তমাল দাশগুপ্ত
বাঙালির শক্তি উপাসনার প্রধান প্রতীক মা কালীর বিভিন্ন রূপ।
ঋগ্বেদে যে রাত্রি, সেখান থেকে কালরাত্রি, সেখান থেকে কালী, এরকম একটা মত আছে। সেক্ষেত্রে কার্তিকী অমাবস্যায় এই যে মায়ের পুজো আমরা করি, সে এই উপমহাদেশে অন্তত চার-সাড়ে চার হাজার বছরের পুরোনো। বৈদিক আর্য নিতান্ত পুরুষকেন্দ্রিক ছিলেন, তাঁদের ভড়কে দিতে সম্ভবত আমাদের তান্ত্রিক পূর্বমানুষরা এই দেবীর উপাসনা করতেন, যিনি রাত্রির ভীতিজনক রূপ, অমারাতের অধিষ্ঠাত্রী। অর্থাৎ বৈদিকদের জন্য কালী ভীতিজনক উপদেবতা। অনেক পরে কালিদাসের কাব্যে কালীকে দেখা যাচ্ছে শিবের প্রমথগণের মধ্যে, তিনি কপালাভরণ (অর্থাৎ খুলি গেঁথে গেঁথে তৈরি মালা) পরে ভূত-পেত্নীদের মধ্যে বরযাত্রী যাচ্ছেন সেখানে।
অর্থাৎ এটিই বৈদিক-ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক রূপ। ভয়াল। এছাড়া ঋগ্বেদে নক্ৎ-কৃষ্ণী উল্লিখিত হন। তিনিও কালীর একটি পারসেপশন। ওই আমরা যেমন হনুমানকে নিয়ে সেরেফ হাসি, ওরা কালীকে নিয়ে কেবলই ভয় পেতেন।
তাহলে বাঙালির দেবী কালীর নিজস্ব রূপ কি কেবল ভীতিজনক? না। রামপ্রসাদ থেকে রামকৃষ্ণে যা পাচ্ছেন, সেটাই মা কালীর বাঙালি রূপ। এভাবে পাঠ করলে বুঝতে পারবেন, আমাদের ঘরের মেয়ে, আমাদের মা, কিভাবে সহস্র সহস্র বছর ধরে অবাঙালির ভীতি উৎপাদন করেছেন। দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। অনেক শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ আপনাকে বলবে কালীর ওই ভীতিজনক রূপটিই সত্য, রামপ্রসাদ অসত্য, তারা আপনাকে বলবে কালীমূর্তি গৃহে রাখা ভুল। চমকে যাবেন না, এরকম বাঙালি আছে, সত্যিই আছে, আমার পেজেও তারা মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসে, গতকালই এসেছিল। এরা মুখ খুললে আপনি তখন বুঝবেন এরা সেই আর্যাবর্তর চোটে বেঁকে আছে।
সেই চোট একটা চিরস্থায়ী ভয় থেকে এসেছে। এই ভীতিজনক রূপ পাবেন মার্কণ্ডেয় পুরাণেও। সেখানে কালী করালবদনা। তিনি মহাদেবী অর্থাৎ মা অম্বিকা (উত্তর ভারত এই নামেই আমাদের শক্তিকে ডাকে)-র ভ্রূকুটি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তাঁর বর্ণনা এরকমঃ তিনি নৃমুণ্ডমালিনী, তাঁর গায়ের মাংস শুকিয়ে গেছে অর্থাৎ তিনি বুভুক্ষু, হাঁ করে গিলতে চাইছেন, তাঁর ডাক ভয়ানক। তিনি চণ্ড মুণ্ড দুজন অসুরকে বধ করছেন এবং ছিন্নমুণ্ড অম্বিকাকে উপহার দিচ্ছেন বলে অম্বিকা তাঁর নাম দিলেন চামুণ্ডা।
পালযুগে এই চামুণ্ডা মূর্তির প্রভূত উপাসনা হত। বাঙালি সেযুগে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে যেত খুব সম্ভবত চামুণ্ডার চিত্রাঙ্কিত পতাকা হাতে, শত্রু ভয় পেত। চামুণ্ডার আরেকটি রূপ চর্চিকা বা চর্চা নামেও পরিচিত (রাজশাহী অঞ্চলে একটি পালযুগের প্রস্তরমূর্তি মিলেছে, সেটি চর্চার নামাঙ্কিত, ইনি বৃক্ষতলে শবের ওপরে উপবিষ্ট, সে ছবিটি দিলাম)। চর্চা অর্থে চাঁছাছোলা, অর্থাৎ কঙ্কালসার দেবী (এ ব্যুৎপত্তি সুকুমার সেনের। কিন্তু ডাক্তার রক্তিম মুখুজ্যে বলছেন এই দেবী তাঁর রক্তলিপ্ত জিহ্বা চর্চন করেন বলেই এই নাম)।
চামুণ্ডার পায়ের তলায় একটি শব থাকত, অর্থাৎ তিনি বাঙালির শত্রুদলন করেন। বর্তমানে কালীকল্পনায় এই শব পরিণত হয়েছেন শিবে। চামুণ্ডা জিহ্বাললনভীষণা (মার্কণ্ডেয়পুরাণ) ছিলেন, তিনি সর্বদাই ক্ষুধায় জিভ বের করে থাকতেন। শিবের ওপরে পা দিয়ে জিভ বের করার গল্পটি অর্বাচীন। আমাদের মা আমাদের শত্রুর রক্ত পান করবেন বলেই তৃষ্ণার্ত ক্ষুধার্ত জিভ বের করে আছেন আদিকাল থেকে।
প্রসঙ্গত পালযুগে প্রধানা বৌদ্ধদেবী তারার চারজন সহচরী থাকত, ডাকিনী, শাকিনী, লাকিনী, হাঁকিনী। এর মধ্যে ডাকিনী কথাটি পণ্ডিত স্ত্রীলোকের উপাধি ছিল। ডঙ্ক অথবা যক্ষ/দক্ষ থেকে ডাক কথাটা এসেছে, সুকুমার সেন অনুমান করেন, যেটা পণ্ডিত পুরুষমানুষের উপাধি। অর্থাৎ এরা কর্মে সাফল্য পেলে ডঙ্ক বাজাতেন, অথবা যক্ষের ন্যায় অলৌকিক শক্তির অধিকারী। শাকিনী এসেছে শঙ্খিনী থেকে। এঁরা দুজন স্মিত ও সত্ত্বগুণের অধিকারিনী হিসেবেই বৌদ্ধযুগে পূজিত, পরে অবশ্য ডাইনি আর শাকচুন্নিতে পরিণত হয়েছেন উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রভাবে।
লাকিনী (রাকিনী, শব্দটা এসেছে রঙ্কিনী থেকে, রঙ্ক অর্থে শীর্ণ ও বুভুক্ষু) কিন্তু চামুণ্ডা/চর্চার আরেক নাম, ইনি ভীষণদর্শনা। আর হাঁকিনী হলেন ভৈরবী, ভয়রব করেন যিনি, ভীতিজনক শব্দ করেন, ইনিও ভীষণা। বলা বাহুল্য, পালযুগে বাঙালির সাম্রাজ্য বিস্তারে এঁদের একটা সামান্য ভূমিকা ছিল, এই চারজনেরঃ জ্ঞানী যোগিনী (ডাকিনী), সুবেশা যোগিনী (শাকিনী), শীর্ণদেহ ক্ষুধাতুর যোগিনী (লাকিনী) এবং ভয়াবহ চিৎকার করা ভৈরবী যোগিনী (হাঁকিনী)। আজও কালীমূর্তির পাশে আমরা ডাকিনী যোগিনীর মূর্তি দেখি, সেগুলির অবশ্য উত্তর ভারতীয়দের ভয়ের চোটে কিঞ্চিৎ বঙ্কিমদশা প্রাপ্তি ঘটেছে, তার মধ্যে থেকেই আসল স্বরূপ চিনে নিতে হবে।
ছবিতে দেখছেন দুটি চামুণ্ডা মূর্তি। বরেন্দ্রভূমি ছিল পালদের জনকভূ, অর্থাৎ উৎস। সেখানে একাধিক প্রস্তরনির্মিত চামুণ্ডা মূর্তি পাওয়া গেছে। বৃক্ষের নিচে উপবিষ্ট চামুণ্ডা/চর্চা মূর্তি যেটি রাজশাহীতে পাওয়া গেছিল, সে মূর্তিটি বর্তমানে দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে আছে। অপর মূর্তিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়ামে রক্ষিত, এটি উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারে পাওয়া গেছিল। দুটিই পালযুগের, একাদশ শতকের।
মূল ফেসবুক পোস্ট ৬ই নভেম্বর ২০১৯ https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2607198532637033&id=2343427979014091

