম্পর্কে সবকটি সোর্স থেকেই যা জানতে পারি, তা থেকে স্পষ্ট তিনি de facto রাজা ছিলেন, de jure ছিলেন না। এবং গণেশের মুসলমান বিদ্বেষ সম্পর্কে কেবল রিয়াজ-উস-সালাতিন থেকেই জানা যাচ্ছে, বাকি দুটি ফার্সি সোর্স পড়লে মনে হয়, এটি মুসলমান বিদ্বেষ ছিল না, এটি শেখ নুর বাঙ্গালির সঙ্গে গণেশের রাজনৈতিক সঙ্ঘর্ষ ছিল। সেটাকেই শেখ নুর বাঙ্গালি একটি ধর্মীয় জেহাদের রূপ দিয়েছিলেন, নতুবা গণেশের সঙ্গে মুসলমানদের যথেষ্ট সদ্ভাব ছিল। শেখ বদর -উল -ইসলাম একবার গণেশের রাজসভায় বত্তমিজি করেছিলেন, অভিবাদন করেন নি, এবং বলেছিলেন কাফিরকে অভিবাদন করা সঙ্গত নয়, কিন্তু সেজন্য তার শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড দেন গণেশ) কোনওভাবেই গণেশের মুসলমান-বিদ্বেষ প্রমাণ করে না, রাখালদাস বলছেন এই কাজ করলে পৃথিবীর যে কোনও শাসকের দরবারেই মৃত্যুদণ্ড পাওনা হত।
এই একটাকিয়া ভাদুড়ি বংশের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণরা মধ্যযুগে কালাপাহাড় থেকে উদয়ানাচার্য কুল্লুক ভট্ট – অনেক ঐতিহাসিক চরিত্রের জন্ম দিয়েছেন। বস্তুত মধ্যযুগের সমস্ত স্মৃতি-পুরাণ, এবং হিন্দুধর্মের বর্তমান কাস্ট-হায়ারার্কি এবং সেই সংক্রান্ত কাহিনীগুলি মুসলমান শাসকের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট এই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীর দ্বারা প্রচারিত, তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। অদ্বৈত আচার্যের পূর্বপুরুষ নরসিংহ নাড়িয়াল এই গণেশের মন্ত্রী ছিলেন।
এবার দনুজমর্দন সম্পর্কে কিছু কথা। চন্দ্রদ্বীপের কায়স্থ রাজবংশ বল্লালসেনের কায়স্থজাতীয় উপপত্নীর বংশধর কালুরায় দ্বারা স্থাপিত, এরকম জনশ্রুতি আছে, সেটা দুর্গাচরণ সান্যাল উল্লেখ করেছেন। বস্তুত সেনদের সঙ্গে যে যোগাযোগ ছিল সেটা এঁদের উপাধি দেখলে বোঝা যায়, অরিরাজদনুজমাধব (দনুজ রায়, নৌজা ইত্যাদি নামেও মুসলমান নথিতে উল্লিখিত) যিনি ১২৮১ সাল নাগাদ পূর্ববঙ্গে স্বাধীন সার্বভৌম রাজা, তিনি সেনদের মত তাঁর উপাধিতে অরিরাজ যুক্ত করতেন (অরিরাজবৃষভশঙ্কর, অরিরাজনিঃশঙ্কশঙ্কর, অরিরাজমদনশঙ্কর যথাক্রমে বিজয় বল্লাল লক্ষ্মণের উপাধি ছিল)।
এই দনুজমাধবের মুদ্রা এবং সিল দীনেশ সরকার পাঠ করেছেন।
এই দনুজমাধবের বংশে দনুজমর্দনদেবের উত্থান। দনুজমর্দনদেব এবং মহেন্দ্রদেব, দুজনের মুদ্রাতেই চণ্ডীচরণপরায়ণ লেখা আছে। রাখালদাস লিখেছিলেন, পেশোয়ার থেকে চট্টগ্রাম অবধি আর কোনও হিন্দুরাজার সাধ্য হয়নি নিজের নামে মুদ্রা চালানোর। এ কাজ মধ্যযুগে প্রথম করেছিলেন বরিশালের এই বঙ্গজ কায়স্থ রাজবংশ। প্রসঙ্গত, বরিশালের এই কায়স্থ রাজবংশের কেউ যদি এই পোস্ট দেখেন, অনুগ্রহ করে ইনবক্স করবেন, আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে। এই রাজবংশের বংশধররা এখনও জীবিত আছেন আমি জানি, এঁরা বসু পদবী ধারণ করেন, তবে শোনা যায় দনুজমর্দনের বংশ বিলুপ্ত হয় এবং দনুজমর্দনের ভাগ্নের বংশধর এঁরা।
দনুজমর্দনের মুদ্রা এবং মহেন্দ্রদেবের মুদ্রা প্রদত্ত হয় ১৪১৭-১৮ সাল নাগাদ। এই সময় গণেশ প্রয়াত এবং জালালুদ্দিন সিংহাসনে বসে পড়েছেন। একটি গল্প প্রচলন করা হয়েছে যে গণেশ নিজেই দনুজমর্দন নাম নিয়ে মুদ্রা প্রচলন করেছেন এবং গণেশের কনিষ্ঠ পুত্র মহেন্দ্রদেব নামে মুদ্রা প্রচলন করেছেন। কিন্তু এই কল্পনায় গুরুতর ইতিহাসবিচ্যুতি আছে। সমস্ত বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ কুলপঞ্জিকায় কোথাও গণেশের এই দনুজমর্দন হওয়ার কাহিনী নেই, অথচ গণেশ সম্পর্কে তো অনেক কথাই লেখা আছে, এটা সত্যি হলে এটাও থাকত। উপরন্তু সমস্ত বঙ্গজ কায়স্থ কুলকারিকায় কোথাও দেখবেন না চন্দ্রদ্বীপের এই কায়স্থ রাজবংশের দনুজমর্দনের সঙ্গে গণেশের কোনও অভিন্নতা ঘোষিত হয়েছে। এক ব্যক্তি একই সঙ্গে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ এবং বঙ্গজ কায়স্থ হতে পারেন না। তাছাড়া সময়কাল এবং রাজধানী আলাদা। গণেশ নিজের নামে একটিও মুদ্রা প্রচলন করেন নি, তিনি বায়াজিদ শাহের নামে মুদ্রা চালাতেন। সবথেকে বড় কথা, গণেশ মুসলমানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সেটা সাধারণভাবে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণের বৈশিষ্ট্য (অন্তত সেযুগে)। দনুজমর্দন নাম নিয়ে তিনি আচমকা বিদ্রোহ করবেন, এ কল্পনায়, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, ইন্সট্যান্ট নুডলসের মত ইন্সট্যান্ট ইতিহাস বানিয়ে ফেলার উত্তেজক প্রবণতা আছে, ইতিহাসের একনিষ্ঠ পাঠ নেই। রাখালদাস লক্ষ্য করেছিলেন যে গণেশ এবং দনুজমর্দন ভিন্ন দেশীয় (বারেন্দ্র, বঙ্গজ), ভিন্ন জাতীয় (ব্রাহ্মণ, কায়স্থ), ভিন্ন সময়ের (দনুজমর্দন বস্তুত জালালুদ্দিনের সমসাময়িক)।
গণেশ-দনুজমর্দন যুগের ইতিহাস রমেশ মজুমদার দায়সারাভাবে পাঠ করেছিলেন। ঠিক করেন নি। রমেশ মজুমদারের এই কাজটি চাঁদের কলঙ্কের মত তাঁর গৌরবে একটু কালো দাগ হয়ে রয়ে গেছে।
দনুজমর্দন দেবের রৌপ্যমুদ্রার ছবি রইল। মধ্যযুগে যে বাঙালি শাসক প্রথম নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম যে হিন্দু শাসক নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন, সেই দনুজমর্দন দেব এবং বরিশালের কায়স্থ রাজবংশ সম্পর্কে আমাদের বাঙালিদের গর্বিত হওয়া সাজে। গণেশ সম্পর্কেও যথেষ্টই গর্বিত হতে পারি তাঁকে নির্মোহভাবে পাঠ করলে, তিনি বহুবর্ণ চরিত্র ছিলেন। কিন্তু ভ্রান্ত পাঠ গণেশের সম্মান বাড়াবে না।
© তমাল দাশগুপ্ত
মূল ফেসবুক পোস্ট ২৫ নভেম্বর ২০১৯ https://www.facebook.com/tdasgupto/photos/a.2355585367798352/2648454048511481/?type=3&theater
তমাল দাশগুপ্ত পেজ http://fb.me/tdasgupto
মধ্যযুগের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে বৃহত্তর পাঠের জন্য সপ্তডিঙা পত্রিকায় প্রকাশিত এই প্রবন্ধটি দেখুনঃ
