কবি রাজশেখরের কর্পূরমঞ্জরী নাট্যের সূত্রপাতে হরগৌরী বন্দনা তথা প্রেমের এক অনবদ্য আঙ্গিক পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। শুরুতেই কবি রতির মূল ভাব ব্যক্ত করতে গিয়ে প্রাকৃতে বলেছেন:
অকলিঅপরিরম্ভবিব্ভমাহং
অজনিঅচুম্বনডম্বরাহঁ দূরং
অঘডিঅঘণতাডণাহঁ ণিজ্চঁ
ণমহ অনঙ্গরইণ মোহণাহঁ।।
(আলিঙ্গন বিভ্রমের নাহি যাতে যোগ
উৎপাদিত নাহি যাতে চুম্বন উদ্যোগ
নাহি যাতে ঘন ঘন অঙ্গ সঞ্চালন
এ হেন অনঙ্গ রতি কর আস্বাদন) (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা তর্জমায়)
এরপর নটরাজ ও তাঁর অর্ধাঙ্গিনীর যুগলমনোহর রূপের স্তুতি করেছেন এইভাবে:
শশিহণ্ডমণ্ডণাণং সংমোহণাসাণ সুরঅণপিআণং
গিরিসগিরিন্দসুআণং সংঘাডি বো সুহং দেউ।।
(শশীকলাবিভূষিত দেবতাগণের প্রিয়
সুরতাভিলাষী যেই হর পার্বতী
তাঁহাদের সম্মিলন পরিশুদ্ধ বিনির্মল
হউক গো তোমাদের সুখকর অতি)
ইসারোসপ্পসাদপ্পণদিসু বহুসো সগ্গঙ্গাজলেণ
আমুলং পুরিদাএ তুহিণকরকলারূপ্পসিপ্পিএ রুদ্দো
জ্যোণ্হামুত্তাহলিল্লং পদমউলিনিহিত্তগ্গহত্থেহিঁ দোহিং
অগ্ঘং সিগ্ঘং ব দেন্তো জঅদি গিরিসুতাপাঅপঙ্কেরুহাণং।।
(ঈর্ষা কোপ প্রশমিত প্রণত হইয়া যিনি
চন্দ্রকলা-শুক্তি পূর্ণ স্বর্গগঙ্গাজলে
জ্যোৎস্নামুক্তাফলরূপ অর্ঘ্য দেন ত্বরা করি
দুই হস্তে গিরিসুতাচরণকমলে
সেই হরের জয় জয় বল গো সকলে।।)
এখানে কবি নাট্যারম্ভে যে অনঙ্গরসতত্ত্বের অবতারণা করেছেন সেই প্রেম গৌড়মনীষার প্রাণের সম্পদ; চণ্ডীদাসের নিকষিত হেম রজকিনী প্রেম। এই প্রেম ও গৌরীপদাশ্রিত হরের রূপকল্প মনে করিয়ে দেয় পদ্মাবতীর চরণচারণচক্রবর্ত্তী কবিপতি জয়দেবের মধুরকোমলকান্ত পদাবলীতে রাধার চরণে কৃষ্ণের আত্মনিবেদনের অসামান্য বর্ণনামণ্ডিত কালজয়ী সেই পংক্তিদ্বয়কে :
স্মরগরলদলখণ্ডনম্ মম শিরসিমণ্ডলম্
দেহি পদপল্লবমুদারম্।।
এই প্রেমের মহিমাই গীত হয়েছে চণ্ডীদাসের মরমিয়া কন্ঠে:
রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম
কামগন্ধ নাহি তায়।
লালন ফকিরের গানেও সহজিয়া দেহতত্ত্বের সেই একই ভাবের প্রকাশ।
বলব কি সেই প্রেমের কথা
কাম হয়েছে প্রেমের লতা
কাম ছাড়া প্রেম যথা তথা
নয় সে আর গমন
করি কেমনে সহজ শুদ্ধ প্রেম সাধন
নাট্যোল্লিখিত উমার চরণে স্বীয় ললাটস্থ চন্দ্রকিরণের অর্ঘ্যদানরত সদাশিবের এই মূর্তি বর্তমানে কিঞ্চিত অপরিচিত হলেও এর আধ্যাত্মিক তথা তাত্ত্বিক তাৎপর্য একই। পরমা প্রকৃতির চরণে পুরুষের আত্মনিবেদনের এই অসামান্য চিত্রণ সর্বতোভাবেই সাঙ্খ্যপ্রভাবান্বিত। আদিবিদ্বান যে অসামান্য জীবনদর্শনে ব্রাত্য আর্যজাতির চেতনায় যুগান্তর ঘটিয়েছিলেন; বৈদিক আর্যকে পৌরাণিকতার নদীপথে তন্ত্রসাগরে অবগাহন করিয়ে সেই দর্শন এভাবেই ভারতের সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগকে দিকনির্দেশ করেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বাণরাজা কর্তৃক উপাসিত মহাদেবের বাণেশ্বর রূপও এই অপূর্ব দ্বৈতপ্রেমের দ্যোতক। শিব সেখানে শান্ত মহাযোগী নন। তিনি প্রমত্ত; শক্তিকে অঙ্কে ধারণ করেছেন; শৃঙ্গারের সাজে আদিরসের উল্লাস তাঁর মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে; তাঁর এই রূপ দারিদ্রদুঃখহরণ, সংসারবন্ধনদহনকারী, করুণাঘন।
একসময় উমামহেশ্বরের যুগল মূর্তি রাধাকৃষ্ণের যুগলবিগ্রহের মতোই বাঙালির হৃদয়ে দ্বৈতপ্রেমের অলৌকিক মাধুর্য বহন করত। তুর্কি আক্রমণের অভিঘাতে সেই প্রাচীন সৌরভ বিলীন হয়েছিল ইতিহাসের রুদ্ধদ্বার কক্ষে। তার অল্পকালের মধ্যেই মধ্যযুগের তমিস্রা ভেদ করে চৈতন্যসূর্যের আগমন ঘটে। গৌরসুন্দরের বলিষ্ঠ বাহুতে রচিত হয়েছিল গৌড়ীয় নাগরিক ঋদ্ধির প্রাচীন যুগের সাথে মধ্যযুগের সমন্বয়সেতু। ফলে তাঁর সমসাময়িক তথা পরবর্তী বৈষ্ণব পদাবলীসমুদ্রেই স্থান পেয়েছে সাঙ্খ্যমূল এই জাতির শেষ শুক্তিরাশি। আর সবার অলক্ষ্যে প্রকৃতিপূজক বঙ্গবাসীর হৃদয়দর্পণ থেকে অপসৃত হয়েছে একই তাৎপর্য বহনকারী শিবের পার্বতীচরণচারণচ্ছবি। তবু সর্বভারতীয় প্রাচীন মনীষার অক্ষয় কীর্তিরূপ সাহিত্যে আজও সেই তন্ত্রপরায়ণ জাতির হৃদয়হরণ যুগলচ্ছবির আভাস পাওয়া যায়। শুধু বজ্রযান সহজযানের অস্পষ্ট সন্ধ্যাভাষায় নয়; এই অপূর্ব অনঙ্গরতি সমাদৃত ছিল নাগরিক বৈদগ্ধমণ্ডিত রাজসভার কবির দ্ব্যর্থহীন কাব্যসুষমার আখরেও। নাট্যের নায়িকা কর্পূরমঞ্জরীর প্রেমের মধ্য দিয়ে তথা এক তন্ত্রসাধকের হস্তক্ষেপে সেই প্রেমের পূর্ণতার মধ্যে দিয়ে রাজশেখর সেই সমাজেরই মর্মবাণী প্রকাশ করেছেন।
মাৎস্যন্যায়ের অন্ধকার থেকে সদ্যজাগ্রত উত্তরাপথের নবম শতাব্দীর মাগধী বৈদর্ভি কাব্যসুরভীসার দ্বারা রচিত এই কালজয়ী সাট্যক নাট্য অজান্তেই নিজের উপদ্ঘাতে ধরে রেখেছে নিকষিত হেমসম কামগন্ধহীন দ্বৈতপ্রেমের এক অন্যতম চিত্র।